পদার্থবিজ্ঞান
নিউক্লিয়াসের হাত ধরে নিউট্রিনোর পথে (পর্ব - ১)
মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় কণার অন্যতম নিউট্রিনো। একে ভুতুড়ে কণা বলেও ডাকেন কোনো কোনো বিজ্ঞানী। এ কণার ভর খুব কম, চার্জ শূন্য। তাই কোনো বস্তুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে না বলেই চলে। কণাটির আবিষ্কারের কাহিনি তাই রহস্যগল্পের মতোই রোমাঞ্চকর। আসুন, সেই গল্পই শোনা যাক...
আমরা স্কুলের প্রাথমিক বিজ্ঞানের পাঠ থেকেই জেনে এসেছি ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন নিয়ে পরমাণু গঠিত। আর এই অণু–পরমাণুর ধারণাগুলো জরুরি হয়ে পড়েছিল। কারণ, রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিধারা ব্যাখ্যা করার জন্যই এগুলোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যদিও ডেমোক্রিটাস ঐতিহাসিকভাবে অ্যাটম বা পরমাণুর ধারণা দিয়েছিলেন খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে। কিন্তু এই ধারণার পেছনে কোনো পরীক্ষামূলক শক্ত প্রমাণ দেখাতে পারেননি ডেমোক্রিটাস কিংবা তাঁর অনুগামীরা। সেটা সম্ভবও ছিল না। কারণ, মানুষের কাছে এমন প্রযুক্তিও ছিল না তখন। বিজ্ঞানচর্চা আদতে একটি সামাজিক কার্যক্রম। যদিও আমরা প্রায়ই মনে করি, একজন বিজ্ঞানী নির্জন দ্বীপে বসে বৈপ্লবিক কিছু আবিষ্কার করে ফেলেন এবং আইনস্টাইনকে এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে মানা হয়। এ ধরনের ক্ষেত্রেও আসলে অন্য বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান থাকে। ডেমোক্রিটাসের ধারণার সপক্ষে অকাট্য কোনো পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ছিল না।
পরমাণুর ধারণাটি পদার্থবিজ্ঞানে শক্তভাবে আসন করে নিতে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে। রসায়নবিদেরা অণুর ধারণা নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও পদার্থবিজ্ঞানে লুডভিগ বোলজম্যান ঘরানার বাইরের লোকজন এটাকে একটা মডেলের চেয়ে বেশি কিছু গুরুত্ব দিতেন না। অবশ্য ১৮৯০–এর পর থেকে এই চিত্রপট খুব দ্রুতই পাল্টাতে থাকে। ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে জে টমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। এর কয়েক বছরের মধ্যে আলবার্ট আইনস্টাইন ব্রাউনিয়ান গতির ব্যাখ্যা দেন, ফলে আণবিক তত্ত্ব সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরের ইতিহাস রাদারফোর্ডের হাতে গড়া; তাঁর কথা আর এখন নাই–বা বললাম।
আলফা বিকিরণ বিজ্ঞানীদের জন্য যত না ধাঁধা ছিল, বিটা বিকিরণ তাঁদের ভুগিয়েছে আরও বেশি
অন্যদিকে ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকরেলের হাতে ‘দুর্ঘটনাবশত’ তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু এর উৎস নিয়ে বিংশ শতাব্দীর একদম শুরুতে ধাঁধা ছিল। কিন্তু রাদারফোর্ডের নিউক্লিয়ার মডেল প্রস্তাবিত হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন, নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে আসে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। তবু একটা ঝামেলা ছিল। কীভাবে তেজস্ক্রিয় রশ্মিগুলো তৈরি হয়, সেটার উত্তর মেলেনি ১৯৩০-এর আগপর্যন্ত। এর কারণ মূলত দুটি। ১. পরমাণুর চেয়ে নিউক্লিয়াসের আকার ১ মিলিয়ন (১০ লাখ) গুণের ছোট। এই ক্ষুদ্র জগতে নিখাদ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রয়োগ না করে কোনো কিছু গণনা করা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতে বিজ্ঞানীদের ১৯২৫ সাল পর্যন্ত লেগে যায়। ২. একটা তত্ত্ব দিলেই বিজ্ঞানীদের কাজ শেষ হয়ে যায় না। সেটা ঠিক কি না, তা নির্ণয় করার জন্য লাগে পরীক্ষা ও তা থেকে পাওয়া নির্ভরযোগ্য ডেটা। এখন তো ইলেকট্রনিকের কল্যাণে অনেক সূক্ষ্ম পরিমাপ করা সম্ভব। কিন্তু ৬০-৭০ বছর আগেও অবস্থা এমন ছিল না। একই পরীক্ষা দুজন বিজ্ঞানী আলাদা আলাদা করে কোনো তত্ত্বের সপক্ষে ও বিপক্ষে উপাত্ত (অর্থাৎ ডেটা) হাজির করেছেন, এমন ঘটনা বিস্তর ঘটেছে। এখনো যে এমন ঘটনা ঘটে না, তা কিন্তু নয়। বছর দশেক আগে অপেরা নামের এক পরীক্ষক দল দাবি করে, নিউট্রিনো নামের কণাটি নাকি আলোর চেয়ে বেশি গতিতে ছোটে। তাদের দাবির যথার্থতা যাচাই না করেই বেশ কিছু উদ্ভট তত্ত্ব সামনে এনেছিলেন অনেকে। সেগুলো আবার দৈনিক পত্রিকাগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে ও ফলাও করে ছেপেছিল। এ প্রসঙ্গে প্রয়াত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগানের ভাষায় বলতে হয়, ‘অসাধারণ দাবির সপক্ষে অসাধারণ প্রমাণ প্রয়োজন।’ পরে জানা গেল, অপেরা পরীক্ষণ প্রণালিতে গলদ রয়েছে। এ জন্য বিজ্ঞানীদের ‘চিল কান নিয়ে গেছে’ শুনে দৌড় দিতে নেই।
আসল প্রসঙ্গে তাহলে এবার ফেরা যাক। তেজস্ক্রিয়তার ইংরেজি রেডিও অ্যাকটিভিটি (radioactivity) হলেও এই ঘটনার সঙ্গে রেডিও বা বেতারের খুব কমই সম্পর্ক রয়েছে। তবে আবিষ্কারের কিছুদিনের মধ্যে বিজ্ঞানীরা বুঝে ফেলেন, তেজস্ক্রিয়তার ভেতরে আসলে তিন ধরনের বিকিরণ রয়েছে। আলফা (α), বিটা (β) ও গামা (γ) বিকিরণ। রাদারফোর্ডই খুব দ্রুতই প্রমাণ করে ফেলেছিলেন, বিকিরিত আলফা কণাগুলো আসলে হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস। যে পরীক্ষাটা করে তিনি এটা প্রমাণ করেন, যা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে অতুলনীয়। আলফা কণার চার্জ যে ইলেকট্রনের চার্জের দুই গুণ এবং বিপরীতধর্মী, এ ঘটনা বিংশ শতাব্দী শুরু হওয়ার আগেই বিজ্ঞানীরাই জানতে পারেন। বলা বাহুল্য, এই পরীক্ষণের পেছনেও রাদারফোর্ডের হাত ছিল। এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে করিয়ে দিই, রাদারফোর্ড নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯০৮ সালে, কিন্তু রসায়নে। তিনি নাকি যাঁদের কাজ পছন্দ করতেন না, তাঁদের ‘কেমিস্ট’ বলে উপহাস করতেন। দুর্জনে বলে, রাদারফোর্ডকে শায়েস্তা করার জন্যই পদার্থবিজ্ঞানে এত এত মৌলিক কাজ থাকার পরও তাঁকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল না দিয়ে রসায়নে নোবেল দেওয়া হয়েছিল!
আলফা বিকিরণ বিজ্ঞানীদের জন্য যত না ধাঁধা ছিল, বিটা বিকিরণ তাঁদের ভুগিয়েছে আরও বেশি। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে যে কণাগুলো বের হচ্ছে, তার শক্তি পরিমাপ করা সম্ভব এবং তার সংখ্যাও মাপার পদ্ধতি ইতিমধ্যে আমরা জানি। কীভাবে সেটা করা হয়, তা আমাদের এই মুহূর্তে না জানলেও চলবে। যদি আমরা কোনো নির্দিষ্ট তেজস্ক্রিয় মৌল (ধরা যাক, রেডিয়াম) থেকে প্রতি সেকেন্ডে একই শক্তিতে বিকিরিত আলফা কণা বনাম শক্তির পরিমাণ দিয়ে একটা গ্রাফ আঁকি, তাহলে সেটার চেহারা দেখাবে অনেকটা ১ নং ছবির মতো।
এই চিত্র প্রমাণ করে, আলফা কণা বিকিরণ প্রক্রিয়ায় শক্তি সংরক্ষিত হয়। কারণ, রেডিয়াম নিউক্লিয়াস ভেঙে শুধু রেডন (যেটা একটা নিষ্ক্রিয় গ্যাস) ও আলফা কণা তৈরি হয়:
Ra = Rn + α
তবে আলফা কণার শক্তির মান হবে রেডিয়াম (Ra) ও রেডন (Rn) নিউক্লিয়াসের শক্তির পার্থক্যের সমান। দুটিই ভারী নিউক্লিয়াস হওয়ার কারণে, মূলত আলফা কণাই বেশি গতিশক্তি পেয়ে থাকে। আরেকটু ব্যাখ্যা করি। ধরা যাক, একজন পর্যবেক্ষক রেডিয়ামের ওপর বসে আছেন। তাহলে তিনি রেডিয়ামকে স্থির দেখবেন। এই পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে রেডন ও α–কণার ভরবেগ সমান কিন্তু বিপরীতমুখী। ধরা যাক, তার মান p।
এ সুযোগে মনে করিয়ে দিই, কণার ভর M হলে তার গতিশক্তি হবে ½ MV2, যেখানে কণার বেগ V। ভরবেগ দিয়ে প্রকাশ করলে এই গতিশক্তির মান দাঁড়ায় (p2)/2m। তাহলে ভরবেগ সমান হলেও যে কণার ভর কম (এ ক্ষেত্রে α কণা) সেটাই বেশি গতিশক্তি বহন করবে। আলফা কণার ভর রেডনের ভরের তুলনায় অনেক কম। তাই এর গতিশক্তি রেডনের চেয়ে প্রায় ৫৫ গুণ বেশি। এ ক্ষেত্রে α-কণা বিকিরিত শক্তির ৯৮ শতাংশই বহন করে। এখানে আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয় যে আলফা কণার শক্তির মান একটি স্থির রাশি। কারণ, Ra ও Rn নিউক্লিয়াসের ভরও অপরিবর্তনশীল। তার মানে, আমরা যদি বিকিরিত আলফা কণার শক্তির মানগুলো নির্ণয় করতে পারি, তাহলে সেখান থেকে আমরা তার উৎসে কী কী উপাদান/মৌল আছে, তা বের করতে পারব। ব্যাপারটা এ রকম—আলোর বর্ণালি বিশ্লেষণ করে তা কোন মৌল থেকে নিঃসৃত হচ্ছে, তা জানতে পারছি আমরা।
এই একই ধারণাগুলো বিটা রশ্মির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এক ঘাপলার মধ্যে পড়ে গেলেন। সেটা নিয়ে আলাপ করব এই গল্পের পরবর্তী পর্বে।
লেখক: অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়