মহাকর্ষীয় বলের শক্তি কি অন্য মাত্রায় চলে যাচ্ছে

আমাদের এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে, তার সবই চারটি বল বা মিথস্ক্রিয়া দিয়ে পদার্থবিদেরা ব্যাখ্যা করছেন। বিদ্যুৎচুম্বকীয়, নিউক্লীয় সবল, নিউক্লীয় দুর্বল ও মহাকর্ষ বল। বিজ্ঞানীরা অবশ্য এগুলোকে ‘বল’ না বলে ‘মিথস্ক্রিয়া’ (Interaction) বলাটাই সংগত মনে করেন। এই লেখায় সরলীকরণের স্বার্থে আমরা দুটি সংজ্ঞাই ব্যবহার করব। মিথস্ক্রিয়াগুলোর মধ্যে তড়িৎচুম্বকীয় ও মহাকর্ষ বল আমাদের চেতনায় সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। মহাকর্ষ বা মাধ্যাকর্ষণ বল আমাদের পৃথিবীর বুকে ধরে রেখেছে, পৃথিবীকে সূর্যের কক্ষপথে চালনা করছে। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল আমাদের শরীরসহ চারদিকের সব গঠনের জন্য দায়ী, আমরা চোখের সামনে যা কিছু দেখছি—চেয়ার, টেবিল, দেয়াল, গাড়ি, গাছ, মাটি, মানুষ, জল, পাথর— যা–ই হোক না কেন, তাদের গঠনকে ধরে রেখেছে বিদ্যুৎচুম্বকীয় আকর্ষণ। এমনকি তাদের আমরা যে আলোর সাহায্যে দেখছি, সেই দেখার কাজটাও বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের মিথস্ক্রিয়ার ফল। কাজেই আমাদের জীবনে এই বলটির ভূমিকা প্রচণ্ড। অন্যদিকে নিউক্লীয় বল সম্পর্কে আমরা সে রকমভাবে সচেতন নই, কিন্তু সবল মিথস্ক্রিয়া পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রনদের একত্রে ধরে রেখে নিউক্লিয়াসকে স্থিত রাখছে, বস্তুর গঠনকে রূপ দিচ্ছে। দুর্বল মিথস্ক্রিয়া আবার কোনো কিছুকে ধরে রাখে না, বরং ভেঙে দেয়, একটি কণাকে আরেকটি কণায় রূপান্তর করে, নিউট্রন থেকে আমরা প্রোটন পাই। নক্ষত্রের অভ্যন্তরে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম, হিলিয়াম থেকে আরও ভারী মৌলিক বস্তু গড়তে এই দুর্বল বল ভূমিকা রাখে। আমাদের শরীরে যে অক্সিজেন, লোহা ইত্যাদি মৌল পদার্থ রয়েছে, সেগুলো কোনো তারার অভ্যন্তরে দুর্বল মিথস্ক্রিয়ার সাহায্যেই হয়েছে।

এই চারটি বলের মধ্যে সবচেয়ে রহস্যজনক, যাকে আমরা সবচেয়ে কম বুঝি, সেটা হলো মহাকর্ষ। শুনে আশ্চর্যই হতে হয়, তাই না? মহাকর্ষ এমন একটি বল, তার সঙ্গে যেন অন্য তিনটি মিথস্ক্রিয়ার কোনো সম্পর্কই নেই। আর চারটি বলের মধ্যে এটি হলো সবচেয়ে দুর্বল। যদি সবল নিউক্লীয় বলের মান ১ ধরা হয়, তবে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল তার থেকে হবে ১০-৩, বা ১ হাজার গুণ কম শক্তিশালী, নিউক্লীয় দুর্বল বল হবে ১০-১৬ গুণ কম শক্তিশালী, আর মহাকর্ষ বল হবে ১০-৪১ গুণ দুর্বল। একটা দুর্বল চুম্বক খুব সহজেই একটা লোহার পেরেক পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে তুলে নিতে পারে, পৃথিবীর বিশাল ভরের মাধ্যাকর্ষণ সেই চুম্বকীয় বলের বিরুদ্ধে অসহায়। মহাকর্ষ বল যদি এত দুর্বলই হবে, তাহলে মহাবিশ্ব গড়তে, নক্ষত্র, সৌরজগৎ, গ্যালাক্সি, গ্যালাক্সি দল গঠন করতে সে মূল ভূমিকা কেমন করে পালন করে?

এই চারটি বলের মধ্যে সবচেয়ে রহস্যজনক, যাকে আমরা সবচেয়ে কম বুঝি, সেটা হলো মহাকর্ষ। শুনে আশ্চর্যই হতে হয়, তাই না? মহাকর্ষ এমন একটি বল, তার সঙ্গে যেন অন্য তিনটি মিথস্ক্রিয়ার কোনো সম্পর্কই নেই
স্ট্রিং–তত্ত্বের একটি মডেল অনুযায়ী মহাকর্ষ বল-কার্যকরী কণা গ্র্যাভিটন আমাদের পরিচিত স্থান-কালের বাইরে অন্য মাত্রায় ভ্রমণ করতে পারে

নিউক্লীয় সবল ও দুর্বল মিথস্ক্রিয়ার বিস্তার, অর্থাৎ যে পরিমাণ দূরত্ব পর্যন্ত সেগুলো কাজ করে, তা খুবই কম, সেটা নিউক্লিয়াসের দৈর্ঘ্যের মধ্যেই তা আবদ্ধ। অন্যদিকে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় ও মহাকর্ষের বিস্তার অসীম পর্যন্ত। কিন্তু বিদ্যুৎ–চুম্বকের ক্ষেত্রে যেমন ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধান আছে, মহাকর্ষের ক্ষেত্রে সে রকম কিছু নেই। মহাবিশ্বের যাবতীয় বস্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধনাত্মক (যেমন নিউক্লিয়াস) ও ঋণাত্মক আধান (ইলেকট্রন) দিয়ে তৈরি। যারা যুক্তভাবে নিরপেক্ষ শূন্য আধান তৈরি করে—যার ফলে তাদের তড়িৎ ক্ষেত্র খুব শক্তিশালী নয়। যেমন আমাদের শরীর অনেক তড়িৎ আধান দিয়ে তৈরি হলেও শেষাবধি ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধানের কাটাকুটির ফলে আমরা আধানযুক্ত নই (শুষ্ক মৌসুমে শরীরে সামান্য স্থিত আধান জমলে আমরা কোনো ধাতব বস্তু ধরতে গেলে শক খাই, তার থেকে বোঝা যায় তড়িৎশক্তি কত শক্তিশালী)। কিন্তু মহাকর্ষের মধ্যে কোনো ঋণাত্মক ভর নেই, এই মহাবিশ্বকে যতটুকু আমরা জানি, সেটা শুধু একধরনের ভর দিয়ে তৈরি, আমরা তাকে ধনাত্মক ভর বলছি। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার সূত্র অনুযায়ী এই ধরনের ভর যে বক্র স্থানকাল তৈরি করে, তা শুধু আকর্ষণ দিয়েই বর্ণনা করা যায়—এই ভর থেকে বিকর্ষণের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই শেষাবধি অনেক ভর মিলে মহাকর্ষের বলকে শক্তিশালী করেছে।

স্ট্রিং তত্ত্ব আমাদের তিনটি স্থানের মাত্রার বাইরে আরও ছয় বা সাতটি মাত্রার কথা বলছে। অনেকে ভাবছেন, মহাকর্ষ বলের মান কম হওয়ার কারণ মহাকর্ষের কিছু শক্তি আমাদের এই ত্রিমাত্রিক জগতের বাইরে ওই ধরনের অতিরিক্ত মাত্রায় চলে যাচ্ছে

কিন্তু মহাকর্ষ বলের মান এত কম কেন? পদার্থবিদেরা তাত্ত্বিকভাবে বিদ্যুৎচুম্বকীয় ও নিউক্লীয় দুর্বল মিথস্ক্রিয়াকে একত্র করেছেন। এর সঙ্গে নিউক্লীয় সবল মিথস্ক্রিয়াকে একীভূত করে Grand Unified Theory (GUT) নামের একটি তত্ত্বের প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু GUT-এর কোনো অবিসংবাদিত তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা এখনো দাঁড় করাতে পারেননি। GUT-এর অনেক মডেল আছে, কিন্তু প্রতিটি মডেলের এমন কিছু ভাবীকথন আছে, যেগুলোকে কিনা প্রকৃতিতে দেখা যায়নি। GUT-কে নিয়ে বিজ্ঞানীরা অন্তত চিন্তা করতে পারছেন, কিন্তু এর সঙ্গে মহাকর্ষকে কীভাবে এক করবেন, সেই পদ্ধতিটা বিজ্ঞানীরা এখনো কবজা করতে পারছেন না, কারণ মহাকর্ষ একেবারেই অন্য রকম একটা বস্তু। আমরা যদি এমন অণুবীক্ষণ যন্ত্র উদ্ভাবন করতে পারি, যা দিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্থানকে অবলোকন করা যায়। তবে হয়তো দেখা যাবে, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব অনুযায়ী ওই স্থানের কোনো নির্দিষ্ট মান ও দিক পাওয়া যাবে না, বরং স্থান তখন একধরনের ফেনার মতো ব্যবহার করবে, যাকে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম ফেনা বলছেন। সেখানে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা কাজ করবে না। বোঝাই যাচ্ছে, এখানে সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটা সংঘর্ষ হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা স্ট্রিং তত্ত্ব, কোয়ান্টাম লুপ গ্র্যাভিটি তত্ত্বসহ বেশ কয়েকটি তত্ত্বের ওপর গত ৪০ বছর কাজ করে যাচ্ছেন। স্ট্রিং তত্ত্ব আমাদের তিনটি স্থানের মাত্রার বাইরে আরও ছয় বা সাতটি মাত্রার কথা বলছে। অনেকে ভাবছেন মহাকর্ষ বলের মান কম হওয়ার কারণ মহাকর্ষের কিছু শক্তি আমাদের এই ত্রিমাত্রিক জগতের বাইরে ওই ধরনের অতিরিক্ত মাত্রায় চলে যাচ্ছে।

কীভাবে এ ধরনের অতিরিক্ত মাত্রায় ভ্রমণ সম্ভব? স্ট্রিং তত্ত্বের মতে, সব ধরনের মৌলিক কণা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তারের বা তন্তুর কম্পনের ফল। এই তত্ত্বে বেশির ভাগ তার বা তন্তুর দুই দিক আমাদের স্থান-কালে আটকানো থাকে, কিন্তু মহাকর্ষ বল যে অনুকল্পিত কণার মাধ্যমে সাধিত হয়, যার নাম হলো গ্র্যাভিটন—সেটির তন্তুটি আমাদের স্থান–কালে আটকানো নয়। এর কারণ হলো গ্র্যাভিটন আমাদের স্থান-কালেরই একটা খুবই ক্ষুদ্র আলাদা বা ছিন্ন অবস্থা (quantized)। কাজেই এর তন্তুটি স্থান-কালে আবদ্ধ নয়, বরং এর দুটি দিক মিলিত হয়ে একটি কুণ্ডলী সৃষ্টি করে। যেহেতু গ্র্যাভিটন আমাদের স্থান-কালে আবদ্ধ নয় (বরং যেটি স্থান-কালের কোয়ান্টাইজড অবস্থা) সেটি অন্য মাত্রায় ভ্রমণ করতে পারে। যেহেতু স্ট্রিং তত্ত্বে অন্য মাত্রা আছে, সে জন্য গ্র্যাভিটন মাধ্যমে মহাকর্ষের কিছু শক্তি আমাদের পরিচিত মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে যেতে পারে। তবে স্ট্রিং তত্ত্ব এবং গ্র্যাভিটন ছাড়াও নানা পরিবর্তিত মহাকর্ষীয় তত্ত্বও এ রকম অতিরিক্ত মাত্রার ভূমিকার কথা বলছে। বলাবাহুল্য যে এগুলো অনুকল্প মাত্র।

২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট ১৩০ মিলিয়ন দূরে অবস্থিত দুটি নিউট্রন তারার সংঘর্ষে উদ্ভূত মহাকর্ষ তরঙ্গ পৃথিবীতে পর্যবেক্ষিত হয়। একই সঙ্গে উৎস-স্থল থেকে গামা রশ্মি বিস্ফোরণ, দৃশ্যমান আলো, এক্স-রে ও বেতার তরঙ্গ দেখা যায়। ছবিতে চিত্রকরের দৃষ্টিতে সংঘর্ষটি দেখানো হয়েছে

তবে এই অনুকল্পটির একটি পরীক্ষা করার সুযোগ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। গত বছর বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে এমন একটি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিরীক্ষণ করেন, যার উৎস ছিল দুটি নিউট্রন নক্ষত্রের সংঘর্ষ। জ্যোতির্বিদেরা ১৩০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্যালাক্সিতে ওই সংঘর্ষটি আবার বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় তরঙ্গের দৃশ্যমান আলোয়, এক্স ও গামা রশ্মি ও বেতার তরঙ্গেও দেখতে পান। পৃথিবীতে অবলোকিত মহাকর্ষীয় তরঙ্গের গঠন থেকে বিজ্ঞানীরা উৎসের দূরত্ব নিরূপণ করতে পারেন। যেহেতু এই ঘটনাটি বিদ্যুৎচুম্বকীয় আলোতেও দেখা গেছে, সে জন্য ওই সংঘর্ষ স্থানটির দূরত্ব স্বাধীনভাবে বের করা সম্ভব। যদি এই দুটি দূরত্বের মান—একটি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ থেকে ও অপরটি বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ থেকে—একই হয়, তাহলে বুঝতে হবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ অন্য কোনো মাত্রায় ক্ষয়িত হচ্ছে না। যদি মহাকর্ষীয় দূরত্বের মান বেশি হয়, বুঝতে হবে সংঘর্ষের স্থান থেকে পৃথিবীতে আসার পথে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মান দুর্বল হয়েছে, হয়তো তার শক্তি অন্য মাত্রায় চলে যাচ্ছে। তবে গবেষকেরা এই দুটি দূরত্ব তুলনা করে বলছেন, মহাকর্ষের শক্তি অতিরিক্ত মাত্রায় চলে যাওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি (উৎসাহী পাঠকের জন্য মূল বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের লিঙ্ক নিচে দেওয়া হলো)। তবে এই ঋণাত্মক ফলাফল স্ট্রিং তত্ত্ব বা অন্যান্য পরিবর্তিত মহাকর্ষ–তত্ত্বে বর্ণিত বাড়তি মাত্রা নাকচ করে দেবে না কারণ, সেসব মাত্রায় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ খুব বেশি দূর যেতে পারে না। শুধু যেসব তত্ত্বে অতিরিক্ত মাত্রার আকার অপেক্ষাকৃতভাবে বড়, সেসব তত্ত্ব এই ফলাফলে প্রভাবিত হবে। অতিরিক্ত মাত্রার অস্তিত্বের প্রমাণের পরীক্ষা দুষ্কর, সেখানে জ্যোতির্বিদ্যা আমাদের একটা সুযোগ দিয়েছিল। দুঃখের বিষয়, সেই পরীক্ষার ফলাফল ঋণাত্মক। এই উপসংহার যদি ভবিষ্যতে সমর্থিত হয়, তবে ‘মহাকর্ষ শক্তি কেন দুর্বল’—এই সমস্যার সমাধান শিগগিরই হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

লেখক: জ্যোতিঃপদার্থবিদ ও অধ্যাপক, রিভারসাইড কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

সূত্র: ১. Pardo K. et al 2018, Limits on the number of spacetime dimensions from GW170817

https://arxiv.org/pdf/1801.08160.pdf