নোবেল বঞ্চিত বাঙালির কথা

বছর ঘুরে আবার এল অক্টোবর মাস। আর অক্টোবর মানেই নোবেল পুরস্কার। বহুল প্রতীক্ষিত এ পুরস্কারের অপেক্ষায় গোটা বিশ্বের সবাই। এ সময়ে আরও একবার পড়ে নিন নোবেল বঞ্চিত বাঙালিদের কথা।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু

ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছিল, কোনো এক বাংলাদেশি ডাক্তার নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। পড়ে আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি এ নিয়ে। কারণ, নোবেল পুরস্কার—শান্তি বা বিজ্ঞান যাই হোক, সেটার সিস্টেম জটিল। বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলে মনোনয়নকারী আছেন। তাঁরাই নাম ও সাইটেশন জমা দেন নোবেল কমিটির কাছে। নোবেল কমিটি কোন বিভাগে কত নমিনেশন, সেটা শুধু বলে। তারপর নির্বাচন হয় এবং অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। মনোনয়নপ্রাপ্ত বাকিদের নাম-ধাম একটা সিলগালা খামে করে সংস্করণ করা হয় এবং সেটি পুরস্কারের ৫০ বছর পরে প্রকাশ করা হয়। এর কোনো ব্যতিক্রম নেই!

যাঁরা নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেন, তাঁদেরকে কেউ কেউ চেনেন। যেমন আগে বাংলাদেশ থেকে দুজন পদার্থবিজ্ঞানের জন্য নাম দিতে পারতেন। এর মধ্যে একজন স্যার আর বেঁচে নেই। আরেকজনের খবর আমি ঠিক জানি না। তবে, ওনারা শেষ মনোনয়ন দিয়েছেন সম্ভবত দেড়-দুই দশক আগে। এখন আমাদের দেশে কোনো মনোনয়নকারী আছেন কি না, সেটা আমি ঠিক জানি না।

তবে তাঁরা সবাই ‘ফার্স্ট প্রিন্সিপল’ মানে মুখে কুলুপ রাখাটা মেনে চলেন। যে কারণে ১২১ বছরে নিয়মের কোনো হেরফের হয়নি। একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে অনেক পরিশ্রম ও সময় লাগে। নোবেল কমিটি সেটা পেরেছে বলে বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানীকে তারা অনুপ্রাণিত করতে পারে।

ইতালীর বিজ্ঞানী মার্কনী

তবে আমার দুঃখ লাগছে অন্য কারণে।

এক, ১৯০৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান ইতালীর বিজ্ঞানী মার্কনী। কেন? রেডিও আবিস্কারের জন্য! কিন্তু ১৮৯৪ সালেই আমাদের আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু মিলিমিটার তরঙ্গে বিনা তারে বার্তা প্রেরণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং পাবলিকলি সেটা ডেমোনেস্ট্রেশনও করেন। দুর্ভাগ্যবশত রাজকীয় বিজ্ঞান পরিষদে তাঁর উদ্ভিদের সাড়া দেওয়ার ব্যাপারটা যতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এই বেতারের বিষয়টি সেটা করেনি। ফিরে এসে তিনি আর বেতার নিয়ে ভাবেননি এবং কাজও করেননি। তাঁর কাজের ১০০ বছর পরে আইত্রিপলই আমাদের প্রথম বসুকে বেতারের আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কাজটা যদি আগে হতো, তাহলে আমাদের বিক্রমপুরের রাঢ়ীখাল গ্রামে ১৯০৯ সালে নোবেল পুরস্কার এসে পড়ত।

দুই, ঢাকার শেওড়াতলীর মেঘনাদ সাহা খালি পায়ে স্কুল করতেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মিছিলে থাকায় তাঁর জলপানি আর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রত্ব চলে যায়। পরে কিশোরীলাল জুবিলী স্কুলে পড়ালেখা করেন। প্রথম বসুর নোবেল অপ্রাপ্তির ২ বছর পরে ১৯১১ সালে, যেবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফাইনাল এন্ট্রান্স (ইন্টার) পরীক্ষায় গণিতের প্রশ্ন স্যার আশুতোষ করেছেন, সেবার মেঘনাদ সাহা কলকাতা বোর্ডে তৃতীয় হন। প্রথম হন আমাদের দ্বিতীয় বসু—সত্যেন বসু। সাহার আয়নায়ন তত্ত্ব আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি। এ জন্য সাহা একাধিকবার নোবেল মনোনয়ন পেয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৩৭ ও ১৯৪০ সালে তাকে মনোনয়ন দেন কম্পটন ইফেক্টের আবিষ্কারক প্রফেসর আর্থার কম্পটন (১৯২৭-এর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী)। যা হোক সেবারও আমরা নোবেল পুরস্কার পাইনি। নমিনেশন আর্কাইভে সাহার মোট সাতটি মনোনয়ন দেখলাম। 

মেঘনাদ সাহা

তিন, ২০১৩ সালে পিটার হিগস ও ফ্রাঙ্কো এংলার্ট হিগস ‘বোসন’ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো এই ‘বোসন’ নামটি যে বসু থেকে এসেছে, সেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু কিন্তু নোবেল পুরস্কার পাননি। যদিও নোবেল নমিনেশন আর্কাইভে দেখা যাচ্ছে তিনি মোট ৭ বার মনোনয়ন পেয়েছেন—১৯৫৬, ১৯৫৯, ১৯৬২ (২ জন মনোনয়নকারী), ১৯৬২, ১৯৬৮, ১৯৬৯ ও ১৯৭০। 

চার, কালাজ্বরের চিকিৎসার আবিষ্কারক ডা. উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। তাঁকে দুবার মনোনীত করা হয়—১৯২৯ আর ১৯৪২ সালে।

বাঙালি এ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার পেয়েছে চারবার—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন, মুহম্মদ ইউনুস ও অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়। সাহিত্য, অর্থনীতি ও শান্তি আমাদের হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিজ্ঞানের নোবেলও আমরা পাব, আশা করি।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি