৩০ বছর পর ক্রিপ্টোসের শেষ সূত্র প্রকাশ, রহস্যের জট খুলবে কি
দ্য দা ভিঞ্চি কোড। ড্যান ব্রাউনের বিখ্যাত উপন্যাস। এই বইয়ের প্রচ্ছদে লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত রহস্য। বইয়ের জ্যাকেটের পেছনের অংশে খুব হালকাভাবে কিছু অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ ছাপা ছিল। পাঠকরা যখন সেই সংকেত উদ্ধার করলেন, দেখা গেল ওটা কোনো কাল্পনিক গুপ্তধনের ঠিকানা নয়। ওটা সোজা গিয়ে ঠেকেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএয়ের সদর দপ্তরে!
সেখানে বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তামার তৈরি এক বিশাল বাঁকানো দেওয়াল। তাতে খোদাই করা হাজার হাজার অক্ষর। এর নাম ক্রিপ্টোস।
বিশ্বের তাবড় তাবড় গোয়েন্দা, গণিতবিদ আর হ্যাকাররা গত ৩০ বছর ধরে এই দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাচ্ছেন। কারণ, এই ভাস্কর্যের বুকে লুকিয়ে থাকা ধাঁধার সবটা আজও কেউ সমাধান করতে পারেনি। আর তাই, এই ধাঁধা সমাধান করার জন্য স্বয়ং এই ধাঁধার আবিষ্কারক ফাইনাল সূত্র দিয়েছেন। সে সম্পর্কে জানার আগে বুঝতে হবে, ক্রিপ্টোস আসলে কী? কেন ৩০ বছরে এই ধাঁধার সমাধান করা গেল না?
১৯৯০ সালে শিল্পী জিম স্যানবর্ন সিআইএয়ের সদর দপ্তরের জন্য এই ভাস্কর্যটি তৈরি করেন। এটি দেখতে অনেকটা এস (S) আকৃতির তামার পর্দার মতো। এতে মোট ৪টি আলাদা আলাদা ধাঁধা বা এনক্রিপটেড মেসেজ লুকানো আছে। অক্ষর আছে প্রায় ১ হাজার ৮০০টি।
ভাস্কর্যটি বসানোর পর প্রায় এক দশক কেউ এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি।
এটি তৈরি করার সময় শিল্পী স্যানবর্ন সিআইএর এক অবসরপ্রাপ্ত ক্রিপ্টোগ্রাফারের সাহায্য নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্বসেরা গোয়েন্দাদের বুদ্ধির পরীক্ষা নেওয়া। মোট চারটি ধাঁধা লুকানো আছে এতে। এর মধ্যে তিনটির সমাধান হয়ে গেছে আগেই। সেগুলো কী ছিল, তা শুরুতে জেনে নিই। তারপর যাওয়া যাবে চতুর্থ ধাঁধায়।
ভাস্কর্যটি বসানোর পর প্রায় এক দশক কেউ এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি। অবশেষে ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে সিআইএর নিজস্ব বিশ্লেষক ডেভিড স্টেইন এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানী জিম গিলোগলি পৃথকভাবে এর প্রথম তিনটি অংশের সমাধান করেন।
K1 বা প্রথম ধাঁধাটি ছিল একটি কাব্যিক লাইন। সমাধান করার পর যে লাইন পাওয়া যায়, তা হলো: Between subtle shading and the absence of light lies the nuance of iqlusion। খেয়াল করলে দেখবেন, এখানে ‘Illusion’ বানানটি ভুল করে ‘Iqlusion’ লেখা হয়েছে। এটা কিন্তু শিল্পীর অনিচ্ছাকৃত ভুল নয়, বরং কোড ব্রেকারদের বিভ্রান্ত করার কৌশল!
দ্বিতীয় ধাঁধাটি ছিল, মাটির নিচে কী আছে, তা নিয়ে। এই ধাঁধায় কিছু অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ দেওয়া ছিল। সমাধান করলে দাঁড়ায়: Does Langley know about this? They should: it's buried out there somewhere। ল্যাংলি হলো সিআইএর সদর দপ্তরের একটি জায়গার নাম। অর্থাৎ, শিল্পী ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সিআইএর সদর দপ্তরে মাটির নিচে কিছু একটা পোঁতা আছে!
তৃতীয় ধাঁধাটি ছিল বেশ নাটকীয়। তুতেনখামেনের সমাধি জড়িয়ে আছে এই ধাঁধায়। ১৯২২ সালে হাওয়ার্ড কার্টার যখন মিশরের ফারাও তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কার করেন, তখন তিনি ছোট্ট একটি ফুটো দিয়ে ভেতরে তাকিয়েছিলেন। তার সেই অভিজ্ঞতাই কোডে লেখা ছিল: Can you see anything Q।
এরপর আসে চতুর্থ ধাঁধা। এই ধাঁধা সমাধানের পেছনে ৩০ বছরের অপেক্ষা করেছে মানুষ, কিন্তু এখনো সমাধান হয়নি। মাত্র ৯৭টি অক্ষরের এই ছোট অংশটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোড-ব্রেকারদেরও হারিয়ে দিয়েছে।
শুধু কম্পিউটার দিয়ে চেষ্টা করলে এই ধাঁধা সমাধান হবে না, মাথাও খাটাতে হবে। অনেকে ভাবতে পারেন, সব কাজের কাজি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিলে কেমন হয়?
