হিমবাহের অপরূপ সৌন্দর্য, প্রভাব ও বিজ্ঞান

বাংলাদেশে সুউচ্চ পর্বতমালা নেই। তার ওপর আমাদের দেশ মেরু অঞ্চল থেকে অনেক দূরে। দুয়ে মিলে হিমবাহ কেবল কৌতূহলেই সীমাবদ্ধ ছিল। বরফের এই প্রকাণ্ড জমাট প্রাকৃতিক কাঠামোকে অচেনা ও অনেকটা অপার্থিব বলে মনে হতো।

হিমবাহ বা গ্লেসিয়ারের সঙ্গে সাক্ষাতের বাসনা আমার বহুকালের। ছেলেবেলায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের তথ্যচিত্রে বরফের বড় বড় খণ্ড ভেঙে পড়ার দৃশ্য আমাকে আলোড়িত করত। ভাবতাম, এ পাহাড়প্রমাণ বরফের স্তর যে ভেঙে পড়ছে, এটি বোধ করি হিমবাহ। বাংলাদেশে সুউচ্চ পর্বতমালা নেই। তার ওপর আমাদের দেশ মেরু অঞ্চল থেকে অনেক দূরে। দুয়ে মিলে হিমবাহ কেবল কৌতূহলেই সীমাবদ্ধ ছিল। বরফের এই প্রকাণ্ড জমাট প্রাকৃতিক কাঠামোকে অচেনা ও অনেকটা অপার্থিব বলে মনে হতো। এ অচেনা প্রকৃতির সঙ্গে যে একদিন সাক্ষাৎ হবে, পরিচয় হবে, একে নিয়ে যে আমি গবেষণায় নিয়োজিত হতে পারব, তা কল্পনায় আসেনি তখনো।

অপার্থিব এ হিমবাহ প্রথম স্বচক্ষে দেখতে পাই ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে। তবে দূর থেকে। পানিবিষয়ক একটি নতুন গবেষণার কাজে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা যেতে হয়েছিল সেই বছর। তখন শীত এসে গেছে আলাস্কায়। চারপাশ তুষারে ঢেকে আছে। আমরা কিনিক আদিবাসী গোত্রের সঙ্গে অ্যাঙ্করেজের কাছের কিছু গ্রামে পানির গুণাগুণ বিচারে ব্যস্ত। কিনিক গোত্র থেকে একলুটনা গোত্র, তারপর টাইওনেক গ্রাম। গবেষণার কাজ শেষে আলাস্কার পূর্ব প্রান্তে গ্লেন অ্যালেন নামের একটি জায়গায় যাওয়ার সময় রাজপথের ডান দিকে থামলাম। আদিবাসী সহগবেষক আমাকে দেখালেন দূরে অবস্থিত হিমবাহটি। প্রথমে খুঁজে পেতে খানিক বেগ পেতে হলো। পরে দেখলাম, দূরে পাহাড়ের ফাঁকে সাদা বরফের আবরণ—সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে যেন। আমি শিশুতোষ ভালো লাগায় চেঁচিয়ে উঠলাম। বললাম, ‘ওই যে গ্লেসিয়ার। আমি গ্লেসিয়ার দেখছি।’ এ উচ্ছ্বাস দেখে আমার আদিবাসী বন্ধু হাসলেন খুব। তবে হিমবাহের সঙ্গে এ সাক্ষাৎ অসম্পূর্ণ ঠেকল। দেখা হলো, তবে তা এত দূর থেকে যে পরিচয় হলো না যেন। পণ করলাম, এ ঘুমন্ত জমাট নদীকে নিয়ে আমার গবেষণা করতে হবে। অচেনা এ অস্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত আমাকে হতেই হবে।

সে সংকল্পে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদে একটি গবেষণা প্রস্তাব লিখি আমি। অনুদান চাই। মাস চারেক পর জানতে পারি, এ প্রস্তাব মঞ্জুর হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে হিমবাহের গলন কী করে হচ্ছে এবং এতে পানির রাসায়নিক ও জৈবিক গুণ কী করে পাল্টাচ্ছে—এ নিয়ে গবেষণা। আমি দিন গুনছি। ২০২১ সালের আগস্ট মাস। আমার দুজন ছাত্র, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাংকসের সহগবেষক এবং আমাদের আদিবাসী বন্ধু। আমরা সবাই এক্সিট গ্লেসিয়ার নামের একটি হিমবাহে পানি ও বরফের নমুনা সংগ্রহ করতে যাব। জানলাম, এ হিমবাহ পর্যন্ত পৌঁছাতে পাহাড়ে চড়তে হবে। এ সময়ে আলাস্কায় বৃষ্টি হয়।

পাহাড়ি হিমবাহ বরফের ভারে উপত্যকা বেয়ে নিচে নামতে থাকে।
হিমবাহের সঙ্গে এই আমার প্রথম করমর্দন। শীতল আপাতত স্থবির এই বরফের নদী আদতে চলমান। চুপ করে শুনলে হিমবাহ নিঃসৃত জলের বহতা স্রোত শোনা যাবে। মাঝেমধ্যে বরফের খণ্ড ভেঙে পড়ার বিকট শব্দ মনে করিয়ে দেবে এর ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের কথা।

তখন সকাল আটটা। অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। আমাদের আটজনের দল, চারজন ট্যুর গাইড সঙ্গে যুক্ত হলো। এলাকাটি কিনাই ফিয়র্ড ন্যাশনাল পার্কের আওতায় পড়ে। বৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা পাহাড় বেয়ে উঠছি। পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা আমার প্রায় শূন্যের কোঠায়। পায়ের আঙুলে চাপ পড়ছে। আমার জুতা পর্বতারোহণের জন্য উপযুক্ত ছিল না। যাহোক, দুই ঘণ্টা পর পাহাড়ে একটা সমতল জায়গায় এসে থামলাম। সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল হিমবাহ। নানা শেডের নীলে মাখামাখি এক বরফের নদী। আমি বেগুনি রঙের ফায়ারউইডের ফাঁকে সাদা ও নীলের নকশা করা হিমবাহ দেখছি অবাক চোখে। এরপর আধা ঘণ্টা পাহাড় বেয়ে নামার পর হিমবাহের গায়ে পা রাখলাম। জানলাম, উষ্ণায়নের কারণে এক্সিট গ্লেসিয়ার পিছু হটেছে বা রিসিড (Recede) করেছে প্রায় তিন কিলোমিটারের মতো। এখন হিমবাহটি নিঃশেষিত প্রায়। আমরা পায়ে ক্র্যাম্পন পরে হাতে হাইকিং সাপোর্ট (বা লাঠি) নিয়ে হিমবাহের গা বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম।

হিমবাহের সঙ্গে এই আমার প্রথম করমর্দন। শীতল আপাতত স্থবির এই বরফের নদী আদতে চলমান। চুপ করে শুনলে হিমবাহ নিঃসৃত জলের বহতা স্রোত শোনা যাবে। মাঝেমধ্যে বরফের খণ্ড ভেঙে পড়ার বিকট শব্দ মনে করিয়ে দেবে এর ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের কথা। যেখান দিয়ে হিমবাহ পিছু হটে, সেখানে বনানী গড়ে ওঠে। তাতে বুনো ফুল হয়, ফল ধরে। তবে হিমবাহের গায়ে কোনো উদ্ভিদ নেই। একে তাই আরও প্রাণহীন বলে মনে হয়। তবে হিমবাহের কাছাকাছি এলে, এর সৌন্দর্যে অবগাহন করে সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার পর এই জমাট নদীর বয়ে চলা, তার শব্দ, এমনকি গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যায়। আমি পেয়েছি। কী জানি? হয়তো এই অচেনা প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যের, নিবিড় সম্বন্ধ তৈরির আকুতি ছিল বলে আমার কাছে সে এমন করে ধরা দিয়েছে।

হিমবাহের রূপ সত্যিই অশরীরী। পাহাড়ি হিমবাহ বরফের ভারে উপত্যকা বেয়ে নিচে নামতে থাকে। নামার সময় পাহাড়ের গা ঘষে পাথর চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে। তৈরি করে মোরেইন। বরফের স্তর কয়েক ফুট থেকে কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। বরফের উপরিতল এই গতিময়তায় ভেঙে যায়, তৈরি করে খাঁড়ি। কোনোটি ছোট, অগভীর; কোনোটি দীর্ঘ, যা চলে গেছে বরফের নিম্নস্তর বা বেসাল প্লেন পর্যন্ত। তবে এই ভাঙাগড়ার ভেতর গ্লেসিয়াল আইস বা ঘন নীল বরফ উঁকি দেয়। এই বরফ কিছুটা শুভ্র, কিছুটা হালকা নীল, আবার কোথাও ঘন ময়ূরকণ্ঠী নীল। নীলের যে এত শেড থাকতে পারে, তা হিমবাহ নিজ চোখে না দেখলে জানা যায় না। এ অপরিচিত অথচ অতি গুরুত্বপূর্ণ জমাট নদীর জন্ম, গতিময়তা ও তার প্রভাবের সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হওয়া যাক এবার।

হিমবাহ গঠনের প্রক্রিয়া অনন্যসাধারণ। জলবায়ুর বিশেষ কিছু পূর্বশর্ত গ্লেসিয়ার বিনির্মাণের জন্য জরুরি। যে অঞ্চলে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে বছরের কিছু সময় বিরাজ করে, যেখানে তুষারপাত ঘটে এবং যে এলাকার তাপমাত্রা গেল মৌসুমে পতিত তুষারের সম্পূর্ণ গলন প্রতিরোধে সক্ষম, সে অঞ্চলে হিমবাহ সৃষ্টি হতে পারে।

২.

হিমবাহ বা গ্লেসিয়ার তুষার, বরফ, জল ও পললের পুঞ্জীভূত বহুবর্ষজীবী ভর। নিজ ওজনের জন্য এটি ধীরগতিতে ভূমিতে (পার্বত্য অঞ্চলে) কিংবা পানিতে (মেরু সাগরে) গতিময়তা লাভ করে। হিমবাহের মূলত দুটি প্রকারভেদ রয়েছে; পার্বত্য হিমবাহ ও মেরু সাগর হিমবাহ। পার্বত্য হিমবাহ বা আলপাইন গ্লেসিয়ারস উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর পর্বতাঞ্চল (মেরু হিমবাহ), ইউরোপের আল্পস পর্বতমালা, দক্ষিণ আমেরিকার আন্দেজ পর্বতাঞ্চল ও হিমালয় পর্বতমালায় গঠিত হয়। অন্যদিকে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু সাগরেও তুষারপাত থেকে গঠিত হয় হিমবাহ। ভূপৃষ্ঠের বেশির ভাগ হিমবাহ অ্যান্টার্কটিকায় (প্রায় ৯১ শতাংশ) আর কিছু রয়েছে গ্রিনল্যান্ডে (৮ শতাংশের মতো)। ১ শতাংশের নিচে হিমবাহ দেখা যায় উত্তর আমেরিকা (শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ) ও এশিয়ায় (শূন্য দশমিক ২ শতাংশ)। দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া মিলিয়ে রয়েছে বাকি শূন্য দশমিক ১ শতাংশ হিমবাহ। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে কোনো হিমবাহ খুঁজে পাওয়া যায় না।

হিমবাহ গঠনের প্রক্রিয়া অনন্যসাধারণ। জলবায়ুর বিশেষ কিছু পূর্বশর্ত গ্লেসিয়ার বিনির্মাণের জন্য জরুরি। যে অঞ্চলে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে বছরের কিছু সময় বিরাজ করে, যেখানে তুষারপাত ঘটে এবং যে এলাকার তাপমাত্রা গেল মৌসুমে পতিত তুষারের সম্পূর্ণ গলন প্রতিরোধে সক্ষম, সে অঞ্চলে হিমবাহ সৃষ্টি হতে পারে। হিমবাহের গঠন সময়সাপেক্ষ। একাধিক মৌসুমের তুষারপাতের পর জমে থাকা তুষার নিজের ভারে স্ফটিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পানির মৌলগুলোকে পুনর্বিন্যস্ত করে। তুষার ফুঁয়োফুঁয়ো (বা ফাঁপা) হয়ে থাকে, অর্থাৎ এতে বায়ুর পরিমাণ ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ। তুষার যখন বরফে রূপান্তরিত হয়, তখন পানির মৌলগুলোর পুনর্বিন্যাসের কারণে বায়ুর পরিমাণ কমে ১০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। এভাবে বহুবর্ষীয় তুষার ও বরফ জমতে থাকা ভারে নিচের স্তরে অবস্থিত বরফ আরও ঘনীভূত হয়। এটা আটকে থাকা বাতাস চেপে বের করে দেয়। এমন করে গড়ে ওঠে হিমবাহের ঘন নীল বরফের স্তর। এ বরফের রং কেন ঘন নীল—প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এককথায় বলতে গেলে আলোকরশ্মির প্রতিফলনের ফল এই নীল রং। তুষার-বর্ণালির প্রায় সব রং প্রতিফলিত করে বলে এর রং শুভ্র। বরফে বায়ুর পরিমাণ যত কমতে থাকে, নীল রঙের প্রতিফলন তত বাড়তে থাকে আর অন্য রংগুলো শোষণ করে নিতে থাকে বরফ। তাই পুনর্গঠিত হিমবাহের বরফস্তরের রং ঘন নীল, যা কিনা নীল আলোকরশ্মি প্রায় সম্পূর্ণ প্রতিফলিত করতে সক্ষম।

হিমবাহ আপাতদৃষ্টে স্থবির বলে মনে হলেও তারা গতিশীল। মেরু সাগর হিমবাহ জলের ওপর স্বল্পতম ঘর্ষণ এড়িয়ে বেগবান হতে পারে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবে পাহাড়ে সৃষ্ট জমাট বরফ নদী কী করে ভূতলের ওপর দিয়ে, উপত্যকার ঘর্ষণজনিত বাধা অতিক্রম করে নিম্নগামী হয়, তা বিস্ময়কর বটে। মূলত তিনটি প্রক্রিয়ায় পার্বত্য হিমবাহ সচল হয়। প্রথমত, বরফের স্ফটিকের শৃঙ্খলার বিকৃতি বা ডিফরমেশন প্রায় সব পার্বত্য হিমবাহকে নিয়ত গতি দেয়। বরফকে আমরা যদিও কঠিন পদার্থ হিসেবে জানি, পদার্থবিজ্ঞানের বিচারে বরফ একটি সান্দ্র তরল বা ভিসকাস ফ্লুইড। এর সান্দ্রতা তাপমাত্রা ও চাপের ওপর নির্ভরশীল। একে নন-নিউটোনিয়ান ফ্লুইডও বলা হয়। বর্ষানুক্রমে সঞ্চিত তুষার যখন বরফের স্ফটিকে রূপান্তরিত হতে থাকে, বরফের স্তূপের গভীরে চাপও বাড়তে থাকে ওপরে বিদ্যমান বরফের স্তূপের ভারে। এ উন্নীত ভারজনিত চাপ স্ফটিকের ডিফরমেশন ঘটায় এবং হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা থাকা সত্ত্বেও বরফ গলে যায়। এটা ওপরে বিদ্যমান বরফের ভারকে লুব্রিকেশন (পিচ্ছিলতা) দেয়। হিমবাহ চলতে শুরু করে বছরে কয়েক মিটার গতিতে। এ প্রক্রিয়ায় হিমবাহের চলন মূলত মেরু অঞ্চলে ও ইউরোপের আলপাইন হিমবাহে দেখা যায়।

হিমবাহের গতিময়তার তৃতীয় পন্থার নাম পললের বিকৃতি বা ডিফরমেশন। কোনো কোনো হিমবাহের তলদেশে পাথুরে পর্বতের স্থলে পললের স্তর লক্ষ করা যায়।

দ্বিতীয় পদ্ধতিকে বলা হয় বেসাল স্লাইডিং। পাহাড়ের গা ঘেঁষে, পৃষ্ঠদেশ ছুঁয়ে হিমবাহের প্রবাহের গতিকে ব্যাখ্যা করে এটি। ইউরোপের আলপাইন গ্লেসিয়ারগুলো গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ওপর ওঠার পর ফাটল বা ক্রেভিস এবং গভীর ফাটল বা মুলান তৈরি করে। এ ফাটলের মধ্য দিয়ে গলিত পানি হিমবাহের বরফের স্তূপের গভীরে, পাহাড়ের পৃষ্ঠদেশে গিয়ে পৌঁছায়, যা ওপরের বরফের কলাম পিছলে নিচে নেমে যেতে সহায়তা করে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, মেরু অঞ্চলের পার্বত্য হিমবাহ কি এ পদ্ধতিতে গতিশীল হয় না? জানলে অবাক হতে হয় যে হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা থাকলেও এ অঞ্চলে বেসাল স্লাইডিং ঘটে। এর পেছনের কারণ খুঁজতে আবার পদার্থবিদ্যার শরণাপন্ন হতে হবে। চাপ যখন বাড়ে, তখন বরফের হিমাঙ্কের তাপমাত্রাও কমে। অর্থাৎ হিমাঙ্ক অধিকতর চাপে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে চলে যায়। আর এ কারণে বরফের কলামের গভীরে, পাহাড়ের পৃষ্ঠদেশের কাছাকাছি তলে বরফ গলে যায় মেরু অঞ্চলে। এটা একইভাবে লুব্রিকেশন জোগায় ওপরের বরফের স্তূপকে গতিময়তা দিতে।

হিমবাহের গতিময়তার তৃতীয় পন্থার নাম পললের বিকৃতি বা ডিফরমেশন। কোনো কোনো হিমবাহের তলদেশে পাথুরে পর্বতের স্থলে পললের স্তর লক্ষ করা যায়। পললের দানাগুলোর মধ্যে যে ঘর্ষণ কাজ করে, তা এ স্তরকে সমন্বিত ও স্থবির রাখতে সহায়তা করে। হিমবাহের বরফ গলা জল যখন পললস্তরে ঢোকে, তখন এই পানি পললের দানার মধ্যকার ঘর্ষণ কমিয়ে দেয়। এটা পললের বিকৃতির মধ্য দিয়ে হিমবাহের বরফের স্তরকে এনে দেয় গতিময়তা। এ পদ্ধতিতে হিমবাহ বছরে শত মিটার গতিবেগ অর্জন করতে পারে। হিমবাহের এই চলন যে শুধু তার বিস্তৃতি নিশ্চিত করে তা-ই নয়; বরং পার্বত্য হিমবাহের প্রবাহে পাথর, পাথরকুচি ও পলল পরিবাহিত হয়, স্থানান্তরিত হয়। আর এভাবে পার্বত্য হিমবাহ তার চলার পথে উপত্যকার আকার নির্ধারণ করে এবং বিভিন্ন ভূমিরূপ ও জলরূপের জন্ম দেয়।

আলাস্কায় এর পরের বছরগুলোয় আমি এমন আরও অনেক হিমবাহ নিয়ে গবেষণা করেছি। এর মধ্যে রয়েছে মাতানুস্কা, ক্যাসনার, কিনিক ও তাজলিনা গ্লেসিয়ার। প্রতিটি হিমবাহের রূপ ভিন্ন। একেকটির আকার একেক রকম। তবে যা পরিচিত লেগেছে, চেনা ঠেকেছে, তা হলো এই জমাট নদীগুলোর বরফে নীলের বিন্যাস, তাদের বিশালতা ও একটি অদ্ভুত চেনা শব্দ ও গন্ধ। হিমবাহের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এই কয়েক বছরে আমি এর ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে শুরু করেছি। জেনেছি, থোয়েটস গ্লেসিয়ার নামের দক্ষিণ-পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার একটি হিমবাহ যদি অ্যান্টার্কটিকার বরফখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় (যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এই দশকের ভেতর), তবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ৩ ফুট পর্যন্ত। আমি জেনেছি, হিমবাহ গলে প্রলয়ংকরী বন্যা হতে পারে। যেমনটি ঘটেছে পাকিস্তানে ২০২২ সালের শেষ দিকে। আরও জেনেছি, এই বন্যার পর আসবে খরা, যখন হিমবাহগুলোর মৃত্যু হবে আর শুষ্ক মৌসুমে হিমবাহসৃষ্ট নদ-নদীতে পানির সংযোগের কোনো পথ খোলা থাকবে না।

আমাদের দেশের দুটি প্রধান নদী—পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র আসলে হিমালয়ের হিমবাহসৃষ্ট নদী। বলা হচ্ছে, ২১০০ সাল নাগাদ হিমালয়ের এক-তৃতীয়াংশ হিমবাহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমাদের পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের কী অবস্থা দাঁড়াবে তখন? এ নদীগুলো বাংলাদেশের প্রাণ। তাদের ভাঙনে যেমন আমাদের আতঙ্ক, বন্যায় যেমন আমাদের ক্ষতি, তেমনি তাদের শুকিয়ে যাওয়ায় নেমে আসবে অভিশাপ। হিমবাহ আমাদের কাছে অপরিচিত হলেও এই বরফ নদীর কথা জানা আমাদের জন্য জরুরি। এর ভেতর লুকিয়ে আছে পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের প্রাণ, সুফলা বাংলাদেশের উর্বরতা।

লেখক: নাভিদ সালেহ, অধ্যাপক, পরিবেশ প্রকৌশল অনুষদ, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র

সূত্র: ১. United States Geological Survey (USGS); www.usgs.gov

২. সালেহ, ন. হিমবাহ বৃত্তান্ত: আগামীর বন্যা ও খরার পূর্বাভাস। বণিক বার্তা, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

৩. Wadham, J. Ice Rivers. 2021. Princeton University Press, Princeton, NJ

৪. Hubbard, A et al., 2000. Glacier mass-balance determination by remote sensing and high-resolution modeling. Journal of Glaciology. 46. 491-498.

৫. Mair, D. et al., 2002. Influence of subglacial drainage system evolution on glacier surface motion: Haut Glacier d’Arolla, Switzerland. Journal of Geophysical Research: Solid Earth. 107.