উল্টো পর্যায় সারণি

২০১৯ সালকে ঘোষণা করা হয়েছে পর্যায় সারণি বছর হিসেবে। পর্যায় সারণি ছাড়া এখন রসায়ন পড়ার কথা ভাবাই যায় না। বিভিন্ন মৌল সম্পর্কে অনেক তথ্য উপস্থাপন করে এই সারণি। কিন্তু পর্যায় সারণির কি আরও ভালো কোনো রূপ থাকতে পারে? প্রচলিত পর্যায় সারণিকে যদি ওপরের দিকে উল্টে দেওয়া হয়, তাহলে কি রসায়নের কিছু বিষয় বোঝা সহজ হতে পারে?

সম্প্রতি নেচার কেমিস্ট্রিতে এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেটিতে নটিংহ্যাম, ম্যানচেস্টার ও লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন রসায়নবিদ ও মনোবিজ্ঞানী এই প্রশ্নগুলোই তুলে ধরেছেন। নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন রসায়নবিদ মার্টিন পোলইয়াকফ ও সামান্থা টাং একটু অন্য রকম প্রস্তাব করেছেন। তাঁরা বলেছেন, যদি আনুভূমিকের সাপেক্ষে পর্যায় সারণিকে ১৮০ ডিগ্রি উল্টে দেওয়া হয়, তাহলে সেটার চেহারা অনেকটা গ্রাফের মতো দাঁড়ায়। সেই গ্রাফে বিভিন্ন মান নিচ থেকে ওপরের দিকে বাড়ে। হালকা মৌলগুলো নিচের দিকে এবং ভারী মৌলগুলো ওপরের দিকে রাখলে দেখা যায়, অনেক বৈশিষ্ট্যই নিচ থেকে ওপরের দিকে বাড়ে। যেমন পারমাণবিক সংখ্যা, পারমাণবিক ভর, পারমাণবিক ব্যাসার্ধ, সর্বোচ্চ জারণ সংখ্যা এবং সক্রিয়তা।

মার্টিন পোলইয়াকফ বলেছেন, ‘একজন শিক্ষার্থীর কথা চিন্তা করুন, যে প্রথমবারের মতো শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে লাগানো মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণিটি দেখছে। তার চোখ বরাবর রয়েছে ভারী মৌলগুলো। তার শিক্ষক খুব কমই এসব মৌলের কথা বলেন। শিক্ষক যেসব মৌলের কথা সব সময় বলেন, সেগুলো রয়েছে সারণির একদম ওপরে। পর্যায় সারণির মূল ভিত্তি ইলেকট্রন বিন্যাস। কিন্তু এর বর্তমান বিন্যাস সেটিকেও ঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে না। মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণিতে ওপর থেকে নিচের দিকে মৌলের শক্তিস্তরে ইলেকট্রন যুক্ত হয়। এটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মেলে না। বিকার, পানির গ্লাস, ময়লার ঝুড়ি পূর্ণ হয় নিচ থেকে ওপরে, কিন্তু পর্যায় সারণিতে সেটা হয় ওপর থেকে নিচে।’

তাঁদের মতে, পর্যায় সারণিটি যদি উল্টো করে দেওয়া হয়, তাহলে মৌলগুলোর শক্তিস্তর কীভাবে ইলেকট্রন দিয়ে পূর্ণ হয়, সেটা বোঝা আরও সহজ হবে। এতে মৌলগুলোর আপেক্ষিক অবস্থানে কিন্তু কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। অবাক বিষয় হলো, গত দেড় শ বছরে কেউ এটা করার চেষ্টা করেনি!

এখন ভাবার বিষয় হলো এই উল্টো পর্যায় সারণিকে সবাই কীভাবে গ্রহণ করবে? এটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য মার্টিন দুজন মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নেন। ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালেন পোলইয়াকফ ও লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালেক্সিস ম্যাকিন। তাঁরা এক পরীক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের পর্যায় সারণির ভিন্ন বিন্যাসগুলো সম্পর্কে নিজেদের মতামত দিতে বলেন। একই সঙ্গে তাঁরা আই ট্র্যাকিং প্রযুক্তির মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা পর্যায় সারণির কোন অংশে তাকিয়ে থাকেন, সেটাও পর্যবেক্ষণ করেন। পর্যায় সারণীর অক্ষরগুলো তাঁরা মুছে দেন, যাতে কেউ আগে পর্যায় সারণি দেখে থাকলেও তা পরীক্ষণের ফলাফলে প্রভাব না ফেলে।

ফলাফলে দেখা যায়, অংশগ্রহণকারীরা প্রচলিত পর্যায় সারণিকে নতুনটির চেয়ে কিছুটা বেশি পছন্দ করেন। পর্যবেক্ষণে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা বেশির ভাগ সময় পর্যায় সারণীর মাঝখানের অঞ্চলে তাকিয়ে থেকেছেন। অবশ্য, প্রচলিত পর্যায় সারণিতে তাঁদের দৃষ্টি ছিল ওপরের দিকে এবং উল্টো পর্যায় সারণির ক্ষেত্রে ছিল নিচের দিকে।

অ্যলেন এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘উভয় ক্ষেত্রেই তাঁরা সারণির গুরুত্বপূর্ণ অংশ, হালকা মৌলগুলোর দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। সারণির গঠন থেকে মনে হয়, যেন এরা টেবিলের পায়া। আমরা আমাদের গবেষণায় এমন সব ব্যক্তিকে যুক্ত করেছি, যাঁরা রসায়নে অনভিজ্ঞ। পাশাপাশি রসায়নে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়েও এমন গবেষণা করা প্রয়োজন। আশা করা যায়, এই উল্টো পর্যায় সারণিটির নিয়মিত ব্যবহার যদি করা যায়, তাহলে প্রচলিত পর্যায় সারণিকে বেশি পছন্দ করার প্রবণতা কমে আসবে।’

অ্যালেক্সিস এর সঙ্গে যোগ করেছেন, ‌‘গবেষণার ফলাফল মানুষের পছন্দ সম্পর্কে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। পর্যায় সারণি যাঁরা চেনেন না, তাঁরাও প্রচলিত পর্যায় সারণিটিকেই বেশি পছন্দ করেছেন। এর কারণ হলো, অবচেতন মনে কখনো না কখনো তাঁরা প্রচলিত পর্যায় সারণি দেখেছেন।’

সবশেষে মার্টিন বলেন, ‌‘মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করা বেশ মজার। পর্যায় সারণিটি উল্টো করার ব্যাপারে আমরা বিস্ময়কর রকমের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। আমরা এটাকে কোনোভাবেই “বেশি সঠিক” বলছি না। তবে এর কিছু সুবিধা আছে। এভাবে কোনো কিছুকে একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা সৃজনশীল চিন্তার জন্ম দিতে পারে। আমরা আশা করছি যে সবাই আমাদের প্রস্তাবটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।’

লেখক: বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পয়াডে রৌপ্যপদক জয়ী

সূত্র: নেচার, নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসরিলিজ