ভাইরাস, ভাইরাস

আপনি যদি স্কুলের বইয়ে পড়ে থাকেন—ভাইরাস উদ্ভিদও নয়, প্রাণীও নয়, তাহলে ভুল পড়েননি। ভাইরাস এতই ক্ষুদ্র এবং গঠন এতই সরল (অন্যান্য জীববস্তুর তুলনায়) যে ভাইরাসকে প্রাণী বা উদ্ভিদ বলতে রাজি নন অনেক বিজ্ঞানী। ব্যাকটেরিয়া থেকেও ক্ষুদ্র ভাইরাস। ফলে ভাইরাসকে অণুজীব (Microbe) হিসেবেও মেনে নিতে চান না অনেকে। ভাইরাসের আকার কিংবা গঠন যা–ই হোক না কেন, দুনিয়াব্যাপী সাধারণ মানুষের প্রশ্ন হলো, এত ক্ষুদ্র ভাইরাস কী করে আমাদের কুপোকাত করে?

ভাইরাসের ছবিতে আমরা কতগুলো স্পাইক দেখি। এগুলো প্রোটিন দিয়ে তৈরি। এই স্পাইকগুলো অনেকটা চাবির মতো কাজ করে। ভাইরাস চাইলেই আমাদের সব কোষের ভেতর প্রবেশ করতে পারে না

ভাইরাস যে শুধু মানুষকে কাবু করে, তা নয়। ভাইরাস অন্য যেকেনো জীববস্তুকেই আক্রমণ করে। অন্য প্রাণীকে আক্রমণ করলে সেসব প্রাণী থেকেও আমরা আক্রান্ত হই। ভাইরাসের জৈবিক গড়ন ও গঠনটা মানুষের শরীরের কোষের মতো জটিল ও বহুক্রিয়াময় (Multifunctional) নয়। আমাদের কোষগুলো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ তৈরি হয়। আর এই কোষবিভাজনের বিষয়টা ভাইরাস একা করতে পারে না। একটা ভাইরাস থেকে আরেকটা ভাইরাস তৈরির জন্য একটা আশ্রয় কোষ (Host Cell) লাগে। ভাইরাস যখন দেহের কোষে ঢুকে পড়ে, তখন আমাদের কোষের ভেতর যে ক্রিয়া-কৌশল আছে, সেটাকে ব্যবহার করে। মনে করুন, কেউ বেড়াতে এসে আপনার বাসার সদস্য বনে গেল এবং আপনারই ক্ষতি করতে শুরু করল, বিষয়টি অনেকটা তেমন।

ভাইরাস কী করে মানুষকে পর্যুদস্ত করে, সেটা বুঝতে হলে মানুষের কোষ সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা থাকা এবং কোষের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে পরিচয় থাকা ও নাম জানা প্রয়োজন। আমাদের শরীর অসংখ্য কোষ দিয়ে গঠিত। খুবই ক্ষুদ্র সেসব কোষই হলো মানবদেহের ক্ষুদ্রতম ইউনিট। জীবদেহের কোষকে একটা বহুতল ভবনের প্রতিটি ইটের সঙ্গে তুল‍না করা যেতে পারে। শুধু জীবের কোষ নিয়ে কয়েক ভলিউমের বই লেখা সম্ভব। যা–ই হোক, এই কোষের ভেতর নিউক্লিয়াস বলে একটা অংশ আছে। মানুষের কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতর থাকে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম। সহজ ধারণার জন্য বলে রাখি, এই ক্রোমোজোমগুলো মূলত ডিএনএ (DNA) নামক বস্তুর কুণ্ডলিত রূপ। জিন নামে যে শব্দটির সঙ্গে পরিচিত, সেটা হলো ডিএনএরই নির্দিষ্ট অংশ। কোষ বিভাজিত হয়ে অন্য একটা নতুন কোষ তৈরির আগে, এক সেট ডিএনএ থেকে হুবহু আরেক সেট ডিএনএ তৈরি হয়। বিজ্ঞানে এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় রেপ্লিকেশন। ডিএনএ থেকে ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে তৈরি হয় আরএনএ (RNA)। ডিএনএ এবং আরএনএর গঠনে কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আছে। তাদের কাজও আলাদা।

আরএনএ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করে, সেটা হলো প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা দেয়। একেকটা আরএনএ একেক ধরনের প্রোটিন বা পলিপেপটাইড তৈরির কোড বহন করে। আরএনএ কাজটা করে রাইবোজোমের সাহায্যে। তাই রাইবোজোমকে অনেক সময় বলা হয় প্রোটিন তৈরির মেশিন। কোষের ভেতর রাইবোজোম নামক বস্তুটি থাকে নিউক্লিয়াসের বাইরে। তাই আরএনএ নিউক্লিয়াসের ভেতর তৈরি হলেও নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে এসে রাইবোজোমের সংস্পর্শে আসে। কিন্তু ডিএনএ কখনো নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে পড়ে না। মোদ্দা কথা, কোষের নিউক্লিয়াসে থাকে ডিএনএ, ডিএনএ থেকে ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে তৈরি হয় আরএনএ এবং আরএনএ থেকে নিউক্লিয়াসের বাইরে রাইবোজোমের সাহায্যে ট্রান্সলেশনের মাধ্যমে তৈরি হয় বহু ধরনের প্রোটিন। সেসব প্রোটিন জীবদেহের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভূমিকা রাখে।

এই যে মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষে নিউক্লিয়াস থাকে, ডিএনএ-আরএনএ কিংবা রাইবোজোম থাকে, প্রোটিন তৈরি হয়—এই সামান্য ধারণা থেকে বোঝা যায় প্রতিটি কোষে কত ক্রিয়া–কৌশল হচ্ছে এবং প্রতিটি কোষ গঠনের দিক দিয়ে কত জটিল কিন্তু সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খলিত। অন্যদিকে ভাইরাসের দেহে শুধু ডিএনএ কিংবা আরএনএ থাকে। সেই ডিএনএ কিংবা আরএনএগুলো রেপ্লিকেইট করতে পারে না। ভাইরাসের দেহে রাইবোজোম নেই। তাই প্রোটিন তৈরির কাজও হয় না। একটা ভাইরাস থেকে অন্য একটা ভাইরাস তৈরি হতে গেলে আশ্রিত কোষের যে মেকানিজম সেটার সাহায্য নিতে হয়।

ভাইরাসের ছবিতে আমরা কতগুলো স্পাইক দেখি। এগুলো হলো প্রোটিন দিয়ে তৈরি। এই স্পাইকগুলো অনেকটা চাবির মতো কাজ করে। ভাইরাস চাইলেই আমাদের সব কোষের ভেতর প্রবেশ করতে পারে না। কারণ, কোষের বহিঃগঠনেরর সঙ্গে ম্যাচিং-মিসম্যাচিংয়ের কিছু বিষয় থাকে। আমাদের কোষের বাইরের স্তরে কিছু রিসেপ্টর থাকে। কোষের ধরন ভেদে এই রিসেপ্টেরগুলোর গঠন ভিন্ন হয়। ভাইরাসের দেহের (Capsid) স্পাইকগুলো যদি কোষের রিসেপ্টরের সঙ্গে ম্যাচ করে, তাহলেই কোষের ভেতর অনুপ্রবেশ সহজ হয়। কোষের ভেতর ভাইরাস ঢুকে গেলে ভাইরাসের ডিএনএ বা আরএনএ পুনঃ পুনঃ তৈরি হতে থাকে। কারণ, আমাদের কোষের ভেতর ডিএনএ রেপ্লিকেশনের যে মেকানিজম আছে, সেখানে ভাইরাসের ডিএনএ বা আরএনএ সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ভাইরাসের আরএনএ আমাদের কোষের রাইবোজোমের সঙ্গে মিলে ভাইরাসের দেহের প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি করতে থাকে। শুরুটা এভাবেই হয়। একটা ভাইরাস থেকে এক শ, হাজার, লাখ কিংবা কোটি ভাইরাস এভাবেই ক্রমান্বয়ে তৈরি হয় ও অসংখ্য কোষে প্রবেশ করে আমাদের কোষের স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত করে। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি।

আপনি সুস্থ থাকার অর্থ এই নয় যে আপনার শরীর ভাইরাস আক্রান্ত হচ্ছে না। প্রতিনিয়তই শরীরে অসংখ্য ভাইরাস প্রবেশ করে। শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার (Immune System) কারণে আমরা সেটা টের পাই না। ইমিউন সিস্টেম যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনই আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। শরীরের অ্যান্টিবডি নামক বস্তুগুলো প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো কাজ করে। যখনই শরীরে অপরিচিত কোনো অণুজীব (Microbe) ঢুকে পড়ে, অ্যান্টিবডিগুলো তখন সেসব অণুজীব ধ্বংসে উঠেপড়ে লাগে। দুর্ভাগ্যবশত শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ ব্যক্তি কিংবা গর্ভবতী নারী—তাঁদের শরীরে ইমিউন সিস্টেম যথারীতি দুর্বল থাকায় যেকোনো ভাইরাস আক্রান্তের সহজ লক্ষ্য হন তাঁরাই। ভাইরাসজনিত রোগ হলে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসে না। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক হলো ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের প্রতিষেধক। ভাইরাসজনিত রোগের জন্য অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ বা ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়।

সম্প্রতি চীন ও অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় সারা পৃথিবীতে হইচই লেগে গেছে। কিন্তু ভাইরাসের এই মহামারি নতুন নয়। এইডসের কথা মনে আছে? নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গিয়েছিল এইডস সচেতন পোস্টার। বিটিভি দেশের সব জনপ্রিয় শিল্পীদের জড়ো করে তাঁদের দিয়ে এইডস সচেতনতার গান তৈরি করল। নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেটের এত প্রতাপ ছিল না। তারপরও দুনিয়াব্যাপী হইচই পড়ে গিয়েছিল। সতর্কতা, সচেতনতা ও বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় এইচআইভি এখন নিয়ন্ত্রণে। বিশ্ব এইডস দিবসের কথা মানুষের আর তেমন মনে নেই। অথচ এই এইডস ভাইরাসের চেয়েও বহুগুণ প্রাণঘাতী ও প্রাণহরণকারী ভাইরাস VZV-জনিত রোগ হলো চিকেন পক্স। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যত মানুষ মারা গিয়েছে, তার চেয়ে বেশি মানুষ দুনিয়ায় মারা গিয়েছে চিকেন পক্সের কারণে। অথচ আপনি কি জানেন, দুনিয়া থেকে কোন রোগকে আমরা চিরতরে বিদায় করেছি?—চিকেন পক্স! WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) ১০ বছরের ‘টার্গেট জিরো’ প্রজেক্ট নিয়ে সারা দুনিয়া থেকে চিকেন পক্স বিতাড়িত করেছে। পৃথিবীর কোথাও এখন চিকেন পক্সে মানুষ মারা যায় না! আশার কথা হলো, মানুষের মেধা ও প্রচেষ্টা একের পর এক রোগকে জয় করতে সাহায্য করেছে। এটা অত্যুক্তি নয় যে করোনাভাইরাসও শিগগিরই নির্মূল হবে।

সচেতনতা ও প্রতিরোধ

বিভিন্ন ভাইরাস শরীরের বিভিন্ন অংশে আক্রমণ করে। যেমন সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস মানুষের শ্বাসতন্ত্রে আক্রমণ করে। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আমাদের যকৃতে (Liver) আক্রমণ করে। লিভারের কার্যক্রমকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়। কিছু কিছু ভাইরাসজনিত রোগ খুবই সংক্রামক (Contagious), অর্থাৎ সংস্পর্শ থেকেই ছড়িয়ে পড়ে। সেসব ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন বা অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ ছাড়াও মানুষের ব্যক্তিগত সচেতনতা ভাইরাস সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে সাহায্য করে। যেমন হেপাটাইটিস-বি–সংক্রমিত নয় কিন্তু ফ্লু, করোনা, নরোভাইরাস ইত্যাদি খুবই সংক্রামক। যেমন আপনি যদি ফ্লু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, তাহলে আপনি হাঁচি দিলে অসংখ্য ভাইরাস আপনার আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যরা নিশ্বাস নিলে তাদের শরীরে সেসব ভাইরাস প্রবেশ করে। তাই হাঁচি দেওয়ার সময় হাত কিংবা রুমাল মুখের সামনে ধরা উচিত। সংক্রামক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হলে ঘরে থাকা উচিত, এতে আপনার কাছ থেকে অন্যের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। ভাইরাসে আক্রান্ত সবারই যত্রতত্র মল-মূত্র ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ঘনঘন হাত ধোয়া উচিত এবং প্রচুর পানি পান করতেও পরামর্শ দেওয়া হয়।

যেসব ভাইরাসের টিকা (Vaccine) পাওয়া যায়, সময়মতো সেসব টিকা দেওয়া উচিত। তাহলে ভাইরাস আক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকে। যেমন হেপাটাইটিস-বি একটা ভাইরাসজনিত রোগ। এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন আছে। সুতরাং ভ্যাকসিন দেওয়া থাকলে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা অত্যন্ত কম।