তবে শিল্পী জিম স্যানবর্ন, যার বয়স এখন ৭৯ বছর, তিনি সম্প্রতি কিছু নতুন ক্লু বা সূত্র প্রকাশ করেছেন। তিনি জানেন, তিনি হয়তো আর বেশিদিন সময় পাবেন না, তাই রহস্যের জট খুলতে সাহায্য করছেন।
কী সেই নতুন সূত্রগুলো? আগের ক্লুতে একটি শব্দ পাওয়া গিয়েছিল ‘BERLINCLOCK’। স্যানবর্ন নিশ্চিত করেছেন যে এটি বার্লিনের বিখ্যাত ‘ওয়ার্ল্ড ক্লক’ বা বিশ্বঘড়িকে বোঝাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই কোডের সমাধানের সঙ্গে ১৯৮৬ সালে শিল্পীর মিশর ভ্রমণের একটা যোগসূত্র আছে। তৃতীয়ত, ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলার ঘটনার সঙ্গেও আছে এর গভীর সম্পর্ক। আর সবশেষ, ক্রিপ্টোসের ভেতরের কোডগুলো আসলে বার্তা বা মেসেজ পৌঁছে দেওয়া সংক্রান্ত কিছু বোঝাচ্ছে।
তবে এটাই শেষ চমক নয়। সবাই যখন K4-কে নিয়ে ব্যস্ত, তখন স্যানবর্ন দিলেন আরেক চমক। তিনি জানিয়েছেন, K4 সমাধান করা হলেই আরেকটি ধাঁধা সামনে আসবে। অর্থাৎ, চতুর্থ ধাঁধার উত্তরই পঞ্চম ধাঁধা তৈরি করে দেবে। আর সেই ধাঁধার উত্তর লুকিয়ে আছে সিআইএর প্রাঙ্গণে মাটির নিচে কোথাও।
শিল্পী স্যানবর্ন নভেম্বরের শেষে এই চতুর্থ ধাঁধার সমাধানটি নিলামে বিক্রি করার ঘোষণা দিয়েছেন। হয়তো নিলামে যিনি জিতবেন, তিনিই বিশ্বের সামনে উন্মোচন করবেন ৩০ বছর ধরে লুকিয়ে থাকা এই রহস্য। অথবা তিনিও নিজের কাছে এই ধাঁধার উত্তর গোপনে লুকিয়ে রাখতে পারেন। মানুষকে সময় দিতে পারেন আরও মাথা খাটাতে।
একটা মজার ব্যাপার হলো, স্যানবর্নকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, K4 ধাঁধা সমাধান করতে কি গণিতের সাহায্য নিতে হবে? তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘কে বলল এটা গণিতের সমাধান? আমি নিজেই গণিত খুব ভালো বুঝি না। সেজন্যই তো আমি এই ধাঁধা বানাতে পেরেছি। এই ধাঁধা সমাধান করতে চাইলে গণিত নয়, সৃজনশীলতা দরকার।
অর্থাৎ, শুধু কম্পিউটার দিয়ে চেষ্টা করলে এই ধাঁধা সমাধান হবে না, মাথাও খাটাতে হবে। অনেকে ভাবতে পারেন, সব কাজের কাজি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিলে কেমন হয়? স্যানবর্ন জানিয়েছেন, এত বছরে অনেকেই তাকে চিঠি লিখেছেন দাবি করেছে, তারা কে-ফোর সমাধান করে ফেলেছেন। এত চিঠির উত্তর দেওয়া কঠিন। তাই তিনি একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই সিস্টেম বানিয়েছেন। এই সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব দাবি যাচাই করতে পারে। নিলামের বিজয়ীকে এই সিস্টেমটাও দিয়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, আপনি যখন এআইয়ের সাহায্যে এই ধাঁধা সমাধানের কথা ভাবছেন, তার আগেই এর মালিক এআই ব্যবহার করে ধাঁধার উত্তর যাচাই করছেন। তবে এআই যে এ ধাঁধা সমাধান করতে পারবে না, তেমনটিও বলেননি স্যানবর্ন। কিন্তু আপনারা চেষ্টা করে দেখতেই পারেন।
বুঝতেই পারছেন, ক্রিপ্টোস শুধু একটা ভাস্কর্য নয়, এটা একটা জীবন্ত রহস্য। দুনিয়ার সেরা কোড বিশেষজ্ঞ, গণিতবিদ এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা এই কোডের সমাধানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। কে জানে, হয়তো আপনাদের মধ্য থেকেই কেউ একদিন এই ধাঁধার সমাধান করবে!
