গ্রহান্তরে ভালো থাকবেন ড. রেজাউর রহমান

বিজ্ঞানী রেজাউর রহমান

ডক্টর রেজাউর রহমান (১৯৪৪-২০২৫) ছিলেন একজন কীটতত্ত্ববিদ। কর্মজীবনের পুরোটাই কাটিয়েছেন আণবিক শক্তি কমিশনে, ছিলেন মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। কিন্তু মননে ছিলেন গল্প লেখক আর মেজাজে বিজ্ঞান অ্যাকটিভিস্ট। ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন বেশ কয়েকটি। কিন্তু আমরা ডক্টর রেজাউর রহমানকে চিনি তাঁর বিজ্ঞান গ্রন্থ থেকে, তাঁর বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কর্মধারা থেকে।

বাঁ থেকে রেজাউর রহমান ও এফ আর সরকারের সঙ্গে লেখক
ফাইল ছবি

‘সাপ’ ছিল সম্ভবত তাঁর লেখা প্রথম বিজ্ঞান গ্রন্থ, প্রকাশ হয়েছিল ১৯৮৫ সালে, বাংলা একাডেমি ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালা সিরিজের অংশ হিসেবে। এরপর কীটপতঙ্গ, পরজীবী প্রাণী এবং জীবজগতের অন্যান্য অজনপ্রিয় বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তাঁর লেখার বিষয় ছিল কিছুটা আলাদা ধাঁচের, অবশ্যই তাঁর অধীত বিদ্যা ও গবেষণাচর্চার সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ। কীটপতঙ্গ বা পরজীবী প্রোটোজোয়াদের নিয়ে খুব ভাল বাংলা বই তেমন নেই। সেদিক দিয়ে ডক্টর রেজাউর রহমান খুব ভাল কিছু পথিকৃতের কাজ করেছিলেন বলা যায়। ওঁর বাংলা অত্যন্ত সরল, চমৎকার গদ্য, ছোট ছোট বাক্য, সহজ অভিব্যক্তি। তবু পড়লে কিন্তু একটা সাহিত্যের আভাস পাওয়া যায়! যদি জানা থাকে যে লেখক একজন গল্পকারও বটে, তখন বোঝা যায় কেন তাঁর বিজ্ঞান-সাহিত্য এত চমৎকার! ২০২৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার তাঁর বিজ্ঞান-সাহিত্য চর্চার এক ঐতিহাসিক স্মারক হয়ে থাকবে।

এফ আর সরকার, রেজাউর রহমান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহী একদল তরুণের সঙ্গে লেখক
ফাইল ছবি
ক্লাসে তিনি সাদামাটা ট্রান্সপারেন্সিতে নানা রকম কোষ আর ক্ষুদ্র জীবের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ঘটিয়েছেন। সেসব স্মৃতি আমার স্মৃতিপটে সমুজ্জ্বল।

বিজ্ঞানবিষয়ক তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য বই ‘মহাবিশ্বে জীবনের সন্ধানে’। এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল প্রথমা প্রকাশন থেকে ২০১০ সালে। এ বইটি ডক্টর রেজাউর রহমানের দীর্ঘদিনের প্যাশনের ফল। তিনি বিজ্ঞানের জনপ্রিয় যে বিষয়ের ওপর বহু বছর বক্তৃতা দিয়েছেন, মহাবিশ্বে প্রাণের সন্ধান ছিল তার অন্যতম, সত্যি বলতে কি একমাত্র বিষয়। আমরা ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর বৈশ্বিক প্রাণের সন্ধান বিষয়ে আগ্রহের সঙ্গে সুপরিচিত। এবং একথা বলা যায় যে, বহির্বিশ্বে প্রাণের অনুসন্ধান, তার বৈজ্ঞানিক প্রকৃতি, প্রাণ কাকে বলে, তার বৈশিষ্ট্য কীভাবে চিহ্নিত করা যায়, আদিমতম প্রাণের উদাহরণ, ক্ষুদ্রতম প্রাণের মৌলিক বৈশিষ্ট্য—এসবই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্লাসে তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। ক্লাসে তিনি সাদামাটা ট্রান্সপারেন্সিতে নানা রকম কোষ আর ক্ষুদ্র জীবের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ঘটিয়েছেন। সেসব স্মৃতি আমার স্মৃতিপটে সমুজ্জ্বল। মহাবিশ্বে প্রাণের অনুসন্ধানবিষয়ক বৈজ্ঞানিক কৌতূহল তিনিই আমাদের প্রজন্মে চারিত করেছিলেন। যে-কারণে, আমার ‘মানুষ, মহাবিশ্ব ও ভবিষ্যৎ’ (২০১৩, প্রথমা) বইটি আমি উনাকেই উৎসর্গ করেছিলাম। ডক্টর রেজাউর রহমানের উক্ত বইটির একটি নাতিদীর্ঘ সমালোচনা আমি লিখে ফেলেছিলাম দেরি না করেই, সেটি পরে ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছিল।

ডক্টর রেজাউর রহমান স্যারের সঙ্গে আমার দীর্ঘ স্মৃতি আছে, জ্যোতির্বিজ্ঞান-বিষয়ক মাঠ পর্যায়ের কাজ করার। তিনি ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রনমিকাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যখন এফ আর সরকার (বাংলাদেশের সৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার আরেক দিকপাল) বেঁচে ছিলেন, ডক্টর রেজাউর রহমানকে নিয়ে আমরা বার দুয়েক এনায়েতপুরে ‘মহাকাশ সপ্তাহ’ পালনের উদ্দেশ্যে গিয়েছি। এছাড়াও আমাদের নিজস্ব বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনায় ডক্টর রেজাউর রহমান অনেকবার এসেছেন, সভার কাজ সামলেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার নানা ঐতিহাসিক ভুল ও অর্জনসমূহের ব্যক্তিগত পাঠ আমি তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। তাঁর বলার ভঙ্গি ছিল খুব অমায়িক, মৃদু স্বরে ছোট ছোট বাক্যে তিনি সহজিয়া বিজ্ঞান বলে গেছেন।

২০১৩ সালে একুশে বইমেলায় এক মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে রেজাউর রহমানের সঙ্গে লেখক

অনেক বামনের ভিড়ে ডক্টর রেজাউর রহমান আমাদের সামগ্রিক স্মৃতিতে এক উজ্জ্বল জায়ান্ট হয়ে থাকবেন। গ্রহান্তরে ভালো থাকবেন স্যার।

লেখক: অধ্যাপক, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ, বুয়েট