ছাপা বই কি হারিয়ে যাবে

তারা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে!

হীরক রাজার দেশে সিনেমায় রাজার এই নিদারুণ ভয় ছিল। প্রজারা যত বেশি পড়বে, তত জ্ঞানী হবে, তত কম বাধ্যগত হবে। হীরকের রাজা তাই সবচেয়ে বেশি ভয় পেতেন এই বইপত্রকেই, নষ্ট করতে চেয়েছিলেন সব বই। কিন্তু আজকের দিনে কি আর প্রজারা বই পড়ে? আজকের বেশির ভাগ মানুষ জানে, পড়ে, শেখে ইন্টারনেট থেকে; গুগল হলো সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি এখন, স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ হলো জ্ঞানের ভান্ডার। তাহলে কি বই পড়ার দরকার নেই আর? অচিরেই কি কাগজে ছাপা বই হারিয়ে যাবে সভ্যতা থেকে?

তাহলে দেখা যাক মানুষের বুদ্ধি–বিবেচনা–জ্ঞান কিসে বাড়ে বেশি? বই পড়ে, নাকি ইন্টারনেট ঘেঁটে? দুটোই কি সমান অভিঘাত সৃষ্টি করে? বিজ্ঞান কী বলে?

বিশ্ব বই দিবসে হাতে তুলে নিতে পারেন পড়ব পড়ব করেও পড়া না হওয়া চমৎকার কোনো বই
ফাইল ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

আমাদের মস্তিষ্কের দুটি স্তর—হোয়াইট ম্যাটার আর গ্রে ম্যাটার। গ্রে ম্যাটারে তথ্য বা ইনফরমেশন প্রসেস হয়, হোয়াইট ম্যাটার তা সংবহন করে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় নিয়ে যায়। মানে হোয়াইট ম্যাটারের মূল কাজ হলো কমিউনিকেশন। ২০০৯ সালে ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে করা একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, বই পড়লে মস্তিষ্কে হোয়াইট ম্যাটারের পরিমাণ ও ঘনত্ব বাড়ে, ফলে মস্তিষ্কে তথ্য সরবরাহ বা কমিউনিকেশনের কাজটা আরও নিখুঁত হয়। কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের এ গবেষণা প্রকাশিত হয় নিউরন জার্নালে। ‘বই–না–পড়া’ একদল শিশুকে এই গবেষণায় ছয় মাসের নানা ধরনের বই পড়ার অভ্যাসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বই পড়া কর্মসূচি শেষে বিশেষ ধরনের ব্রেন ইমাজিং ডিটিআই টেকনিকের মাধ্যমে মস্তিষ্কের হোয়াইট ম্যাটারের আণুবীক্ষণিক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে।

মানুষের বুদ্ধি–বিবেচনা–জ্ঞান কিসে বাড়ে বেশি? বই পড়ে, নাকি ইন্টারনেট ঘেঁটে? দুটোই কি সমান অভিঘাত সৃষ্টি করে? বিজ্ঞান কী বলে?

বিজ্ঞানীরা বলছেন, একই তথ্য পঠনের মাধ্যমে আর দেখার মাধ্যমে গ্রহণ করার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। ধরুন আপনি একটা সংবাদ পত্রিকায় পড়ছেন কিংবা অনলাইন পেজে দেখছেন—দুটোর মধ্যে তফাত কী? যখন নিউজটি আপনি ছাপা কাগজে পড়বেন, তখন আপনার অনেক বেশি ধৈর্য, মনোযোগ আর ডিটারমিনেশন দরকার হবে। আর যখন একই তথ্য আপনি স্ক্রল করে যাবেন, তখন আপনার মস্তিষ্কের কগনিটিভ স্কিল অতটা দরকার হবে না। কাগজে পড়াশোনা যে শুধু কগনিশন বাড়ায়, তা–ই নয়, এটি মেমোরি বা স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে। পড়াকে মস্তিষ্কের ওয়ার্ক আউট বা এক্সারসাইজ বলা যায়, এতে মস্তিষ্কের নেভিগেশন আর নিউ ইনফরমেশন প্রসেসিংয়ের দক্ষতা বাড়ে। কাগজে ছাপা বই পড়ার মাধ্যমে বয়সজনিত মস্তিষ্কক্ষয় বা বিস্মৃতির ঝুঁকি প্রায় ৩২ শতাংশ কমে বলে নিউরোলজি জার্নালে প্রাকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, কাগজে ছাপা বই পড়ার সময় আঙুল দিয়ে পৃষ্ঠা ওল্টানোর কারণে বিষয়টা আরও বেশি আত্মস্থ হয়, মেমোরাইজ করা যায়, যা ই–বুকে হয় না—এমনটাও দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। নিউরোলজিস্টরা বলেন, আলঝেইমারসের মতো স্মৃতিক্ষয়ী রোগ ঠেকাতে আপনাকে নিয়মিত মস্তিষ্কের ওয়ার্ক আউট করতে হবে। যেমন বইপড়া, দাবা খেলা বা পাজল সমাধান করা, কিন্তু তা স্ক্রিনে করলে লাভ নেই।

সন্তানকে পাশে নিয়ে বই পড়লে সেও আগ্রহী হবে বইয়ের প্রতি
ছবি : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় তৈরি

বই বা কাগজে পড়া কেবল বুদ্ধিমত্তা বা ইনটেলিজেন্স (আইকিউ) বাড়ায়, তা নয়, এটি আমাদের ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স (ইকিউ) বাড়াতেও সাহায্য করে। ফলে আমরা আরও বেশি নিখুঁতভাবে নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারি, মানবিক চিন্তা করতে পারি। ইন্টারনেটে বসে কাউকে নিয়ে ট্রল করা বা হাসি–তামাশা করা যত সহজ, কারও লেখা পড়ে তার উত্তরে লিখে সেটা করা কিন্তু তত সহজ নয়। কারণ, এ কাজে মস্তিষ্কের সময়ক্ষেপণের মধ্যে নৈতিকতা, সহমর্মিতা ও যৌক্তিক চিন্তা করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হয়, যা চট করে হঠকারী কোনো মন্তব্য করা থেকে বাধা দেয়।

একইভাবে বইয়ে পড়া কবিতা বা উপন্যাস আমাদের অনলাইনে পড়ার চেয়ে বেশি আবেগায়িত করে বলে প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। একই কবিতা স্ক্রিনে আর কাগজে পড়ার সময় হৃৎস্পন্দন, মুখের পেশির এক্সপ্রেশন আর হাতের নড়াচড়া মনিটর করে এ প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ভালো ঘুম আর প্রশান্তি এনে দেয় কাগজে ছাপা বই। মায়ো ক্লিনিকের বিজ্ঞানীরা বলছেন, ঘুমানোর আগে ই–বুক, ট্যাবলেট বা মুঠোফোনের স্ক্রিনে পড়াশোনা করা হলে তা ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, কিন্তু একটা বই হাতে নিয়ে ঘুমাতে গেলে ফল হয় উল্টো। সে ক্ষেত্রে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লে আপনার প্রশান্তিময় নিশ্ছিদ্র ঘুম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

তাই ছাপা বই বা পত্রিকা যে অনলাইন ভার্সনের চেয়ে শ্রেয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অদূর ভবিষ্যতে তাই বই হারিয়ে যাবে না, বরং মানুষকে আবার বইয়ের দিকেই ঝুঁকতে হবে।

লেখক: চিকিৎসক ও সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোকোলজি বিভাগ, গ্রিন লাইফ হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ

* লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত