হকিংয়ের ভবিষ্যদ্বাণী

স্টার ট্রেক এবং ম্যাড ম্যাক্স। হলিউডের দুটি জনপ্রিয় ছায়াছবি সিরিজ। দুটোরই প্রেক্ষাপট ভবিষ্যতের মানবসভ্যতা। স্টার ট্রেকের পটভূমিতে মানবসভ্যতা উন্নীত হয়েছে আন্তনাক্ষত্রিক পর্যায়ে। অন্যদিকে ম্যাড ম্যাক্সের প্রেক্ষাপট দুর্যোগে বিপর্যস্ত পৃথিবীর হতভাগা মানুষদের নিয়ে। তাদের হিংস্রতা-হানাহানি নিয়ে। মানুষের উদ্ভবের প্রায় দুই লাখ বছর পার হয়েছে। কিন্তু মানুষ প্রকৃতির ওপর প্রভাব বিস্তারের মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভর করে পাওয়া এ শক্তি একই সঙ্গে সৃজনশীল এবং বিধ্বংসী। ফলাফল পারমাণবিক বোমা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সুপারবাগ ইত্যাদি। এগুলোর প্রতিটিই মানবসভ্যতার জন্য হুমকি। এসব প্রযুক্তির ব্যবহারই ঠিক করে দেবে কোন পটভূমিতে বাঁচবে আগামীর মানুষ—স্টার ট্রেকের নাকি ম্যাড ম্যাক্সের।

প্রযুক্তির এই অভূতপূর্ব উন্নতি দৃষ্টি এড়ায়নি এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে বারবার সতর্ক করেছেন তিনি। তাঁর মতে, যেকোনো একটি বছরে বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের আশঙ্কা অনেক কম হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ঝুঁকি বাড়তে থাকে। আর সহস্রাব্দের বিচারে এ বিপর্যয় অনেকটাই নিশ্চিত। কী ছিল হকিংয়ের ভবিষ্যদ্বাণী, আশঙ্কা? কী উপদেশ দিয়েছিলেন এসবের মোকাবিলায়?

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন

সময় যত গড়াচ্ছে, বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ। কিন্তু বিশ্বনেতারা এখনো উদাসীন। ‘আমরা জানি না বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কোথায় গিয়ে থামবে, স্টোরিলাইন পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছিলেন হকিং, ‘এর চরম ফল হবে, শুক্র গ্রহের মতো পৃথিবীর পরিণতি। শুক্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর সেই সঙ্গে সালফিউরিক অ্যাসিডের বৃষ্টি হয় সেখানে।’

গত বছর প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর না করে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তখন তাঁর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন হকিং। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‌‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রমাণগুলো অগ্রাহ্য করে এবং জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষর না করে ট্রাম্প আমাদের প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন। অথচ এটা সহজেই এড়ানো যেত।’

পারমাণবিক যুদ্ধ

এ মুহূর্তে বিশ্বে সক্রিয় পারমাণবিক বোমার সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। হকিংয়ের মতে, পারমাণবিক হুমকি মোকাবিলায় মানুষের সহমর্মিতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, মানুষের সবচেয়ে বর্জনীয় স্বভাব হচ্ছে আগ্রাসী মনোভাব। ‌‘গুহামানবদের সময়ে হয়তো আগ্রাসী মনোভাব বেঁচে থাকতে সাহায্য করত, খাদ্য অন্বেষণে, জায়গা দখলে নিতে কিংবা প্রজননে সঙ্গী নির্বাচনে। কিন্তু এখন এমন আগ্রাসী মনোভাব আমাদের ধ্বংসের কারণ হতে পারে।’ ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গত বছর এভাবে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন হকিং।

জিন প্রকৌশল

বংশগতির সব তথ্যের বাহক হচ্ছে জিন। সব জিনের কী কাজ, তা এখনো বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি। ডিএনএর এক অংশ পরিবর্তন করলে অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। জিন প্রকৌশল প্রযুক্তির ব্যবহারে পাওয়া এসব অনাকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য মানুষের জন্য অকল্যাণকর হতে পারে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকা জিন প্রকৌশল প্রযুক্তির ব্যবহার অ্যান্টিবায়োটিক–প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরির আশঙ্কা তৈরি করেছে।

মৃত্যুর পর প্রকাশিত হকিংয়ের শেষ বই ব্রিফ আনসার টু দ্য বিগ কোয়েশ্চেন–এ তিনি লিখেছেন, ‘আমি নিশ্চিত, এই শতাব্দীতেই মানুষ আগ্রাসী মনোভাবের মতো প্রবৃত্তিগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।’ হকিংয়ের মতে, ‘জিন প্রকৌশল একটি ছোট পরীক্ষাগারেও করা সম্ভব। তবে বিশ্বের প্রতিটি পরীক্ষাগার নিয়ন্ত্রণ বা পর্যবেক্ষণে রাখা সম্ভব নয়, তাই দুর্ঘটনাবশত বা পরিকল্পিতভাবে এমন ভাইরাস সৃষ্টি হওয়া সম্ভব, যেগুলো আমাদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।’ তাই বলে তিনি জিন প্রকৌশলের বিপক্ষে ছিলেন না। হকিং বিশ্বাস করতেন, একসময় মানুষ দূর নক্ষত্রে পাড়ি দেবে, তখন জিন প্রকৌশল প্রযুক্তির ব্যবহার দীর্ঘ মহাকাশযাত্রাকে মানুষের জন্য সহনীয় করে তুলবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

এই শতাব্দীতে মানবসভ্যতায় অনেক গভীর প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় মানুষকে আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন হকিং। মৃত্যুর আগে তিনি একটি খোলা চিঠি স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা সতর্কতার সঙ্গে করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়ছে দিন দিন। শিগগিরই এই প্রযুক্তি ব্যবহার হবে সামরিক ক্ষেত্রে। যুদ্ধের জন্য এ ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারকে অনেকে যুদ্ধক্ষেত্রের তৃতীয় বিপ্লব বলে মনে করছেন। বারুদ আর পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ছিল যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বিপ্লব।

হকিং বলেছেন, একটা পরিপূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরিতে সফল হলে সেটি হতে পারে মানবসভ্যতার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু এর নেতিবাচক ঝুঁকি কমাতে না পারলে সেটাই মানবজাতির সর্বশেষ আবিষ্কার।

নতুন পৃথিবী

হকিংয়ের মতে, পৃথিবী একদিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। তাই মহাশূন্যের বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহে মানুষের স্বাধীন এবং স্বনির্ভর কলোনি তৈরি করা জরুরি। এতে পৃথিবীতে কোনো মারাত্মক দুর্যোগ ঘটে গেলেও মানবজাতির একাংশ অক্ষত থাকবে দূরের কোনো গ্রহে। স্টিফেন হকিং: এক্সপেডিশন নিউ আর্থ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্রে হকিং ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, মহাশূন্যে বসতি স্থাপনের অভিযাত্রায় ব্যর্থ হলে, পরবর্তী শতাব্দীতেই মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

এলিয়েন

ভিনগ্রহের প্রাণীর (এলিয়েন) সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টার ফল ভালো হবে না বলে মনে করতেন স্টিফেন হকিং। যদি এলিয়েনরা পৃথিবী ভ্রমণে আসে, তাহলে পরিণতি হবে কলম্বাসের আমেরিকা অভিযানের মতো। কলম্বাসের অভিযান আমেরিকান আদিবাসীদের ভয়ংকর পরিণতি ডেকে এনেছিল। ২০১০ সালে ডিসকভারি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন হকিং।

এত আশঙ্কা, এত সতর্কবাণী করেছেন ঠিকই, কিন্তু মোটেও হকিংকে হতাশাবাদী বলা চলে না। বিজ্ঞ অভিভাবকের মতো তিনি বলেছেন, ‘আমরা প্রযুক্তির উন্নতি থামাব না অথবা প্রযুক্তির ব্যবহার কমিয়ে দেব না। আমাদের প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িত ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমি আশাবাদী এবং আমার বিশ্বাস আমরা তা পারব।’

লেখক: যন্ত্র ও উৎপাদন প্রকৌশল বিভাগ, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান