শ্রদ্ধাঞ্জলি
রে ব্র্যাডবেরি: এক অব্যর্থ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা!
স্মরণকালের অন্যতম সেরা সায়েন্স ফিকশন লেখক বলা হয় তাঁকে। লিখেছেন ফারেনহাইট ৪৫১, মার্শিয়ান ক্রনিকলস, দি ইলাস্ট্রেটেড ম্যান-এর মতো অদ্ভুত সব কল্পগল্প। তিনি রে ব্র্যাডবেরি। অব্যর্থ এই ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর কাজ নিয়ে লিখেছেন কল্পবিজ্ঞান লেখক তানজিনা হোসেন।
সে এক অদ্ভুত সময়। যখন পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে পৃথিবীর সব বই। এই পৃথিবীতে এখন বই পড়া নিষেধ। যে বাড়িতে বইয়ের অস্তিত্ব মেলে, সেখানে গিয়ে হাজির হয় অগ্নিপুরুষের দল। কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেয় সেই বাড়ি। কেননা সমাজের চোখে বই এক ভয়ানক মারণাস্ত্র। যে এর ব্যবহার জানে, সে একে কাজে লাগিয়ে হাজারো মানুষের চেতনায় আঘাত করতে পারে। তা হতে দেওয়া যায় না। এই সমাজে তাই বই নেই, আছে কেবল ফুর্তি। সুখ। রোমাঞ্চ। গতিময় জীবন। দেয়াল জুড়ে ওয়ালভিশনে সারাক্ষণ যত সব ক্লাউনের দল। জোর গতিতে গাড়ি চালানোর আনন্দ। উত্তেজনাময় খেলার আসর। মানুষ মেতে থাকে সেই সবে। তাই বই পুড়িয়ে ফেলাই ভালো। তবে থাকতে পারে কমিকসের বই, আজেবাজে ম্যাগাজিন। ব্যবসা-বাণিজ্যের খবরওলা বইও থাকুক। স্কুল-কলেজ থেকে শিল্পী, লেখক, পাঠক, সমালোচক, চিন্তাবিদ বের হওয়া বন্ধ হয়ে লম্ফবীর, দৌড়বীর, সন্তরণবীর, উড়ানবীর, ছিনতাইবাজ, দখলদার বের হতে শুরু করলে বুদ্ধিজীবী শব্দটার ব্যবহার বদলে গেল। কেউ কাউকে অশ্লীল গাল দিতে হলে বলে—বুদ্ধিজীবী!
১৯৫৩ সালে লেখা হয়েছে এই বই। ফারেনহাইট ৪৫১। তখনও সোশ্যাল মিডিয়া আসেনি, আসেনি মুঠোফোন। টেলিভিশনে হাজারটা চ্যানেল ঘোরানোর সুযোগ নেই। সেলিব্রেটিরা মগজ দখল করেনি তখনো। প্রযুক্তি আর বাজার মানুষকে খেয়ে ফেলেনি। তখনো মানুষ বই পড়ত। বই লিখিয়ে, বুদ্ধিজীবীদের কদর করত। কিন্তু তখনই তিনি লিখেছিলেন এরকম একটা গা শিউরে ওঠা সায়েন্স ফিকশন।
স্মরণকালের অন্যতম সেরা সায়েন্স ফিকশন লেখক রে ব্র্যাডবেরি। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে তাঁর জন্ম, ১৯২০ সালে। ছোটবেলা থেকেই পড়ুয়া ছেলে। বড় হয়ে নিজেই বলেছেন, লাইব্রেরি আমাকে বড় করেছে, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। সত্যি সত্যি স্কুল কলেজ তাঁকে টানেনি, কিন্তু নিয়ম করে সপ্তাহে তিন দিন যেতেন লাইব্রেরিতে। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় এডগার অ্যালান পো, জুল ভার্ন, এইচ জি ওয়েলসদের সঙ্গে। ১৯৩২ সালে, রে যখন ছোট, একদিন এক কার্নিভালে জাদুকর তাঁর মাথায় ইলেকট্রিক তরবারি ছুঁইয়ে দিয়ে বলেছিল—অনন্তকালের জন্য বাঁচো! ইলেকট্রিক শক খেয়ে মাথার চুলগুলি খাড়া হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট রে-র। তারপর থেকে পরবর্তী ৬৯ বছর ধরে রোজ কিছু না কিছু লিখে গিয়েছেন রে ব্র্যাডবেরি। সেদিনটা ছিল ম্যাজিকের। হ্যাঁ, ম্যাজিকে বিশ্বাস করতেন রে। তাঁর ক্যারিয়ারের শুরু তাই লেখক হিসেবে নয়, বরং ম্যাজিক দিয়ে। যদি লেখক না হতেন, তবে নিশ্চয় হতেন ম্যাজিশিয়ান। তবে সময় বলে দিয়েছে, রে ব্র্যাডবেরির হাত দিয়ে যেসব লেখা বেরিয়েছে, তা ম্যাজিকের চেয়ে কম নয়। বিশ্বের অন্যতম ফ্যান্টাসি ও কল্পগল্প লেখক ধরা হয় তাঁকে। সমালোচকরা তাঁকে বলেন সুররিয়ালিস্ট লেখক। ফারেনহাইট ৪৫১, মার্শিয়ান ক্রনিকলস, দি ইলাস্ট্রেটেড ম্যান-এর মতো অদ্ভুত সব কল্পগল্প আমরা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। যদিও তিনি দাবি করেন, তাঁর লেখা একমাত্র সায়েন্স ফিকশন হলো ফারেনহাইট ৪৫১। মার্শিয়ান ক্রনিকলস বা মঙ্গলগ্রহের ডায়েরিকে তিনি বলতে চান ফ্যান্টাসি। তাঁর মতে, সায়েন্স ফিকশন হলো বাস্তবতার বর্ণনা, আর ফ্যান্টাসি অবাস্তব।
অবাক ব্যাপার যে ফারেনহাইট ৪৫১ বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে, কোথাও কোথাও সেন্সরশিপের খড়গে পড়েছে। সায়েন্স ফিকশনের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা বিরল। কী এমন আছে ওতে, যা মানুষকে, বিশেষ করে শাসক শ্রেণীকে বিব্রত করেছে? বলা মুশকিল। তবে প্রযুক্তি ও বাজার অর্থনীতি যে মানুষের কোমল দিকগুলোকে, সুকুমার বৃত্তিকে ধ্বংস করবে, করে তুলবে চরম ভোগবাদী ও অন্তঃসারশূন্য প্রাণীতে, মানুষ হারিয়ে ফেলবে প্রেম-বাৎসল্য-বন্ধুত্ব নামের অনুভূতিগুলোকে, এর একটা আভাস আছে এই বইতে। বইটির শেষে সেই নাম না জানা শহরটি যে ধ্বংস হয়ে গেল কোনো এক আশ্চর্য বিস্ফোরণের দ্যুতিতে, তার সঙ্গে তুলনা চলে কেবল হিরোশিমা-নাগাসাকির পারমাণবিক বোমার। ‘ছিটকে উঠেছে গোটা শহরটা। একটা চূড়ান্ত অবাস্তব মুহূর্ত জুড়ে বাতাসের গায়ে স্থির হয়ে রইল সেটা। ভয়াল সেই বিস্ফোরণ তাকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়েছে যেন। নতুন রূপটায় তাকে আগের সেই শহরটা বলে চেনা যায় না। তার মাথা অকল্পনীয় উচ্চতা ছুঁয়েছে। মানুষ তাকে যত উঁচু করে গড়েছিল, তার চাইতেও বহু উঁচুতে পৌঁছে গেছে তার চূড়া।’ (ফারেনহাইট ৪৫১: অনুবাদ—দেবজ্যোতি ভট্টচার্য)
দি ইলাস্ট্রেটেড ম্যান অনেকগুলো গল্পের এক সমাহার, যার একটার সঙ্গে আরেকটার মিল নেই, কিন্তু যোগসূত্র আছে। যোগসূত্রটা হলো একজন অদ্ভুত মানুষ, যার সারাটা শরীর উল্কিতে আঁকা। আর সেই উল্কির ছবিগুলো রাতের বেলা পাল্টায়। পাল্টায়, আর একেকটা নতুন নতুন গল্প তৈরি করে। লোকটার পাশে শুয়ে চাদেঁর আলোয় লেখক দেখতে পান আঠারোটা ছবি, আঠারোটা কাহিনি। লোকটার শরীর যেন এক চলমান গ্যালারি। রে ব্র্যাডবেরির ভাষায়, ‘যদি’ হলো এই গল্পগুলোর মূলমন্ত্র। যদি কেউ একটা দূরের জগতে অবতরণ করে শোনে যিশু সেখান থেকে চলে গেছেন অন্য কোথাও তার আগের দিনই? যদি একটা ঘরের মধ্যে একটা জগৎ সৃষ্টি করা যায়, যা মনে হবে পুরোটাই বাস্তব (৪০ বছর পর আমরা এরই নাম দেব ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি)? যদি কোনো একটা লোক হুবহু তার মতো দেখতে একটা রোবট অর্ডার দেয়, আর রাতে ঘুরতে যাবার সময় সেটাকে রেখে যায় স্ত্রীর কাছে? যদি কালো মানুষেরা ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে মঙ্গলে পৌঁছে যায়, সেখানে শেকড় গাড়ে; আর একদিন পৃথিবী থেকে শ্বেতাঙ্গরা রকেটে করে এসে নামলে তারা কীভাবে অভ্যর্থনা জানাবে? এই সব আশ্চর্য ‘যদি’র উত্তর মেলে দি ইলাস্ট্রেটেড ম্যান বইটিতে। যদিও এটাকেও রে সায়েন্স ফিকশন বলতে নারাজ! ( চিত্রবিচিত্র মানুষ: অনুবাদ সুমিত বর্ধন)
রে ব্র্যাডবেরি মারা যান ২০১২ সালের ৫ জুন, ক্যালিফোর্নিয়ায়, ৯১ বছর বয়সে। মৃত্যুর পরদিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক শোকবার্তায় বলেন, তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি আমাদের সংস্কৃতিকে নতুন আকার দিয়েছিল, আমাদের কল্পনার জগৎটাকে বিশাল করেছিল। স্টিভেন স্পিলবার্গ বলেছিলেন, বিজ্ঞান কল্পগল্প, ফ্যান্টাসি আর কল্পনার জগতে রে অতুলনীয়, অমর। তাঁর উপন্যাস ড্যানডেলিয়ন ওয়াইন-এর সম্মানে অ্যাপোলো ১৫-র মহাকাশযাত্রীরা চাঁদের একটি গর্তের নাম রেখেছিলেন ড্যানডেলিয়ন। জীবদ্দশায় অনেক পুরস্কার পেয়েছেন রে। মৃত্যুর পর তাঁর নামে চালু হয় বছরের সেরা সায়েন্স ফিকশন অ্যান্ড ফ্যান্টাসি রাইটার্স অব আমেরিকা পুরস্কার, পরে যা নেবুলা পুরস্কার হিসেবে খ্যাত হয়।
ফারেনহাইট ৪৫১-তে এমন এক জগতের বর্ণনা করেছেন রে ব্র্যাডবেরি, যেখানে লোকে বই পড়ে না, বরং মজে থাকে ওয়ালভিশন আর ভার্চ্যুয়াল জগতে। তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন তিনি, জগতে বই পোড়ানোর চেয়েও বড় অপরাধ আছে। তার মধ্যে একটা হলো বই থাকতেও তা না পড়া!
মৃত্যুদিবসে পৃথিবীর অন্যতম সেরা এই কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসি লেখককে শ্রদ্ধা।
লেখক: চিকিৎসক, গ্রিনলাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা