সাক্ষাৎকার
‘আমি সব সময়ই কৌতূহলী ছিলাম, সর্বদাই কৌতূহলী থাকব’—পিয়ের আগোস্তিনি, নোবেলজয়ী পদার্থবিদ
২০২৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন পদার্থবিদ পিয়ের আগোস্তিনি, হাঙ্গেরীয় পদার্থবিদ ফেরেন্স ক্রাউজ ও ফ্রেঞ্চ পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান লিয়ের। পদার্থের ভেতরে ইলেকট্রনের শক্তি বিনিময় প্রক্রিয়া ও অ্যাটোসেকেন্ডের মতো ক্ষুদ্র সময়ে ইলেকট্রনের স্পন্দন শনাক্ত করেছেন তাঁরা। অর্থাৎ সময়ের অতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশে অতিপারমাণবিক জগতের আলো ধরেছেন, উন্মোচন করেছেন সেই ক্ষুদ্র জগতের রহস্য। সে জন্যই নোবেল পেয়েছেন এই তিন বিজ্ঞানী।
মার্কিন পদার্থবিদ পিয়ের আগোস্তিনি ১৯৪১ সালে ফরাসি শাসনাধীন তিউনিসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত আছেন এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে। নোবেল ফাউন্ডেশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা দিক। ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর সুইডেনের স্টকহোমে তিনি এ সাক্ষাৎকার দেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন জাহিদ হোসাইন খান।
প্রশ্ন: বিজ্ঞানের প্রতি আপনার আগ্রহ তৈরি হলো কীভাবে?
পিয়ের আগোস্তিনি: আমি মনে করি, গবেষণাই আমাকে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। এর আগে আমার বিজ্ঞানে তেমন আগ্রহ ছিল না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিশেষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আগে থেকে অনুমান করা যায় না, এমন বিষয় খোঁজাই আমার কাছে বিজ্ঞানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক বলে মনে হয়।
প্রশ্ন: আপনি কীভাবে কৌতূহল ধরে রাখেন?
পিয়ের আগোস্তিনি: বই পড়া ও চোখ-কান খোলা রাখার মাধ্যমে আমি কৌতুহল ধরে রাখি। কৌতূহল জিনিসটা এমনিতেই আমাদের ভেতরে থাকে। আমার ধারণা, আমি সব সময়ই কৌতূহলী ছিলাম, সর্বদাই কৌতূহলী থাকব।
প্রশ্ন: আপনাকে কি কেউ অনুপ্রাণিত করেছিল?
পিয়ের আগোস্তিনি: সম্ভবত (ক্লদ) কোহেন-তানুজি (১৯৯৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী ফরাসি পদার্থবিদ)। সত্তরের দশকে আমরা কলেজ দ্য ফ্রান্সে তাঁর বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম। তিনি সত্যিই আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি একই সঙ্গে খুবই খুঁতখুঁতে এবং একইসঙ্গে বেশ খোলা মনের মানুষ। একইসঙ্গে তাঁর এ গুণ দুটি আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করেছে।
প্রশ্ন: বিজ্ঞান কীভাবে মিথের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে?
পিয়ের আগোস্তিনি: সঠিক ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। আমি মনে করি এটা বেশ কঠিন কাজ, কিন্তু এটাই আসল কাজ।
প্রশ্ন: আপনি কীভাবে ব্যর্থতা মোকাবেলা করেন?
পিয়ের আগোস্তিনি: বারবার চেষ্টা করি। ব্যর্থতার যদি কোনো কারণ থাকে, তাহলে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। সেই কারণ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এরপর আবারও চেষ্টা করতে হবে, বারবার। আপনি হয়তো ভুল করেছেন, এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভুল করা খুব সহজ ও স্বাভাবিক। আমি বলব, আবার চেষ্টা করুন। প্রথমবারেই কাজ হয়, এমনটা বেশ বিরল। ১৯৭৯ সালে একবার আমার একটি পরীক্ষণ প্রথমবারেই কাজ করেছিল। তবে এমনটা সাধারণত হয় না। আমাদের বারবার চেষ্টা করতে হবে।
ব্যর্থতা একটা স্বাভাবিক বিষয়। সব সময় ঘটে। একজন পরীক্ষক হিসেবে বড়সড় ব্যর্থতার মুখে পড়া খুবই স্বাভাবিক।
প্রশ্ন: কেউ প্রচণ্ডভাবে ব্যর্থ হলো—এমন কোনো শিক্ষার্থীর উদ্দেশে কী বলবেন আপনি?
পিয়ের আগোস্তিনি: বড় ধরনের ব্যর্থতা? আচ্ছা, এটা আসলে একটা স্বাভাবিক বিষয়। সব সময় ঘটে। একজন পরীক্ষক হিসেবে বড়সড় ব্যর্থতার মুখে পড়া খুবই স্বাভাবিক। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কেন ব্যর্থ হচ্ছি, তা বোঝা। তারপর আবার চেষ্টা করা। অন্তত আমি তাই করি। বেশির ভাগ সময় খেয়াল করতে হয়তো দু-তিনটি জিনিস পাওয়া যায়, যেসব ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে। এগুলো একের পর এক ঠিক করতে থাকলে একসময় বিষয়টা কাজ করবে।
প্রশ্ন: আপনি কি কখনও ইম্পোস্টার সিনড্রোমে ভোগেন?
পিয়ের আগোস্তিনি: আমি অমনটা না ভাবার চেষ্টা করি। তবে মাঝে-মধ্যে এমন হয়। গত কয়েক বছর ধরে আমি অ্যাটোসেকেন্ড গবেষণা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। এই ক্ষেত্রে আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছি। এটা আমার জন্য আশাজনক। তবে এর আগে মাঝেমধ্যে আমার ওরকম বোধ হয়েছে। পেশাদার গবেষক হিসেবে আপনার সাধারণত যা যা করার কথা, আপনি সেগুলোই করবেন। সে হিসেবে এ ক্ষেত্রটাকে আমার নিজের ঘরের মতো আপন মনে হয়। তবে আপনি যদি ঠিক নিশ্চিত না হন যে কোন পরীক্ষাগুলো করতে হবে, বারবার চেষ্টা করছেন কিন্তু অত ভালো হচ্ছে না—তখন হয়তো মনে হতে পারে ‘আমি এখানে কী করছি’ বা ‘আমার এখানে থাকা উচিত না’। আমার মনে আছে, সত্তরের দশকে আমি লস অ্যাঞ্জেলেস গিয়েছিলাম পোস্ট-ডক গবেষণা বা এরকম কিছুর জন্য। তার আগে আমি এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলাম, যেগুলো খুব ভালোভাবে কাজ করছিল না। তখন মনে হয়েছিল, এসব সত্যিই আমার করা উচিত কি না। ভাগ্যক্রমে কালের আবর্তে সেই ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে।
প্রশ্ন: সবচেয়ে ভালো কী পরামর্শ পেয়েছেন জীবনে?
পিয়ের আগোস্তিনি: আপনি যা করছেন, সেটা যতদূর সম্ভব বোঝার চেষ্টা করুন। শুধু এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে থাকলে হবে না, পাশাপাশি তাত্ত্বিকভাবেও বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন।
আমি এমন অনেক মানুষকে চিনি, যাঁরা বিজ্ঞানী ও পদার্থবিদ হিসেবে দারুণ। তাঁদের এমন সব গুণাবলী আছে, যেগুলো আমার নেই।
প্রশ্ন: একজন সফল বিজ্ঞানীর কী কী গুণাবলী থাকা প্রয়োজন?
পিয়ের আগোস্তিনি: আমি এমন অনেক মানুষকে চিনি, যাঁরা বিজ্ঞানী ও পদার্থবিদ হিসেবে দারুণ। তাঁদের এমন সব গুণাবলী আছে, যেগুলো আমার নেই। আমস্টারডাম ও এফওএম ইনস্টিটিউটের আমার পুরাতন সহকর্মী হার্ম মুলারের কথা বলব। তাঁর অনেক বিস্ময়কর গুণ আছে। তাত্ত্বিক হিসেবে তিনি যেমন অসাধারণ, তেমনি ল্যাবেও দুর্দান্ত কাজ করেন। কেউ বিজ্ঞানী হতে চাইলে আমি তাঁকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করব।
প্রশ্ন: আপনার শ্রেষ্ঠ গুণ কোনটি?
পিয়ের আগোস্তিনি: এটা এককথায় বলা কঠিন। তবে আমি বলব, নিজের বিষয় সম্পর্কে যথাযথ ধারণা ও যেকোনো জিনিস সম্পর্কে সচেতন থাকার বিষয়টা একটা ভালো গুণ। আমার মনে আছে, একবার আমাদের ল্যাবে একটি গ্লাস সেটআপ ছিল। ল্যাবের ভেতরের বাতাস বিশুদ্ধ করতে সেখানে একটা নির্দিষ্ট গ্যাস উত্তপ্ত করতে হতো। একবার আমরা ওই গ্যাসে তাপ দিচ্ছিলাম। পরে সে কথা ভুলে গিয়ে চলে গেলাম দুপুরের খাবার খেতে। ফিরে এসে দেখলাম, সব গলে-টলে গেছে (তাপে)। ভয়ংকর ব্যাপার! আমি তো সেখানে ছিলাম, পুরো ব্যাপারটাই ছিল আমার দোষ। এটাকে সচেতন থাকা বলে না। তখন থেকেই আমি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন: অবসরে কী করেন?
পিয়ের আগোস্তিনি: এখন আমার কিছুটা অবসর সময় আছে। বেশির ভাগ সময়ই আমি পড়ি। আমার মূল আগ্রহ সাহিত্যে—মার্কিন সাহিত্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপন্যাস পড়া হয়। উদাহরণ হিসেবে লুইস গ্লুকের (২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী) কথা বলতে পারি।
সাহিত্যে এমন অনেক কিছু আছে, যা আমাকে ভালো মানুষ হতে সাহায্য করেছে।
প্রশ্ন: বই পড়া কি আপনাকে ভালো বিজ্ঞানী হতে সহায়তা করেছে?
পিয়ের আগোস্তিনি: সাহিত্যে এমন অনেক কিছু আছে, যা আমাকে ভালো মানুষ হতে সাহায্য করেছে। তবে আমি মনে করি না, বই পড়ার কারণে আমি ভালো বিজ্ঞানী হয়েছি।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলোর ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখা কি অপরিহার্য?
পিয়ের আগোস্তিনি: অবশ্যই। এটা তো দরকারি। এটা আপনি কখনো এড়াতে পারবেন না। গবেষণা নিয়ে পড়া তো আসলে কাজেরই অংশ।