বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে পথচলা

বিজ্ঞানচিন্তার শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন ম্যাগাজিনটির সঙ্গে। এককালে ছিলেন সম্পাদনা দলের সদস্য। একাডেমিক টিমের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন আয়োজনে কাজ করছেন আজও। তাঁর কলমে বিজ্ঞানচিন্তার পথচলা...

শুরুর আগে

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। গণিত অলিম্পিয়াডের সমন্বয়ক জুয়েল ভাই (বায়েজিদ ভূঁইয়া জুয়েল) একদিন আমাদের বললেন, ‘তোমাদের কিশোর আলোর একজন খুঁজছে কথা বলার জন্য। সময় করে একদিন আমার সঙ্গে চলো।’ আমরা মানে, ইবরাহিম মুদ্দাসসের, জুনায়িদুল ইসলাম ও আমি। আমরা তখন কাজ করি বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি এসপিএসবিতে। স্কুলে স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের বিজ্ঞানের বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করে দেখাই, দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীদের নিয়ে বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন পাবলিক লেকচার আর স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সায়েন্স ক্যাম্প আয়োজন করি। এসবের পাশাপাশি এসপিএসবি আরও বেশ কিছু বড় আয়োজনও করত। যেমন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস। মূলত হাইস্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোরদের জন্য একটা বৈজ্ঞানিক কনফারেন্স ছিল সেটা। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় দল নির্বাচনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড (বিডিজেএসও) আয়োজন করত। প্রথম আলোর সঙ্গেও আগের বছর; অর্থাৎ ২০১৫ সালে বিজ্ঞান জয়োৎসবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। সিটি ব্যাংক-প্রথম আলো বিজ্ঞান জয়োৎসব নামের ওই আয়োজনে ১৫টি আঞ্চলিক ও জাতীয় উৎসব হয়েছিল, সারা দেশ থেকে অংশ নিয়েছিল হাজারো শিক্ষার্থী। দেশজুড়ে এ রকম নানা আয়োজনের মাধ্যমে সায়েন্স আউটরিচ নিয়ে কাজ করার কিছু অভিজ্ঞতা তত দিনে আমাদের হয়েছে। আমরা সায়েন্সের মানুষ, কিশোর আলোর একজন কেন আমাদের খুঁজবেন? সেটা জিজ্ঞাসা করার পর জুয়েল ভাই বললেন, ‘আরে গিয়ে তো আগে কথা বলো! কথা বললেই বুঝতে পারবে।’

বিজ্ঞান উৎসবে হাত তুলে প্রশ্ন করছে এক শিক্ষার্থী

কিশোর আলোর যিনি আমাদের খুঁজছিলেন, তিনি কিশোর আলোর তৎকালীন সহকারী সম্পাদক আবুল বাসার। কিশোর আলোর অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তবে বাসার ভাইকে আমি একদমই চিনতাম না। হ্যাংলা–পাতলা লম্বাটে গড়নের একজন মানুষ, মাথায় কাঁচা–পাকা চুল, একটু গম্ভীর। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়েছিল। এর আগে কিশোর আলোর মাসিক মিটিংয়ে এসপিএসবি থেকে আমরা আলো নিয়ে অনেকগুলো মজার এক্সপেরিমেন্ট দেখিয়েছিলাম। সেখানেও বাসার ভাইকে দেখিনি। সে জন্য কিশোর আলো অফিসে গিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলাম।

পাঠকের মুখোমুখি বিজ্ঞানচিন্তা

বাসার ভাই নিজেই কথা শুরু করলেন। বললেন, ‘প্রথম আলো থেকে বিজ্ঞানবিষয়ক একটা নতুন মাসিক ম্যাগাজিন বের করার কাজ চলছে। মুনির ভাইয়ের (মুনির হাসান, প্রধান সমন্বয়ক, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কর্মসূচি, প্রথম আলো) সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, উনি আপনাদের সঙ্গে আলাপ করতে বলেছেন।’ মুনির হাসান এসপিএসবির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বুঝলাম, তিনিই বাসার ভাইকে আমাদের কথা জানিয়েছেন। বাসার ভাই বললেন, ‘আপনাদের যদি ভালো লাগে, তাহলে আপনারা এখানে নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করতে পারেন। পাশাপাশি সম্পাদনার কাজও করতে হবে। পত্রিকার নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি পুরোপুরি। কিন্তু আগামী মাসেই যেহেতু পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটা বের করার ইচ্ছা আমাদের, সে জন্য এই মাস থেকেই পুরোদমে কাজ শুরু করতে হবে।’

জানা গেল, প্রতি মাসের ১৫ তারিখে পত্রিকাটা বের হবে। ইবরাহিম ও আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম আসলে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। বাংলাদেশে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ রঙিন বিজ্ঞান ম্যাগাজিন বের হবে, এটা আমাদের অনেক দিনের চাওয়া। আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন সায়েন্স ওয়ার্ল্ড নামে একটা বিজ্ঞান ম্যাগাজিন বের হতো। প্রতি মাসেই টিফিনের টাকা জমিয়ে আমি ম্যাগাজিনটা কিনতাম। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির নতুন সব খবর আর ফিচার পাওয়া যেত ম্যাগাজিনটায়। একদিন স্কুল শেষে লাইব্রেরিতে ম্যাগাজিনটা কিনতে গিয়ে যখন শুনলাম সেটা বন্ধ হয়ে গেছে, তখন কী যে দুঃখ পেয়েছিলাম! কাজেই প্রথম আলো একটা বিজ্ঞান ম্যাগাজিন বের করছে এবং আমরা সেখানে কাজ করতে পারব—আমার কাছে মনে হচ্ছিল, ইটস আ ড্রিম কামিং ট্রু!

বিজ্ঞানচিন্তার স্টলে খেলতে খেলতে বিজ্ঞান শেখা

কাজেই বাসার ভাই যখন আমাদের অনেকগুলো লেখা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনাদের এই লেখাগুলো পড়ে দেখতে হবে, ঠিকঠাক আছে কি না।’ তখন আমার ভয় লাগার পরিবর্তে কী যে আনন্দ হচ্ছিল, সেটা বলার মতো নয়। বড় হয়ে গেছি দেখে ইয়াহু বলে চিৎকার করতে পারলাম না। শুধু বললাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ ভেতরে–ভেতরে যে ভীষণ উত্তেজনা কাজ করছিল, তা বলাই বাহুল্য!

হকিংকে নিয়ে প্রথম সংখ্যা

বিজ্ঞানচিন্তার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ

কিছুদিন পর জানা গেল, নতুন পত্রিকাটার নাম ঠিক করা হয়েছে বিজ্ঞানচিন্তা। ‘বিজ্ঞান’ ও ‘চিন্তা’ শব্দ দুটি একসঙ্গে নাকি আলাদা লেখা হবে, সেটা নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল; পরে একসঙ্গেই রাখা হলো। আমাদের কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের জীবন ও কাজ নিয়ে প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ রচনা করার সিদ্ধান্ত হলো। হকিং ছিলেন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম সেরা তাত্ত্বিক গবেষক। ব্ল্যাকহোল, মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং কোয়ান্টাম মেকানিকস নিয়ে যুগান্তকারী সব গবেষণা করেছেন তিনি। হকিং রেডিয়েশন, সিঙ্গুলারিটি থিওরেম, ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশন প্যারাডক্সের মতো কাজের জন্য যেমন বৈজ্ঞানিক মহলে সম্মান ও খ্যাতি অর্জন করেছেন, তেমনি পদার্থবিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলো সহজভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য তিনি বেশ কিছু বই লিখে অসম্ভব জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম, দ্য ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল, দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন-এর মতো বইগুলো তত দিনে বেশ পাঠকপ্রিয়। ব্ল্যাকহোল, রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিকস, সময়ের প্রবাহ, মহাবিশ্বের প্রকৃতি, মাল্টিভার্স, সুপারসিমেট্রি ও সুপারস্ট্রিং থিওরির মতো কঠিন সব বিষয় এসব বইয়ের পাতায় তুলে এনেছিলেন হকিং, সাধারণ পাঠকদের জন্য। সায়েন্স আউটরিচের দিক থেকে বিবেচনা করলে হকিং ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে জনপ্রিয় আউটরিচ অ্যাকটিভিস্টদের একজন। বিজ্ঞানচিন্তার মতো একটা জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ রচনা হিসেবে সে সময়ে সম্ভবত এর চেয়ে ভালো কোনো বিষয় হতে পারত না।

হকিং ছাড়াও এ সংখ্যায় আরও বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং বিষয় নিয়ে লেখা ছাপিয়েছিলাম আমরা। জামিলুর রেজা চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। এ সংখ্যায় আরও লিখেছিলেন মোহাম্মদ কায়কোবাদ, দীপেন ভট্টাচার্য, আহসান হাবীব, রেজাউর রহমান, দ্বিজেন শর্মা, রেজা খান, শিবব্রত বর্মন ও আসিফের মতো লেখকেরা। কামরুল হাসান ও আমি লিখেছিলাম পিনহোল ক্যামেরা হাতে–কলমে বানিয়ে দেখার একটা প্রজেক্ট নিয়ে।

এক্সপেরিমেন্ট আর এক্সপেরিমেন্ট

আমি যেহেতু স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট দেখাই, প্রথম সংখ্যায় পিনহোল ক্যামেরার ওই লেখাটা লেখার পর বাসার ভাই বললেন, সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে বিজ্ঞানচিন্তায় নিয়মিত লেখা যায় কি না। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের একটা বড় অংশ যেহেতু স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে নিয়মিত লেখা পেলে তাদের ভালো লাগবে। কিন্তু সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট হাতে–কলমে দেখানো যত সহজ, সেটা নিয়ে লেখা আসলে তত সহজ নয়। আমি বললাম, ‘ভেবে দেখি।’

কামরুলের সঙ্গে কথা বললাম। এসপিএসবিতে আমরা শিক্ষার্থীদের যেসব এক্সপেরিমেন্ট দেখাতাম, সেসব এক্সপেরিমেন্টের অনেক যন্ত্রপাতিই ছিল কামরুলের বানানো। আমরা যদি প্রতি মাসে নিয়মিত বিজ্ঞানচিন্তায় এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে লেখালেখি করি, তাহলে নতুন করে আরও অনেক কিছু হাতে–কলমে বানাতে হবে, সেসবের ছবি তুলতে হবে, ইলাস্ট্রেশন তৈরি করতে হবে, তারপর সেসব নিয়ে লিখতে হবে। কাজ নেহাত কম নয়। অনেক খাটাখাটুনির ব্যাপার। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে কামরুল এককথায় রাজি হয়ে গেল।

নিজের হাতে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে যত মজা, এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করা ততই কঠিন। যেহেতু বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে পড়া শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে এই এক্সপেরিমেন্টগুলো ডিজাইন করতে হয়েছিল, তাই সবার আগে মাথায় রাখতে হয়েছে যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা। বাংলাদেশের ছোট শহরগুলোতে কিংবা মফস্‌সলে চাইলেই হাতের কাছে এসব জিনিস পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানচিন্তার পাতায় একটা এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে পড়ে একটা ছেলে বা মেয়ে যখন নিজে এই এক্সপেরিমেন্টগুলো করে দেখতে চাইবে, তখন যাতে সে সহজেই প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি হাতের কাছে পায়, সে কথা মাথায় রেখে আমাদের এগুলো ডিজাইন ও মডিফাই করতে হয়েছিল।

হাইগ্রোমিটার, হোমোপোলার মোটর, আলোর প্রতিফলন-প্রতিসরণ-বিচ্ছুরণ, পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন, ভরকেন্দ্র, ঘনত্ব, সেন্ট্রিপেটাল ফোর্স, ক্যাপিলারি অ্যাকশন, স্পিকার, প্রজেক্টর, পিনহোল ক্যামেরা, সানডায়াল—এমন নানান বিষয়ে সায়েন্স প্রজেক্ট করেছিলাম আমরা। এসব প্রজেক্টের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ঢাকা শহরের কত কত জায়গায় যে যেতে হয়েছে! কার্ডবোর্ডের জন্য হয়তো কারওয়ান বাজার, নিওডিমিয়াম চুম্বক বা ম্যাগনেট ওয়্যারের জন্য স্টেডিয়াম মার্কেট, লেজার কাটিংয়ের জন্য কাঁটাবন মার্কেট কিংবা ঘড়ির কয়েন ব্যাটারির জন্য পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী—কম দৌড়াদৌড়ি করতে হয়নি। অনেক সময়ই আমার যাওয়ার সময় বা সুযোগ হতো না, তখন কামরুলকে একাই এসব জিনিস খুঁজে বের করতে হতো। প্রয়োজনীয় সবকিছু সংগ্রহ করার পর আমরা এক্সপেরিমেন্টগুলো বেশ কয়েকবার করে দেখতাম। মূলত যাচাই করে দেখতাম, পুরো ব্যাপারটা রিপ্রডিউসেবল কি না। সায়েন্সে এই ব্যাপারটা বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। একটা এক্সপেরিমেন্ট যদি ভিন্ন কেউ ভিন্ন কোনো জায়গায় একই ক্রাইটেরিয়া ব্যবহার করে করার পর একই ফলাফল না পায়, তাহলে সেটাকে সায়েন্টিফিক ট্রুথ বা বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এই ব্যাপারটা আমাদের মাথায় ছিল। তা ছাড়া যারা এক্সপেরিমেন্টগুলো নিজেরা করে দেখবে, তারা যদি ইনস্ট্রাকশন পড়ে নিজেরা হাতে–কলমে পুরো জিনিসটা ঠিকমতো করতে না পারে, তাহলে তো লাভ নেই।

এক্সপেরিমেন্টগুলো করার সময়েই ছবি তুলতে হতো। বিজ্ঞানচিন্তায় ছাপা হওয়া বেশির ভাগ এক্সপেরিমেন্টই আমরা করেছি বিজ্ঞানচিন্তা কার্যালয়ে। পাশে ছোট একটা রুম ছিল, কখনো সেখানে করা হতো, কখনো মিটিং রুমে। বেশির ভাগ সময়েই খালেদ ভাই (খালেদ সরকার, প্রথম আলোর ফটোগ্রাফি বিভাগের ইনচার্জ) এসে আমাদের এক্সপেরিমেন্টের ছবি তুলে দিতেন। লেখা নিয়ে বসা হতো সবার শেষে।

সম্পাদনা দল

বিজ্ঞানচিন্তার যাত্রা শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর ইবরাহিম মুদ্দাসসের ও আমি আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পাদনা দলের সদস্য হিসেবে যোগ দিই। প্রায় আট মাস পর সহসম্পাদক হিসেবে যোগ দেন আবদুল গাফফার। এ ছাড়া বিশেষ সহযোগী হিসেবে ছিলেন রাজীব ভাই (প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক রাজীব হাসান)। প্রদায়কের ভূমিকা ছেড়ে সম্পাদনা দলে যোগ দিলেও তাতে অবশ্য আমাদের কাজের ধরনে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। বিজ্ঞানচিন্তায় পাঠকেরা যেমন লেখা পাঠাতেন, তেমনি আমরাও বিজ্ঞান লেখক ও লিখতে আগ্রহী, এমন অনেকের কাছে লেখা চাইতাম। সবার লেখাই ছাপা হতো। এসব লেখা সম্পাদনা, ফ্যাক্টচেক করা, প্রয়োজনীয় সংশোধনী দেওয়া—এসবই মূল কাজ ছিল। আমাদের কাজের পুরোটা সময়েই সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম ও নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার দিকনির্দেশনা দিতেন। আলাদা করে প্রতিটা লেখা তো পড়ে দেখতেনই, পত্রিকার মেকআপের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আব্দুল কাইয়ুম পুরো ম্যাগাজিনটা আবার পড়ে দেখতেন। অনেক সময় দেখা যেত, তাঁর নিজের লেখার বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মতামত জানতে চাইছেন। এটা একটা অভূতপূর্ব ব্যাপার সম্ভবত—একজন সম্পাদকের লেখার ব্যাপারে আমরা যে রকম স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পেরেছি, এই সুযোগ যে পাওয়া যাবে, এটা আমি কখনো ভাবিনি।

দীপেন ভট্টাচার্য লেকচার দিচ্ছেন

বিজ্ঞানচিন্তা প্রকাশিত হতো প্রতি মাসের ১৫ তারিখে। এর বেশ কয়েক দিন আগেই ছাপার জন্য আমাদের প্রেসে পত্রিকা পাঠিয়ে দিতে হতো। দেখা যেত, মাসের প্রথম ১০ দিন এ জন্য বেশ ব্যস্ততা যাচ্ছে সবারই। অনেক লেখা একসঙ্গে সম্পাদনা করতে হচ্ছে, সেসব লেখা আবার মেকআপে (সফটওয়্যারে ম্যাগাজিনের লেখাগুলো সাজানো) পাঠানো হচ্ছে, এর মধ্যে আবার নতুন সব বিজ্ঞাপন আসছে, কেউ কেউ আবার লেখা দিতে দেরি করছে, তাদের তাগাদা দিতে হচ্ছে—সব মিলিয়ে ব্যস্ততার শেষ নেই। প্রেসে পাঠানোর জন্য ম্যাগাজিন ছেড়ে দেওয়ার পরই কেবল এই ব্যস্ততা থেকে মুক্তি মিলত। এরপর আবার নতুন সংখ্যার প্রস্তুতি শুরু!

ক্যাসিনি আর ডাইনোসরের গল্প

বিজ্ঞানচিন্তায় আমরা যেমন চিরায়ত বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রচ্ছদ রচনা করেছি, তেমনি সাম্প্রতিক অনেক বিষয়ও প্রচ্ছদে তুলে আনতে চেষ্টা করেছি। বেশ কিছু সংখ্যার প্রচ্ছদ রচনা সে সময় আমার লেখার সুযোগ হয়েছিল। এর মধ্যে পছন্দের দুটি সংখ্যার কথা এখানে বলি।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যার প্রচ্ছদ রচনা করা হয়েছিল ক্যাসিনি মহাকাশযানের গ্র্যান্ড ফিনালে নিয়ে। দুই দশকের এক রোমাঞ্চকর যাত্রা শেষ করে নাসার মহাকাশযান ক্যাসিনি ওই মাসের ১৫ তারিখে শনির বুকে ঝাঁপ দিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে উৎক্ষেপণের পর ক্যাসিনি শনি গ্রহে পৌঁছায় ২০০৪ সালে। সঙ্গে করে ক্যাসিনি ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইসা) যে হাইগেন্স প্রোবটিকে নিয়ে গিয়েছিল, সেটি পরের বছর ক্যাসিনি থেকে আলাদা হয়ে শনির সবচেয়ে বড় চাঁদ টাইটানে অবতরণ করে। ক্যাসিনি মিশনটি প্রাথমিকভাবে ২০০৮ সালেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুই দফায় মিশনটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ফলে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ক্যাসিনি আমাদের শনি, তার বলয় আর উপগ্রহগুলো নিয়ে বিচিত্র সব তথ্য পাঠিয়ে যেতে পেরেছে। শনির বুকে ক্যাসিনির ঝাঁপ দেওয়াটাও ছিল পরিকল্পনা করে। জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে ক্যাসিনি যাতে শনির উপগ্রহ টাইটান কিংবা এনসেলাডাসে গিয়ে কোনোভাবে পড়তে না পারে, সে জন্য বিজ্ঞানীরা ক্যাসিনির কক্ষপথ এমনভাবে নির্ধারণ করেন, যাতে এটি শেষ পর্যন্ত শনির বায়ুমণ্ডলে গিয়ে প্রবেশ করে। এই ক্যাসিনি মিশন থেকেই বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন, টাইটান ও এনসেলাডাসে অণুজীবের মতো প্রাণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। বিজ্ঞানীরা ক্যাসিনির মাধ্যমেই জানতে পেরেছেন টাইটানের মিথেনের লেক, নদী আর সাগরের কথা, এনসেলাডাসের বুকে উষ্ণ প্রস্রবণের কথা, তার পৃষ্ঠের নিচে তরল পানির সাগরের কথা, শনির নতুন সব চাঁদের কথা, শনির বুকে বিশালাকারের ঝড়ের কথা, শনির বলয় আর তার বায়ুমণ্ডলের মধ্যকার এক অসাধারণ এলাকার কথা। ক্যাসিনির পাঠানো প্রায় ৬৫০ গিগাবাইট ছবি আর তথ্য ব্যবহার করে ৪ হাজারের বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর ক্যাসিনি যাতে মহাকর্ষের টানে, অথবা অন্য কোনোভাবে এই উপগ্রহগুলোতে আছড়ে পড়তে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা সে জন্য জরুরি ছিল।

ক্যাসিনি শনির বায়ুমণ্ডলে ঝাঁপ দিয়েছিল বিজ্ঞানচিন্তা প্রকাশিত হওয়ার দিন, মানে ১৫ সেপ্টেম্বর। কিন্তু প্রচ্ছদ রচনার লেখাটা আমাকে লিখে ফেলতে হয়েছিল সপ্তাহখানেক আগেই। বাসার ভাই তাড়া দিয়ে যাচ্ছিলেন। ক্যাসিনি কিন্তু তখনো শনির বায়ুমণ্ডল আর বলয়ের মাঝের জায়গা দিয়ে শনি গ্রহকে প্রদক্ষিণ করে যাচ্ছে। আমি তখনো জানতাম না, কেউই জানত না—ক্যাসিনি আসলে ১৫ তারিখেই শনির বুকে ঝাঁপ দিতে পারবে কি না, তার ২০ বছরের এই জার্নি সেদিনই শেষ হবে কি না। কিন্তু পত্রিকায় কাজ করার বিষয়টাই আসলে এমন, কখনো এক দিন আগে, কখনো এক সপ্তাহ আগে একটা লেখা ছাপানোর জন্য পাঠিয়ে দিতে হয়। আমিও দিলাম। শেষ পর্যন্ত ক্যাসিনি অবশ্য ঠিক সময়েই শনির বুকে ঝাঁপ দিয়েছিল। বাংলাদেশে তখন ঘড়িতে বিকেল ৫টা ৫৫।

একই রকম ইমোশনাল স্টোরি না হলেও বিজ্ঞানচিন্তার আরও একটি সংখ্যা করতে গিয়ে আমাদের বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছিল। ‘ডাইনোসরের পৃথিবী’ শিরোনামে সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালের আগস্টে। আমি যেহেতু পড়াশোনা করেছি তড়িৎ প্রকৌশলে, সিনেমা আর পপ সায়েন্সের বাইরে ডাইনোসর নিয়ে আমার খুব বেশি জানাশোনা ছিল না। আগ্রহ অবশ্য সব সময়ই ছিল। ডাইনোসর নিয়ে একটা সংখ্যা সাজাতে গিয়ে সে জন্য প্রথমবারের মতো বিস্তারিত পড়াশোনা করতে হলো। রিসার্চ পেপার, একাডেমিক বই, লেকচার, ম্যাগাজিন—নানান সূত্র থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসর, তাদের শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য, খাবারদাবার, বাসস্থান—এসব বিষয় নিয়ে জানার চেষ্টা করেছিলাম। সংখ্যাটায় বিভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসরের ছবি ও বর্ণনা, ইনফোগ্রাফিক, ফসিল রেকর্ড, আধুনিক পাখিদের উৎপত্তি ও বিবর্তন, জুরাসিক পার্ক–এর মতো সিনেমাগুলোতে দেখানো ডাইনোসরের সঙ্গে বাস্তবের ডাইনোসরের পার্থক্য—এমন মজার সব বিষয় নিয়ে লেখা ছাপা হয়েছিল। আমার মনে আছে, প্রথম আলোর সিনিয়র ডিজাইনার মাহ্‌বুব রহমান এই সংখ্যার ইলাস্ট্রেশন, ইনফোগ্রাফিক ও ডিজাইন নিয়ে অনেক সময় ও যত্ন নিয়ে কাজ করেছিলেন। খাটাখাটুনি গেলেও সংখ্যাটা করে ভালো লেগেছিল অনেক—সম্ভবত ডাইনোসরের মতো সবার আগ্রহের একটা বিষয় নিয়ে বিস্তারিত ছাপাতে পেরে।

পাঠকের সঙ্গে বিজ্ঞানচিন্তা

বিজ্ঞানচিন্তার স্টলে পাঠকেরা

বিজ্ঞানচিন্তার একদম শুরু থেকেই আমাদের ভেতরে একটা চিন্তা ছিল, কীভাবে পাঠককে সম্পৃক্ত করা যায়। ইবরাহিম ও আমি এই ব্যাপারে বাসার ভাইয়ের সঙ্গে অনেকবারই আলাপ-আলোচনা করেছি। আমরা ঠিক করলাম, প্রতি মাসে বিজ্ঞানচিন্তা প্রকাশিত হওয়ার সপ্তাহখানেক পর আমরা পাঠকদের নিয়ে একটা আয়োজন করব। সেখানে আমরা বর্তমান সংখ্যা নিয়ে পাঠকের মতামত শুনব, তাঁদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলব। ফিডব্যাক পাওয়ার জন্য এটা একটা ভালো উপায় বলে আমাদের মনে হয়েছিল।

২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ‘পাঠকের সঙ্গে বিজ্ঞানচিন্তা’ নামে এই মাসিক আয়োজন শুরু হয়। প্রথম পর্ব থেকেই আমরা অভাবনীয় সাড়া পাই। পাঠকেরা বিজ্ঞানচিন্তা কার্যালয়ে এসেছেন, তাঁদের মতামত দিয়েছেন, আমাদের প্রশ্ন করেছেন। আমরাও তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, বিজ্ঞানচিন্তা নিয়ে তাঁদের ভালো লাগা, মন্দ লাগার ব্যাপারে শুনেছি।

পাঠকের সঙ্গে বিজ্ঞানচিন্তার প্রায় সব পর্বেই এক বা একাধিক আমন্ত্রিত অতিথি থাকতেন। তাঁরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোনো একটি বিষয় কিংবা তাঁদের কাজের ক্ষেত্র নিয়ে পাঠকের সামনে আলোচনা করতেন। এর বাইরে বিজ্ঞানচিন্তার একদম শুরু থেকেই আমরা বেশ কিছু পাবলিক লেকচার আয়োজন করা শুরু করি। এসব আয়োজনে বক্তা হিসেবে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক ড. এহসান হক (বর্তমানে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা মন্ত্রাণালয়ের উদ্ভাবন বিভাগের প্রধান), ধানগবেষক ও জিনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আরশাদ মোমেন, জ্যোতিঃপদার্থবিদ ড. দীপেন ভট্টাচার্য, ওরাকল করপোরেশনের সিনিয়র প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার ড. কাজী ইফফাত হক। এসব আয়োজনে আমরা পাঠক ও দর্শকের অভাবনীয় সাড়া পেয়েছিলাম।

এ ছাড়া ২০১৭ সাল থেকেই আমরা বিজ্ঞানচিন্তার নোবেল লেকচার শুরু করি। বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সাড়াজাগানো আবিষ্কারগুলোর জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এসব আবিষ্কার ও উদ্ভাবন নিয়ে সাধারণ মানুষ ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যাতে জানতে ও বুঝতে পারেন, এই উদ্দেশ্যে নোবেল লেকচারটি আয়োজন করা হয়। প্রতিবছর ডিসেম্বরে যখন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় বিজয়ীদের হাতে, এই লেকচার তখন অনুষ্ঠিত হয়।

বিজ্ঞান উৎসব

বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের একটা বড় অংশই যেহেতু হাইস্কুলে পড়ে, তাদের কথা মাথায় রেখে ২০১৯ থেকে শুরু হয় সিটি ব্যাংক-বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান উৎসব। শিক্ষার্থীরা সায়েন্স প্রজেক্ট ও কুইজ—দুটি বিষয়ে এ আয়োজনে অংশ নিতে পারে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক উৎসব আয়োজনের পর আঞ্চলিক উৎসবের বিজয়ীদের নিয়ে জাতীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞান উৎসবের সর্বশেষ আয়োজনটি হয়েছে ২০২৩ সালে। শিগগিরই সম্ভবত পরবর্তী আয়োজনটি হবে।

বিজ্ঞান উৎসবে বিজ্ঞান প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে শিক্ষার্থীরা

বিজ্ঞানচিন্তার একাডেমিক দলের অংশ হিসেবে বিজ্ঞান উৎসবের আঞ্চলিক আয়োজনগুলোতে যখন গিয়েছি, তখন কী যে ভালো লেগেছে! ভোরে অনেক শীতের মধ্যেই ছোট ছোট বাচ্চারা সায়েন্স করতে চলে আসছে, কেউ সঙ্গে করে প্রজেক্ট নিয়ে, কেউ কুইজে অংশ নিতে, কেউ ঘুরে ঘুরে প্রজেক্ট দেখতে কিংবা প্রশ্ন করতে। আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত (এখনো লাগে) বিজ্ঞান উৎসবের প্রশ্নোত্তর পর্ব। আমরা যখন ছোট ছিলাম, স্কুলে পড়তাম, তখন সায়েন্স নিয়ে যেসব প্রশ্ন মাথায় গুঁতাগুঁতি করত, চাইলেও সেসব প্রশ্নের বেশির ভাগই ক্লাসে করা যেত না। এসব ‘কিম্ভূত’ প্রশ্ন শুনে যে ক্লাসের সবাই হাসাহাসি করবে না, কিংবা ক্লাসে টিচার একটা রামধমক দিয়ে বসিয়ে দেবেন না, সেটার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। কাজেই তরঙ্গ হয়েও আলো কীভাবে কোনো মাধ্যম ছাড়াই কোটি কোটি কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ফেলতে পারে কিংবা আমরা নিশ্বাসের সঙ্গে এত নাইট্রোজেন বুকের ভেতরে টেনে নিয়ে আসলে করিটা কী—আমার পেটের ভেতরে এসব প্রশ্ন যতই কুটকুট করুক না কেন, ক্লাসে এসব প্রশ্ন করার খুব একটা উপায় ছিল না।

