ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় কীভাবে?

দিগন্তে ঘূর্ণিঝড়ের ঘনঘটা। আবহাওয়াবার্তায় ঘুরে ফিরে বারবার আসছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘মোখা’ বা ‘মোকা’। এদিকে প্রচণ্ড গরম—দাবদাহ। শহরাঞ্চলের অনেকের জন্য তাই এ ঘূর্ণিঝড় হয়তো খানিকটা স্বস্তির আশা দেখাচ্ছে। কিন্তু উপকূল অঞ্চলের মানুষদের জন্য এটি মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। বরং নাভিশ্বাস তুলে দেওয়ার জোগাড়।

বাংলাদেশে মে থেকে ডিসেম্বরের সময়টায় ঘূর্ণিঝড় বেশি হয়। প্রশ্ন হলো, কেন? আর এসব ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়ই-বা কীভাবে? এটাই আমাদের এ লেখার আলোচ্য বিষয়।

ঘূর্ণিঝড় বা আবহাওয়া বেশ জটিল জিনিস। এর মধ্যে নানা বিষয় আছে। তবে আমরা খুব সহজ করে বোঝার চেষ্টা করব বিষয়টা।

এক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো, লঘুচাপ জিনিসটা খারাপ। এটি নানাভাবে সমস্যা তৈরি করে। লঘুচাপ মানে আশপাশের অঞ্চলের তুলনায় কোনো জায়গায় বায়ুর চাপ কম থাকা। জল-স্থলের সংযোগস্থলে এ রকম হয়। কীভাবে?

দিনের বেলা সূর্যের তাপের কারণে স্থল বা মাটি পানির চেয়ে বেশি উত্তপ্ত বা উষ্ণ থাকে। এর কারণ, পানিতে যে পরিমাণ সূর্যের তাপ পড়ে, তার বেশির ভাগ প্রতিফলিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়, ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। মাটি এত তাপ প্রতিফলিত করতে পারে না। ফলে উষ্ণ হয়ে ওঠে।

বৃষ্টির তীব্রতা বা মাত্রা

এই উষ্ণ মাটি আবার ওপরে থাকা বায়ুর তাপ বাড়িয়ে দেয়। তাপ বাড়লে বায়ুর অণুগুলো একে অন্যের চেয়ে তুলনামূলক দূরে সরে যায়। অর্থাৎ বাতাসের ঘনত্ব কমে যায়। ফলে বাতাস হয়ে যায় হালকা। এই উষ্ণ, হালকা বায়ু ওপরের দিকে উঠে গেলে নিচের অংশটা ফাঁকা হয়ে যায়। ফলে ওই জায়গাটায় তৈরি হয় লঘুচাপ।

ওদিকে সমুদ্রের ওপরাংশে চলছে উল্টো ঘটনা। সমুদ্রের ওপরের বাতাস যেহেতু তুলনামূলক শীতল, তাই এর অণুগুলো কাছাকাছি অবস্থান করে। বায়ুর ঘনত্ব যায় বেড়ে। এই ভারী বায়ু নেমে আসে নিচের দিকে। ফলে সমুদ্রের ওপর বায়ুর চাপ বেড়ে যায়।

এখন পাশাপাশি যদি দুটো ঘটনার কথা ভাবি, একদিকে লঘুচাপ অঞ্চলের হালকা বাতাস ওপরের দিকে উঠে গেল। অন্যদিকে আশপাশের উচ্চ চাপ অঞ্চলের শীতল, ভারী বায়ু ছুটে আসতে শুরু করেছে এই লঘুচাপ অঞ্চলের দিকে। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই সৃষ্টি হয় ঘূর্ণি।

রাতের বেলা আবার উল্টো ঘটনা ঘটে। পানির তাপধারণের ক্ষমতা বেশি। তাই রাতের বেলা মাটি দ্রুত সব তাপ বিকিরণ করে দেওয়ার পরও আশপাশের পানি তাপ ধরে রাখে। ফলে রাতে মাটি হয়ে যায় তুলনামূলক ঠান্ডা। আর সমুদ্রের পানি হয়ে যায় তুলনামূলক উষ্ণ। বুঝতেই পারছেন, এর ফলে রাতের বেলা সমুদ্রের ওপর লঘুচাপ তৈরি হয়। আর মাটির ওপরের উচ্চ চাপের বায়ু সেদিকে ছুটে যেতে থাকে। এর ফলেও তৈরি হয় ঘূর্ণি।

সাধারণত সমুদ্রে যেখানে এ রকম হয়, তার কেন্দ্রের চারপাশের বাতাসের গতিবেগ যদি ঘণ্টায় ১৭ থেকে ৩০ কিলোমিটার হয়, তাহলে তাকে বলে লঘুচাপ। আর এই লঘুচাপের শক্তি বেড়ে গিয়ে যখন বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৩১ থেকে ৪০ কিলোমিটার হয়ে যায়, তখন সেটা পরিণত হয় নিম্নচাপে। অর্থাৎ লঘুচাপের আরও ভয়ংকর রূপ হলো নিম্নচাপ।

এই যে নিম্নচাপ তৈরি হলো, সেটা কিন্তু এক জায়গায় স্থির থাকে না। আশপাশের কোনো অঞ্চলের উচ্চ চাপের তুলনায় তার শক্তি যদি বেশি হয়, তখন এটি ওই অঞ্চলের দিকে যেতে থাকে। নিম্নচাপ আসলে ঘূর্ণিবায়ুর প্রবাহ। তাই এটি যেদিকে গিয়ে স্থির হবে বা যেখানে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে অবস্থান করবে, সেখানে হতে পারে ঘূর্ণিঝড়।

জল-স্থল যেখানে পাশাপাশি, সেখানে নিয়মিত হারে লঘুচাপ, নিম্নচাপ ইত্যাদি তৈরি হয়। আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের পানি এতে শক্তি জোগায়। বায়ুর প্রবাহ একে একবার এদিকে, তো পরমুহূর্তে ভিন্ন দিকে নিয়ে যায়। ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশের মতো অঞ্চলগুলোতে আবহাওয়া খুবই অস্থিতিশীল। কারণ, বাংলাদেশের অবস্থান ঠিক সমুদ্রের পাশে। একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন, চট্টগ্রামসহ সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী এই অঞ্চলগুলোই ঘূর্ণিঝড়ের প্রাথমিক স্বীকার। কারণ, এদিকের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মূল কেন্দ্র ওই পাশের সমুদ্র।

আবহাওয়ার এ অস্থিতিশীলতা বেশি দেখা যায় দক্ষিণাঞ্চলে। যেখানে শুধুই সমুদ্র বা শুধু স্থল, সেসব অঞ্চলে এ রকম সমস্যা হয় না। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তাই ঘূর্ণিঝড় বা এ ধরনের আবহাওয়াগত দুর্যোগ কম দেখা যায়।

বিভিন্ন ধরণের বাতাসের বেগ

এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো মেঘ। ট্রপোস্ফিয়ার বা বায়ুমণ্ডলের নিচের দিকের স্তরের মেঘই মূলত বৃষ্টির জন্য দায়ী। কিছুটা ওপরের দিকের মেঘ বৃষ্টিতে এতটা ভূমিকা রাখে না। নদী, সমুদ্র ইত্যাদি জলাধার থেকে পানি বাষ্পীভূত হয়ে মেঘের সৃষ্টি। এ থেকেই বৃষ্টি নামে। এ বিষয়টি সবারই জানা। তবে একটি বিষয় বলে রাখা প্রয়োজন। মেঘ কখন কোথায় থাকবে, তা মূলত নির্ভর করে মেঘের ঘনত্ব এবং বাতাসের গতিবেগের ওপর। ঘনত্ব বেশি হলেই সাধারণত ভারী বৃষ্টি হয়। হালকা মেঘ সামান্য বৃষ্টি হয়েই শেষ হয়ে যায়। আর বাতাসের গতিবেগ হালকা মেঘকে সহজে ভাসিয়ে নিতে পারে। ভারী মেঘকে খুব একটা দূরে বাতাস বয়ে নিতে পারে না। ফলে ভারী বৃষ্টি হয়। আবার আর্দ্রতা বেশি হলে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

মেঘ এবং বায়ুচাপের ওপরই মূলত নির্ভর করে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা কেমন হবে, আর্দ্রতা কেমন হবে ইত্যাদি। আরও নানা বিষয় আছে অবশ্য। কোনো অঞ্চলে উদ্ভিদের পরিমাণ, সে অঞ্চলে পাহাড় আছে কি না, এ রকম নানা কিছু।


এই ছোট্ট লেখায় খুঁটিনাটি সব বিষয় ব্যাখ্যা করা কঠিন। তাই আর গভীরে যাব না। তার চেয়ে বরং নিচের তালিকায় একনজরে দেখতে পাবেন ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টির নানা ধরন।

ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাড়ির বাইরে অবস্থান না করাই ভালো। বাইরে থাকলে চেষ্টা করতে হবে কোথাও ছাদ খুঁজে নিয়ে আশ্রয় নিতে। কাজে সামান্য দেরি হলেও এর ফলে নিরাপদে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। কিছুটা সচেতনতা জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে আপনার ও আপনার প্রিয়জনের।