আগুন নেভানোর উপায়

গত ৪ তারিখ, সোমবার আগুন লেগে পুড়ে যায় রাজধানীর বঙ্গবাজার পাইকারি মার্কেট। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় হাজার কোটি টাকার সম্পদ। আগুনের লেলিহান শিখা স্তব্ধ করে দেয় পুরো জাতিকে।

দুর্ঘটনা হিসেবে অগ্নিকাণ্ড খুবই মারাত্মক। আগুন যত বড় হয়, তত সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। সামনে যা পায়, তা–ই পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। এই আগুন লাগলে নেভানোর উপায় কী? অনেকেই হয়তো পানির কথা বলবেন। পানি দিয়ে আগুন নেভানো যায় ঠিক, কিন্তু সবক্ষেত্রে নয়।

জ্বালানি বা আগুনের উৎসের ওপর নির্ভর করে আগুন নানা ধরনের হয়। আগুনের কিছু ধরন আছে, যেখানে পানি দিলে হিতে বিপরীত হয়। আগুন আরও বেড়ে যায়। কীভাবে? সেটা বলব। তার আগে আগুনের ধরন বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছি, সেটা পরিষ্কার করি।

আমরা জানি, আগুন জ্বলার জন্য প্রয়োজন জ্বালানি। জ্বালানি বলতে শুধু যে গ্যাস বা তেলকে বোঝায়, তা নয়। যে জিনিসে আগুন লাগতে পারে, সেটাই আগুনের জ্বালানি। হতে পারে সেটা তেল, গ্যাস, কাঠ, লোহা, রাসায়নিক, বিদ্যুতের লাইন বা অন্য যেকোনো কিছু। আগুন কোন ধরনের জ্বালানি পুড়িয়ে জ্বলছে, তার ওপর নির্ভর করে বিশেষজ্ঞরা আগুনকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। এসব ভাগকেই বলছি নানা ধরনের আগুন।

একেক ধরনের আগুন নেভানোর জন্য একেক রকম কৌশলের দরকার হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগুন প্রধানত পাঁচ ধরনের। ক্লাস এ, ক্লাস বি, ক্লাস সি, ক্লাস ডি এবং ক্লাস কে।

 ক্লাস এ (জ্বালানি: কাঠ, কাগজ বা কাপড়ের মতো সাধারণ পদার্থ)

এ ধরনের আগুনের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। কাগজ, কাঠ, কাপড়, আবর্জনা, প্লাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থ এই আগুনের জ্বালানি। চারপাশে এ ধরনের আগুনই বেশি দেখা যায়। সৌভাগ্যবশত, এ আগুন নেভানো সবচেয়ে সহজ। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফায়ার ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ‘ক্লাস এ’ ধরনের আগুন নেভানোর জন্য পানি বা অগ্নিনির্বাণ যন্ত্র থেকে নির্গত কার্বন ডাই–অক্সাইডের ফোম ব্যবহার করতে হবে।

ক্লাস বি (জ্বালানি: জ্বালানি তেল, অ্যালকোহল বা গ্যাসোলিন)

মার্কিন ফায়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, জ্বালানি তেল, অ্যালকোহল বা প্রোপেন গ্যাসের মতো অতি দাহ্য পদার্থ এ ধরনের আগুনের জ্বালানি। সাধারণত এসব জ্বালানি যেখানে মজুত থাকে, সেখানে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে।

‘ক্লাস বি’ ক্যাটাগরির আগুন নেভানোর জন্য কোনোভাবেই পানি ব্যবহার করা উচিত নয়। এ আগুনের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। ফলে, পানি আগুনের উৎসে পৌঁছানোর আগেই বাষ্পে পরিণত হতে পারে, আরও বাড়িয়ে দিতে পারে আগুন।

এ ধরনের আগুন নেভাতে অক্সিজেনের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, এমন রাসায়নিক ফোম ব্যবহার করা উচিত। যেমন অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের কার্বন ডাই-অক্সাইড।

ক্লাস বি আগুন নেভাতে ব্যবহার করতে হবে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের কার্বন ডাই-অক্সাইড

ক্লাস সি (বিদ্যুৎসংশ্লিষ্ট আগুন)

ইলেকট্রিসিটি বা বিদ্যুৎ–সংযোগ কোনো আগুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে সেটাকে এই ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়। পুরোনো ও ত্রুটিযুক্তি বৈদ্যুতিক লাইন বা ক্রটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ এ ধরনের আগুনের প্রধান উৎস। বাসাবাড়ি ও কল-কারখানায় বৈদ্যুতিক আগুন লাগতে পারে। অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি স্ট্রাইক ফার্স্টের মতে, বৈদ্যুতিক বা ‘ক্লাস সি’ ধরনের আগুন লাগলে প্রথমেই উচিত বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। কাজটি করতে হবে অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কারণ, বিদ্যুৎ নিজেই মানুষের জন্য প্রাণঘাতী।

এ ধরনের আগুন নেভাতে কার্বন ডাই-অক্সাইডযুক্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যায়, তাহলে ক্লাস সি ধরনের আগুন সাধারণত ‘ক্লাস এ’ ধরনের আগুনে পরিণত হয়।

বৈদ্যুতিক আগুন নেভাতে পানি বা ফোমজাতীয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (Foam extinguisher) ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে পরিস্থিতি আরও বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। কারণ, সেখানে বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ থাকে।

ক্লাস ডি (ধাতব পদার্থ পুড়ে সৃষ্ট আগুন)

ধাতব পদার্থ গলাতে প্রচুর তাপের প্রয়োজন হয়। শিল্পকারখানায় অতি দাহ্য রাসায়নিক পুড়লে এ পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের এনভায়রনমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি অফিসের বিশেষজ্ঞদের মতে, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম ও সোডিয়ামের মতো ক্ষারীয় ধাতু থেকে এ ধরনের আগুন তৈরি হতে পারে। এসব পদার্থ বাতাস বা পানির সংস্পর্শে এলে জ্বলে উঠতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফায়ার ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ‘ক্লাস ডি’ ক্যাটাগরির আগুন নেভানোর জন্য শুধু ড্রাই পাউডার অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ব্যবহার করা উচিত। ফোম বা পানি এ ধরনের আগুনের তীব্রতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই সেগুলো ব্যবহার করা উচিত নয়।

ক্লাস কে (জ্বালানি: ভোজ্য তেল বা প্রাণীর চর্বি)

সাধারণত রান্নাঘর থেকে এ ধরনের আগুনের সূত্রপাত ঘটে। অসাবধানতায় রান্না করার সময় উচ্চ তাপে ভোজ্য তেলে আগুন লেগে যেতে পারে। এ ধরনের আগুনকে ‘ক্লাস কে’ ক্যাটাগরি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

এ ক্যাটাগরির আগুনকে অনেকেই ‘ক্লাস বি’ আগুনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, যেটা মোটেও ঠিক নয়। দুই ক্যাটাগরির আগুনের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। তবে নেভানোর পদ্ধতিতে কিছুটা মিল আছে। ‘ক্লাস বি’ ধরনের আগুন নেভাতে যেমন পানি ব্যবহার করা একেবারেই উচিত নয়, তেমনি ‘ক্লাস কে’ ধরনের আগুনেও পানি দেওয়া ঠিক নয়। এতে আগুন ছিটকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। গরম তেলে পানি পড়লে এই প্রভাব দেখা যায়।

‘ক্লাস কে’ ধরনের আগুন নেভানোর জন্য ভেজা রাসায়নিক বা কার্বন ডাই-অক্সাইডের ফোম নির্গমনকারী অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। বাণিজ্যিক রান্নাঘরে এ ধরনের যন্ত্র রাখা বাধ্যতামূলক।

রান্নাঘরের আগুন ছোট হলে মোটা তোয়ালে বা কাপড় ভিজিয়ে সেটা দিয়ে আগুন ঢেকে ফেলা যেতে পারে। এতে করে আগুনে বাইরে থেকে অক্সিজেনের সরবরাহ হয় না। ফলে আগুন নিভে যায়। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, এটা শুধু ছোট আগুনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেটা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে ফেলা যাবে। অন্যথায় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে এবং প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে হবে।

সাধারণত রান্নাঘরে অসাবধানতায় 'ক্লাস কে' ধরনের আগুন লাগতে পারে

আগুন যেমন ভয়ংকর, তেমনি দৈনন্দিন জীবনে এই আগুন-ই আমাদের ভীষণ প্রয়োজন। বাড়িতে খাবার রান্না থেকে শুরু করে কারখানায় নানা পণ্য তৈরি, সবখানেই আগুনের রয়েছে ব্যবহার। প্রয়োজনীয় এই আগুন আমাদের অসতর্কতার কারণেই ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

আগুনের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার বাঁধাধরা কোনো উপায় নেই। সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। ম্যাচ, লাইটার, রাসায়নিক পদার্থ, বৈদ্যুতিক সকেটের মতো আগুন লাগাতে পারে—এমন জিনিস রাখতে হবে পরিবারের যারা ছোট, তাদের নাগালের বাইরে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ইনসাইডার