মস্তিষ্ক বনাম লাইব্রেরি

চারদিকের পরিবেশ-প্রকৃতি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হলে টিকে থাকার জন্য পূর্বনির্ধারিত জেনেটিক এনসাইক্লোপিডিয়াও সামগ্রিকভাবে পর্যাপ্ত হয় না। এমনকি পাঁচ শ পৃষ্ঠার এক হাজার খণ্ডের বইয়ের তথ্যসমৃদ্ধ জিন, যা আগে টিকে থাকার জন্য সঠিকভাবে কার্য সম্পাদন করেছে, তা–ও ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তন কোনো প্রাণীকে দীর্ঘ সময় ধরে অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে থাকার নিশ্চয়তা দেয় না। এই অসুবিধাগুলোকে অতিক্রমের জন্য মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছে। মস্তিষ্কের বিকাশের কারণে আমরা বলতে পারি, বুদ্ধিমত্তা মানে চারপাশের জগৎ থেকে সরাসরি শুধু তথ্য ধারণ করা নয়, সেই সঙ্গে বিচারবুদ্ধিও। যার মাধ্যমে তথ্যগুলোকে সমন্বয় ও ব্যবহার করা যায়, ভবিষ্যতের কোনো বিপদ সম্পর্কে আগে আভাস পাওয়া সম্ভব হয়, যা জিনের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো প্রয়োজনের তাগিদে মস্তিষ্কেরও উদ্ভব ঘটেছে এবং লাখ লাখ বছর ধরে জটিলতা ও তথ্য ধারণের মধ্য দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।

জিনের চেয়ে আমাদের মস্তিষ্ক অনেক বেশি জানে। কেননা, মস্তিষ্ক স্বাভাবিক মাপের একটি লাইব্রেরির ১০ হাজার গুণ বড়। এরপর আমরা প্রয়োজনবোধ করলাম মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি কিছু জানতে, সেই সময়টা এসেছিল ১০ হাজার বছর আগে। ফলে শরীরের বাইরে বিশাল পরিমাণে তথ্য মজুত রাখার পদ্ধতি আমরা শিখেছিলাম। মস্তিষ্কের বাইরে তথ্য সংরক্ষণের প্রবণতা তৈরি হয়েছিল স্মরণ, তুলনা, সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ এবং বিমূর্ত তৈরি করার মতো ক্ষমতার কারণে। ফলে এই গ্রহে আমরা একমাত্র প্রাণী, যারা এমন এক স্মৃতি সংরক্ষণাগার গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম, যার জন্য আমাদের জিনেরও দরকার নেই, এমনকি মস্তিষ্কেরও দরকার নেই। স্মৃতির এই আধারকে বলা হয় গ্রন্থাগার। এটাই এক্সট্রসোমেটিক নলেজ। সেই প্রবণতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার।

আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন মিসরের গ্রিক রাজারা। মূলত তাঁরাই আলেক্সান্দার দ্য গ্রেটের উত্তরাধিকার হয়েছিলেন। তাঁরা শিক্ষার ব্যাপারে প্রচণ্ড উত্সাহী ছিলেন। শত শত বছর গবেষণাকর্মকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন এবং সে যুগের সবচেয়ে বড় মনীষীদের কাজকর্মের জন্য গ্রন্থাগারের পরিবেশকে অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। কিন্তু সহনশীলতা, ধর্মান্ধতা, লোভ এই গ্রন্থগারকে ধ্বংস করে দেয়। আমরা একটি বিচ্ছিন্নতার মধ্যে পড়ে যাই।

প্রাচীন পৃথিবীর জানা জ্ঞান-বিজ্ঞানকে অতিক্রম করে আমরা অনেক দূর চলে এসেছি। তারপরও অতীত ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের অপূরণীয় ফাঁক থেকে গেছে। অনুমান করি, আমাদের অতীত সম্পর্কে দুর্ভেদ্য রহস্যের ধূম্রজাল অনেক দূর করতে পারতাম আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব টিকে থাকলে। একটি সদস্য কার্ডের বিনিময়ে সহজে তা জেনে যেতাম, ইন্টারনেটের যুগে তা আরও সহজ হতো। বর্তমানে তথ্য রয়েছে, এই গ্রন্থাগারে ব্যাবিলনের এক যাজক বেরোসাসের লিখিত তিন খণ্ডে সমাপ্ত প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাস ছিল। সেটা বর্তমানে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। এর প্রথম খণ্ডে সৃষ্টি পর্ব থেকে নুহের প্লাবন পর্যন্ত সময়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যে সময়কে তিনি ৪ লাখ ৩২ হাজার বছর বলেছেন অথবা ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখিত সময়পঞ্জির চেয়ে তা শতগুণ বেশি। কার্ল সাগান বলেছেন, ‘আমরা অবাক হই, শিহরিত হই ভেবে যে এর মধ্যে কী লেখা ছিল?’

বর্তমানে আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সে উদ্যোগের মধ্যে এ–ও আছে, যাতে পৃথিবী এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে না যায়। তার আর্কাইভ শক্তিশালী করা হচ্ছে, যাতে উত্তর প্রজন্ম কোনো ফাঁকের মুখোমুখি না হয়। তাই ১৯৯০ সালে মিসরের আসওয়ানে এক সম্মেলনে গ্রন্থাগারটি পুনর্নির্মাণে ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রাথমিক তহবিল নির্ধারণ করা হয়। ১৯৯৫ সালে গ্রন্থাগারটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণে মোট খরচ হয় ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রন্থাগারটি উদ্বোধন হয় ২০০২ সালের ১২ অক্টোবর। পৃথিবীর বুকে আবার মাথা তুলে দাঁড়ায় আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগার নতুন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বিষয়টি থেকে সভ্যতার এক আশাবাদী দিক আমরা দেখতে পাই। অত্যাচারী শাসক ও ধর্মান্ধদের, অনৈতিকতার বিরুদ্ধে এই সভ্যতা টিকে আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আগত সমস্যাকেও সমাধান করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি নেবে নব প্রজন্ম।

প্রাচীনকালের আলেক্সান্দ্রিয়া ও পারগামনের গ্রন্থাগারের ধারণা থেকে পৃথিবীর সব তথ্য এক স্থানে জড়ো করার বিষয়টির উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু সাধারণভাবে ব্যবহার্য ও ব্যাপক বিস্তৃত ছাপানো বিশ্বকোষের ধারণার উদ্ভব ডেনিশ ডিডেরট ও ১৮০০ শতকে অপরাপর বিশ্বকোষবিদের সময়ের কিছু আগে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইতিহাসে বৃহত্তম বিশ্বকোষ সম্পাদকদের মিলনক্ষেত্রের একটি হচ্ছে উইকিপিডিয়া, যেটি নবনির্মিত আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের ছাদের নিচে স্থান নিয়েছে।

গ্রন্থাগারের ৩২ মিটার উঁচু ছাদটি চিত্তাকর্ষক বর্গাকৃতির বা কাফারড স্থাপত্য। যার পৃষ্ঠে ৪ হাজার ২০০ বিভিন্ন অক্ষর উত্কীর্ণ করা আছে। অতীতে অজ্ঞতা ও ধর্মান্ধতায় ধ্বংস হয়েছিল আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার। কিন্তু তা আমাদের থামিয়ে রাখতে পারেনি। আমাদের সৌভাগ্য এখনো গ্রন্থাগারটি গ্রন্থরাজি সংগ্রহে নিজেকে প্রসারিত করে চলেছে। প্রাচীনকালের এই বৃহত্তম গ্রন্থগারটির আধুনিক সংস্করণটিও ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত, আলেক্সান্দ্রিয়ার দ্বিতীয় মিসরীয় শহর। এর কয়েক মিটারের মধ্যে পুরোনো গ্রন্থাগারটি ছিল বলে ধারণা করা হয়। সেই প্রাচীন গৌরব পুনরুদ্ধারে এটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্য ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে।

কাচের নির্মিত রাস্তা দিয়ে ভবনে প্রবেশ করতে হয়। এর ভেতরে আছে বেশ কিছু জাদুঘর, একটি সম্মেলনকেন্দ্র, প্ল্যানেটেরিয়াম ও একটি পাঠকক্ষ। পাঠকক্ষ ১১টি স্তরে ২ হাজার জনকে জায়গা দিতে পারে। বর্তমানে ৮০টি ভাষায় ১৫ লাখ গ্রন্থ এখানে আছে। তবে সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৮০ লাখ। রয়েছে ৫০ হাজার ম্যাপ, ১০ হাজার পাণ্ডুলিপি, ৫০ হাজার দুর্লভ গ্রন্থ এবং ১০ হাজার আধুনিক বিশ্বের কপি ও ৫০ হাজার ভিজুয়্যাল অডিও ফাইল।

গ্রন্থাগারের বেসমেন্টে ডিজিটাল ল্যাবের দেখা পাই। যেখানে পুরোনো বইকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিজিটাল করার প্রোগ্রাম আছে। বর্তমানে গ্রন্থাগারে ৮০ লাখ ভিজিটর আসা–যাওয়া করেন প্রতিবছর। নতুন ভবনটি আল শেটবি এ আল সেলসিলা সৈকতের সামনে সাগরপ্রাচীরের পাশে নির্মিত হয়েছে। বাইরে ভবন স্থাপত্য আলেক্সান্দ্রিয়ার বাতিঘরকে স্মরণ করে। আচ্ছাদনটি ধাতব কাঠামোর গ্লাসে তৈরি। বাইরের বাঁকানো বৃহৎ দেয়ালটি আসওয়ানের গ্রানাইট থেকে তৈরি করা হয়েছিল। ভেতরে শক্ত কাঠের লাইন হল। এ ছাড়া মেঝে ওকগাছের কাঠ দিয়ে তৈরি।

প্রাচীন মানবেরা জানত যে পৃথিবী খুবই পুরোনো। তারা দূরবর্তী অতীতকে অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর প্রাচীনত্বকে বোঝার চেষ্টা করেছে। আমরা এখন জানি, তারা এ পর্যন্ত যা চিন্তা করেছে, তার চেয়েও অনেক বেশি পুরোনো হলো শৃঙ্খলাপূর্ণ মহাবিশ্ব বা কসমস। মহাশূন্যে বিশ্বকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি আমরা বসবাস করছি ধূলির এক কণায়। এটি অন্ধকারময় গ্যালাক্সির দূরবর্তী কোণে অবস্থিত এবং সাধারণ একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে চলছে। যদি এই অপরিমেয় মহাশূন্যে আমাদের অবস্থান একটি কণার মতো হয়, তাহলে যুগের বিস্তৃতিতে আমরা ক্ষণিকের আভাসমাত্র। আমরা এখন জানি যে আমাদের বিশ্ব হলো প্রায় ১ হাজার ৩৭০ কোটি বছরের পুরোনো। বিশ্বের শুরুতে শুধু মহাশূন্যের সব অংশজুড়ে সমভাবে বিকিরিত একটি অগ্নিগোলক; কোনো গ্যালাক্সি, নক্ষত্র অথবা গ্রহ, কোনো প্রাণ অথবা কোনো সভ্যতা ছিল না। মহাবিস্ফোরণ থেকে কসমস পর্যন্ত দীর্ঘ করিডরটি কেবল আমরা জানতে শুরু করেছি। যে পর্যন্ত না আমরা আর কোনো জায়গায় বুদ্ধিমান প্রাণী দেখতে পাই, ততক্ষণ আমরাই হচ্ছি মহাবিস্ফোরণের সুদূর উত্তরাধিকার। যে বিশ্ব থেকে আমাদের উদ্ভব ঘটেছে তাকে বোঝার জন্য আমরা নিজেদের উত্সর্গ করেছি। তাকে ক্রমাগত বোঝার মধ্য দিয়ে আমরা হয়ে উঠব সহনশীল, নমনীয় এবং সম্প্রসারিত হবে আমাদের মানবিকতা। এগুলোই টিকে থাকার পূর্বশর্ত।

লেখক: বিজ্ঞানবক্তা