বিজ্ঞান উৎসবের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় উৎসবে এ জন্য যে প্রশ্নোত্তর পর্বগুলো ছিল, সেখানে আমরা সবাইকে মন খুলে প্রশ্ন করতে বলেছি। মঞ্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ছিলেন, বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা ছিলেন; তাঁরা শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। অনেকে কাগজে লিখে যেমন প্রশ্ন পাঠিয়েছে, তেমনি হাত তুলেও প্রশ্ন করেছে। শিক্ষার্থীরা কোনো রকম ভয় পাওয়া ছাড়া বিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করছে, সেসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন শিক্ষকেরা, কেউ তাদের বকা দিচ্ছেন না, এমন একটা ব্যাপারই তো আমরা সব সময় চেয়েছিলাম! মঞ্চে আমরা শিক্ষার্থীদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম না। সে জন্য প্রতিবার বিজ্ঞান উৎসবের পর আমরা একটা করে প্রশ্নসংখ্যা করেছি। শিক্ষার্থীরা কাগজে লিখে যেসব প্রশ্ন পাঠিয়েছে, আমরা তার যথাসম্ভব উত্তর দিতে চেয়েছি।

এর পাশাপাশি যারা অনেক সময়, মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে প্রজেক্টগুলো বানিয়েছে, কোনো একটা সমস্যা সমাধানের নতুন কোনো একটা উপায় বের করেছে, তাদের প্রজেক্টগুলো ঘুরে দেখাও একটা আনন্দের ব্যাপার ছিল। শেষে কারা পুরস্কার পাচ্ছে, এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল এটা যে বিজ্ঞান উৎসবে আমরা শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবন আর চিন্তার বৈচিত্র্য দেখতে পেয়েছি।

এই যাত্রা আনন্দের

পাই দিবসে পাঠকদের নিয়ে বিজ্ঞানচিন্তার আয়োজন

বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে পথচলার পুরো অভিজ্ঞতাটাই আসলে এমন হাজারো গল্প দিয়ে ভরা। এসব গল্পের অল্প কিছুই কেবল এখানে বলা গেছে। এই যেমন শুরুতে যে বলেছিলাম, বাসার ভাইকে দেখে আমার গম্ভীর একজন বলে মনে হয়েছিল, সেটা যে কত বড় ভুল একটা ধারণা, তা পরে বুঝতে পেরেছিলাম। বিজ্ঞানচিন্তার অসাধারণ স্বেচ্ছাসেবকেরা, যাঁরা কিনা পেছনে থেকে কাজ করে প্রতিটা আয়োজনকে সম্ভব করে তোলেন, তাঁদের নিয়েও যে কত কত গল্প আছে! বিজ্ঞানচিন্তার একাডেমিক দলের সদস্যরা, যাঁরা বাংলাদেশের এমাথা থেকে ওমাথা দৌড়ে বেরিয়েছেন, প্রশ্ন করেছেন, খাতা দেখেছেন, প্রজেক্ট জাজমেন্ট করেছেন, ফলাফল তৈরি করেছেন—তাঁদের কথাই-বা কীভাবে ভুলি!

বিজ্ঞানচিন্তার প্রায় ৯ বছরের এই যে যাত্রা, বিজ্ঞানচিন্তার ১০০তম সংখ্যা যে বের হলো, এই যাত্রায় এমন অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক, লেখক ও পাঠক জড়িয়ে আছেন আমাদের সঙ্গে। আমরা যাঁরা সম্পাদনা দলে কাজ করেছি, এখন যাঁরা কাজ করছেন, সবার তৃপ্তির জায়গা সম্ভবত এটাই যে এই যাত্রাপথে বিজ্ঞান নিয়ে একটা অনেক বড় পরিবার তৈরি হয়েছে বিজ্ঞানচিন্তার মাধ্যমে।

এই আনন্দযাত্রা চলুক আরও বহু যুগ!

লেখক: সাবেক সদস্য, সম্পাদনা দল, বিজ্ঞানচিন্তা

কৃতজ্ঞতা: আবুল বাসার, উচ্ছ্বাস তৌসিফ, আবিদুর রহমান

*লেখাটি ২০২৫ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত