ভাষার উত্পত্তি নিয়ে অনেকগুলো মতবাদ আছে। ‘বও-ওও’ তত্ত্ব বলে, আদিম মানুষ প্রথমে প্রাণী ও পাখির শব্দ শুনে অনুকরণ করতে থাকে। এখান থেকে একসময় ভাষার জন্ম হয়েছে। ‘ডিং-ডং’ তত্ত্ব বলে, বিভিন্ন বস্তু থেকে যেসব শব্দ তৈরি হয়, সেগুলো প্রথম ভাষা তৈরির প্রধান উপকরণ ছিল। ‘লা-লা’ তত্ত্ব, ‘পু-পু’ তত্ত্ব আর ‘ইয়ে-হে-হো’ তত্ত্ব বলে, আনন্দ ও দুঃখ প্রকাশে মানুষের মুখ থেকে অনেক ধরনের শব্দ বের হয়; এসব শব্দ বা আওয়াজ থেকে ভাষার ধ্বনির সৃষ্টি। ভাষার উত্পত্তির বিষয়টি খুব জটিল। এ শুধু অনুমান করা যায়; সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করা যায় না। প্যারিসের ভাষা সমিতি ১৮৬৬ সালে তাই ভাষার উত্পত্তি নিয়ে কোনো গবেষণা, লেখা ও পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
মানুষ কীভবে ভাষা শেখে
মানবশিশু কেমন করে ভাষা বলতে শেখে, তা ভাষাবিজ্ঞানীদের কাছে চরম কৌতূহলের ব্যাপার। চিকিত্সাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে কাজ করে চলেছেন। জাদুকরের হাতে অনেক সময় একটা রহস্যময় কালো বাক্স থাকে; ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি মনে করেন, মানুষের মস্তিষ্ক সেই রহস্যময় কালো বাক্সের মতো। সেখানে কীভাবে ভাষা আয়ত্ত করার ব্যাপারটি ঘটে, তা ব্যাখ্যা করা কঠিন। মাতৃভাষায় কথা বলতে শেখার ও শেখানোর জন্য আলাদা করে প্রশিক্ষণের দরকার হয় না; মানবশিশু এমনিতেই তা পারে। একই উপায় কাজে লাগিয়ে মানুষ এখন দ্বিতীয় ভাষা শেখার চেষ্টা করছে। স্রেফ, কোনো ভিন্ন ভাষিক পরিবেশে কাউকে কয়েক মাসের জন্য রেখে দিলে মানুষটি নতুন ভাষায় কথা বলতে শুরু করবে।
মানুষের ভাষা আছে
মানুষ একমাত্র প্রাণী, যার ভাষা আছে। তবে ভাষাকে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে বলা হয় ‘যোগাযোগের মাধ্যম’। সে ক্ষেত্রে জীবজগতে অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও ভাষা আছে বলতে হয়। মজার ব্যাপার হলো, অন্য কোনো প্রাণী তার ভাষা বানায়নি; অথচ মানুষ তার ভাষা বানিয়েছে। ভাষা কিছু সূত্র মেনে চলে; সেই সূত্রও তৈরি করে নিয়েছে মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় নানা রকমের ভাষা দেখা যায়; কিন্তু সব ভাষাই কিছু সাধারণ সূত্র মেনে চলে। মানুষের ভাষা মুখে উচ্চারণের ও কানে শোনার ব্যাপার। আবার অনেক ক্ষেত্রে তা লেখা ও চোখে দেখার ব্যাপার। এ ছাড়া আঙুলের ভঙ্গিতে ইশারা ভাষায় ও আঙুলের স্পর্শে ব্রেইল ভাষায় ভাব প্রকাশের আলাদা উপায় রয়েছে।
ভাষার সংখ্যা, ভাষার বয়স
পৃথিবীতে বর্তমানে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি ভাষা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো ভাষা কোনটি, এর উত্তরে আসতে পারে ব্যাবিলনীয়, সংস্কৃত বা মিসরীয় ভাষার নাম। এগুলো পৃথিবীর পুরোনো ভাষাগুলোর মধ্যে আছে; তবে এসব ভাষার বয়স পাঁচ-ছয় হাজার বছরের বেশি নয়। অধ্যাপক টলারম্যান মনে করেন, পৃথিবীর আদিতম ভাষার খোঁজে বের হলে আমাদের অন্তত ৫০ হাজার বছর পেছনে যেতে হবে। কোনো কোনো ভাষাবিজ্ঞানীর মতে, ভাষার উত্পত্তির খোঁজে আমাদের পাঁচ লাখ বছর আগে যেতে হতে পারে। তবে এরপরও ভাষার প্রকৃত বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এমনকি দূর ভবিষ্যতে কোন কোন ভাষা বেঁচে থাকবে কিংবা তখন ভাষার ধরন কেমন হবে, কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না।
ভাষার সংখ্যা বাড়ছে না কমছে
১৯৫০ সাল থেকে লক্ষ করা গেছে, পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা কমছে। এখন পৃথিবীর ৪০ শতাংশের বেশি ভাষা বিপন্ন। এই হিসাবে প্রায় তিন হাজার ভাষা বিপন্নের তালিকায় আছে। আগামী ১০০ বছরে বর্তমান ভাষাগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়। বছরে গড়ে পৃথিবীর নয়টি ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে। তবে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে ভাষার সংখ্যা বাড়ছে। যেমন অহমিয়া ভাষা ষোড়শ শতকে বাংলা ভাষা থেকে আলাদা হয়ে গেছে। কোন পর্যায়ে একটি ভাষাকে আলাদা ভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া যাবে, এর কোনো ভাষাবৈজ্ঞানিক মাপকাঠি নেই। আবার কোন পর্যায় পর্যন্ত একটি ভাষাকে আরেকটি ভাষার উপভাষা বলা হবে, এরও কোনো সুনির্দিষ্ট বিচারকাঠি নেই।
ভাষার উত্পত্তি
দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে গিয়ে ভাষার উত্পত্তি হয়েছিল। আদিম মানুষ অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে গিয়ে মুখ দিয়ে নানা রকম ধ্বনি তৈরি করেছে। একই রকম ধ্বনিগুচ্ছ একসময় একই রকম অর্থ প্রকাশক শব্দ হয়ে উঠেছে। তবে মুখের ভাষা আর লেখার ভাষা একভাবে জন্ম নেয়নি। লেখার ক্ষেত্রে চিত্রলিপি থেকে আধুনিক লিপির উত্পত্তি হয়ে থাকবে। আর মুখের ভাষার ক্ষেত্রে অর্থহীন ধ্বনির সমন্বয়ে অর্থযুক্ত শব্দ তৈরি হয়েছিল। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান অবশ্য বলে, শব্দেরও কোনো অর্থ নেই; আমরা অর্থ ধরে নিই মাত্র। যেমন ‘গোলাপ’–এর নাম ‘গরু’ হতে পারত; তখন গোলাপকে ‘গরু’ বলেই সম্বোধন করতাম।
ভাষার ভিন্নতা
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে যেতে থাকে। ফলে ভাষার রূপবৈচিত্র্য তৈরি হতে থাকে। তবে শুরুতে মানুষের একটি ভাষা ছিল, এই ধারণা এখন পর্যন্ত করা হয়। তবে সেটি কোনটি, তা হয়তো কোনো দিন জানা সম্ভব হবে না। এশিয়া ও ইউরোপের অসংখ্য ভাষার মধ্যে মিল দেখে মানুষ ধারণা করেছে, এসব ভাষা বুঝি একই আদিভাষা থেকে জন্মলাভ করেছে। এই আদিভাষার নাম দেওয়া হয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। এটি একটি কাল্পনিক ভাষাবংশেরও নাম, যেখান থেকে বাংলা-ইংরেজিসহ পৃথিবীর বহু গুরুত্বপূর্ণ ভাষার জন্ম হয়েছে। এ রকম অনেকগুলো ভাষাবংশ নির্ধারণ করেছে মানুষ, যেগুলো থেকে পৃথিবীর সব ভাষার জন্ম হয়েছে বলে ধরা হয়। পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের ভাষাগত মিল নিয়ে প্রথম কথা বলেন উইলিয়াম জোন্স, ১৭৮৬ সালে।
ভাষার মৃত্যু
ভাষা বেঁচে থাকে মানুষের মুখে। ভাষা কাগজে বা লেখার অন্য কোনো মাধ্যমেও বেঁচে থাকে; তবে সে ক্ষেত্রে ওই ভাষার লিখিত রূপ থাকতে হয়। কোনো ভাষার একজন ব্যবহারকারীও যদি বেঁচে না থাকে, তবে বলা হয়, ভাষাটির মৃত্যু হয়েছে। কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাষা বেঁচে থাকে। কোনো ভাষার ব্যবহার বাড়লে ভাষার পরিবর্তনের সম্ভাবনাও বাড়ে; একই সঙ্গে ভাষার আয়ুও বাড়তে থাকে। আবার কোনো ভাষার ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়লে সেই ভাষার রূপবদলের সুযোগ কমে যায়; একই সঙ্গে ভাষার আয়ুও কমতে থাকে। ভাষা-আধিপত্যের সচেতন প্রভাবেও ভাষার মৃত্যু হয়।
ভাষার আধিপত্য
আধুনিক যুগে পৃথিবীর মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। ফলে এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় সহজেই ঢুকতে পারে। শুধু শব্দ নয়, ভাষায় অন্য উপাদানও এক ভাষা আরেক ভাষা থেকে গ্রহণ করে। এটাকে ভাষাবিজ্ঞানে বলা হয় ‘অ্যাডস্ট্রাটাম’। অর্থাৎ অন্য ভাষার উপাদান মূলভাষায় অ্যাড হয় বা যুক্ত হয়। যেমন বাংলা ভাষায় ইংরেজি ভাষার অনেক শব্দ ও সূত্র প্রবেশ করেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে, একই সময়ে একটি অঞ্চলে দুটি ভাষা বিদ্যমান থাকতে পারে। একে বলে সাবস্ট্রাটাম। যেমন ফরাসি উপনিবেশের কালে আলজেরিয়ায় আরবি ও ফ্রেঞ্চ দুটি ভাষাই সমানভাবে চালু ছিল। আবার ‘সুপারস্ট্রাটামের’ ক্ষেত্রে, এক ভাষার প্রবল প্রতাপে স্থানীয় ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যায়। যেমন পতুর্গাল আর স্পেনের উপনিবেশের কারণে লাতিন আমেরিকার স্থানীয় ভাষাগুলো জায়গা হারিয়েছে; সেখানে জায়গা দখল করেছে পর্তুগিজ আর হিস্পানি।
ভাষার রাজনীতি ভাষার অর্থনীতি
ভাষার রাজনীতি আছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দেশগুলো ভাষাকে উপনিবেশের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আবার অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া দেশগুলোর ভাষা শেখার ব্যাপারে অন্য দেশগুলোর আগ্রহ তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে দুটি ভাষা মিলে একটি মিশ্র ভাষার জন্ম হয়, যেটিকে বলে পিজিন ভাষা। পিজিন ভাষা কোনো ব্যাকরণ মেনে চলে না। তবে দীর্ঘদিনের ব্যবহারে পিজিনের মধ্যে ব্যাকরণ বা ভাষাসূত্র তৈরি হয়ে যায়। ফলে পিজিন ভাষায় অভ্যস্ত অঞ্চলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জন্ম হয় ক্রেওল ভাষার। অর্থাৎ দীর্ঘদিনেরর ব্যবহারে পিজিন হয়ে ওঠে ক্রেওল। নতুন প্রজন্ম ক্রেওলকেই তাদের মাতৃভাষা হিসেবে মনে করে।
এক পৃথিবী এক ভাষা
ভিসামুক্ত পৃথিবীর কথা অনেকে বলে থাকেন। একইভাবে পৃথিবীর সব মানুষের জন্য একটি সাধারণ আন্তর্জাতিক ভাষার দাবি রয়েছে অনেকের। ভাষার বিশ্বায়নের ধারণা থেকে ‘এসপেরান্তো’ নামের একটি কৃত্রিম ভাষা বানানো হয়েছে। পোল্যান্ডের চিকিৎসক লুদভিক জামেনহফ এই ভাষা বানিয়েছেন ১৮৮৭ সালে। বর্তমানে অন্তত ২৫ লাখ মানুষ এসপেরান্তো ভাষায় কথা বলে। এ ভাষায় শব্দের উচ্চারণ, বানান ও ব্যাকরণ খুব সহজ। এসপেরান্তো-ভাষীরা মনে করে, মাতৃভাষার বাইরে মানুষের এই একটি ভাষা জানলেই চলবে। আর পৃথিবীর সব মানুষের জন্য সেই ভাষা হবে অভিন্ন।
ভবিষ্যতের ভাষা
ভবিষ্যতে কি একটি ভাষা থাকবে? এর উত্তরে বলা হয়, এটি হতে পারে। যদি কোনো শ্রবণপ্রতিবন্ধী ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী না থাকে, আর সবাই যদি যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইশারা ভাষা ব্যবহার করে, তবে পৃথিবীতে একটি ভাষা থাকবে। নইলে অন্তত দুটি ভাষা থাকবে। পৃথিবীর বর্তমান বড় ভাষাগুলোর মধ্যেও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটবে। প্রথমত, প্রচলিত বাগ্ধারা ও প্রবাদজাতীয় বাক্যের জায়গায় তৈরি হবে নতুন বাগ্ধারা ও প্রবাদজাতীয় বাক্য। ইংরেজি ভাষা আরও বেশি ব্যবহৃত ভাষা হবে। ওয়াশিংটন পোস্ট বছর দুয়েক আগে মন্তব্য করেছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রভাববিস্তারকারী ভাষার মধ্যে হিস্পানি, পর্তুগিজ, আরবি ও রুশ ভাষার পরে অবস্থান হবে হিন্দি, বাংলা, উর্দু ও ইন্দোনেশীয় ভাষার। আর প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা হিসেবে ‘পাইথনের’ ব্যবহার তো দিন দিন বাড়ছেই।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়