সাক্ষাৎকার

বিজ্ঞানের মতো মজা আর কিছুতে নেই—নিরুপম আইচ, ন্যানো প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী

নিরুপম আইচ ন্যানো প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি নেব্রাস্কা, লিংকনে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। পরিবেশবান্ধব ন্যানোপ্রযুক্তি, নতুন ধরনের বিভিন্ন দূষক থেকে পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ন্যানোপদার্থনির্ভর ফিল্টার নিয়ে গবেষণা করছেন। বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সঙ্গে যুগ্ম গবেষণার পাশাপাশি সুপারভাইজ করেন শিক্ষার্থীদের। সম্প্রতি এসেছিলেন বিজ্ঞানচিন্তা কার্যালয়ে। সে সময় তাঁর সাক্ষাৎকার নেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার ও সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ

বিজ্ঞানচিন্তা:

আশা করি, ভালো আছেন। আপনার শৈশব-কৈশোর থেকে শুরু করে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে যে গবেষণা করছেন—এই পুরো যাত্রা নিয়ে শুনতে চাই। কীভাবে শুরু করলেন, কেন শুরু করলেন, সংক্ষেপে বলুন।

নিরুপম আইচ: এটা তো অনেক বড় জার্নি। আমি বড় হয়েছি ঢাকায়। আমরা আসলে যমজ ভাই। আমার ভাই অনুপম আর আমি নিরুপম। মা–বাবা দুজনই শিক্ষক। বাবা ছিলেন নবকুমার স্কুলের শিক্ষক। তাঁরা দুজনই উদ্ভিদবিদ্যায় মাস্টার্স করেছেন। তাঁরা জীববিজ্ঞান ও গণিত পড়াতেন। মা পিএইচডি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে। ওটাই তাঁর সর্বোচ্চ ডিগ্রি। সরকারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন উদ্ভিদবিদ্যার। মা যেহেতু পিএইচডি করেছেন, আমাদেরও ওটা করতে হতো একপর্যায়ে গিয়ে।

পড়াশোনা বলতে প্রথমে ঢাকার উদয়ন স্কুলে পড়লাম। তারপর নটর ডেম কলেজে। এরপর দুজনে একসঙ্গে বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়লাম। রসায়ন পছন্দ ছিল, সে জন্য কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। কিন্তু কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গিয়ে দেখলাম, ওখানে রসায়নের চেয়ে গণিত বেশি। আমার জন্য এটা ছিল বিস্ময়কর।

পড়া যখন শেষ হলো, ২০০৯ সালের কথা, তখন বুঝতে পারছিলাম না কী করব। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির খোঁজখবর নিতে গিয়ে দেখলাম, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও সংশ্লিষ্ট আর কী কী বিষয় আছে। তখন ন্যানোপ্রযুক্তি নিয়ে পরিবেশবিষয়ক গবেষণাসহ আরও অনেক কিছু দেখলাম। আমাদের আন্ডারগ্র্যাডের থিসিস ছিল দুজনের একসঙ্গে। আমার আর আমার ভাইয়ের, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট নিয়ে। আগে এরকম কোনো কাজ আমরা করিনি সেভাবে। কারণ, রিসার্চ ফ্যাসিলিটি তেমন ছিল না বুয়েটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হতো। বুয়েটে সে রকম গবেষণা হতো না। তারপর ওখানে যাওয়ার সময় পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখলাম, রসায়নের বিষয়গুলোও দেখলাম। আমার এক বন্ধু অনেক পড়াশোনা করত। বই, বিশেষ করে পাঠ্যবইয়ের বাইরে অনেক বই পড়ত। ওর নাম আশরাফ আলী। সে বলল, ‘ন্যানোটেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা কর।’ তখনই প্রথম ন্যানোটেকনোলজির কথা শুনলাম। মানে ন্যানোপ্রযুক্তি। দুজন খুঁজেটুজে আবেদনও করলাম।

তারপর ভাগ্য—সৌভাগ্য। আমার অ্যাডভাইজার যিনি সাউথ ক্যারোলাইনায় ছিলেন, তিনি বুয়েট থেকে পাস করেছেন, পরিবেশবিষয়ক ন্যানোপ্রযুক্তি নিয়েই তাঁর কাজ। সেই যে যোগাযোগ হলো, এখন পুরো ইতিহাস বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। তাতে আর না যাই। কিন্তু যোগাযোগটা এমনভাবে হলো যে উনি আমাকে পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে নিলেন। সেখান থেকে আমার কাজ শুরু। আর আমার ভাই পরে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করে। মানে বায়োকেমিস্ট্রি, বায়োমলিকুলার ইঞ্জিনিয়ারিং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে।

আমি ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনায় ছিলাম। সেখানে মাস্টার্স শেষ করি। পরে আমার অ্যাডভাইজার আমাদের পুরো দল নিয়ে চলে এলেন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিনে। ওখান থেকে পিএইচডি শেষ করলাম এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ২০১৬ সালে যোগ দিলাম ইউনিভার্সিটি অব বাফেলোতে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর (সহকারী অধ্যাপক) হিসেবে। আর এখন, মানে কিছুদিন আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কা-লিংকনে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর (সহযোগী অধ্যাপক) হিসেবে যোগ দিলাম। সংক্ষেপে এই হলো আমার গল্প।

বিজ্ঞানচিন্তা হাতে বিজ্ঞানী নিরুপম আইচ
ফাইল ছবি
বিজ্ঞানচিন্তা:

পরিবেশদূষণ রোধে বা পরিবেশ রক্ষায় আপনারা ন্যানোপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন। বিষয়টা সহজভাবে পাঠকদের জন্য বলুন।

নিরুপম আইচ: খুব সহজ করে বলি, আমরা ফিল্টার করা পানি ব্যবহার করি, পানি ফিল্টার করে খাই। কিন্তু ফিল্টার তো কোনো না কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি। আমরা এটাকে আরও উন্নত করতে কাজ করি। কারণ, নতুন নতুন পানিদূষণের উপাদান আসছে, তৈরি হচ্ছে। যেমন টেফলন বা ননস্টিক কুকিং প্যান থেকে কিছু ক্ষতিকর রাসায়নিক বের হয়। ওগুলো পানি থেকে সরানো খুব কঠিন। তাই আমরা সেগুলো সরাতে পারে, এ রকম নতুন ধরনের ফিল্টার বানাতে চেষ্টা করেছি। নতুন ধরনের ন্যানোপদার্থ বা অন্য যেসব পদার্থ তৈরি হচ্ছে, সেগুলো কাজে লাগাচ্ছি এ ক্ষেত্রে। এসব পদার্থ আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। কারণ, এগুলো খুব ক্ষুদ্র। কিন্তু আমরা এগুলো ঠিকই ব্যবহার করি। ধরুন, এগুলো দিয়ে আমরা নতুন ধরনের ফিল্টার বানালাম। আমরা চাই, ওই ফিল্টার পানি থেকে শুধু রাসায়নিক সরাবে না, বরং ধ্বংস করে ফেলবে। আবার হয়তো দেখা গেল, প্রচলিত পদার্থগুলো কাজ করছে না। আমরা তখন নতুন ধরনের পদার্থ দিয়ে ফিল্টার বানালাম। এই ফিল্টার আবার নতুন ধরনের দূষক কেমিক্যালগুলো সরাতে সাহায্য করবে। খুব সহজ করে বললে আমরা নতুন ধরনের ফিল্টার বানাতে চেষ্টা করছি। এটি হচ্ছে একটি।

আরেকটি হচ্ছে, নতুন রাসায়নিকগুলো যদি ব্যাকটেরিয়া ভেঙে ফেলে, ওটা যদি ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে নিজেই প্রাকৃতিক নিয়মে ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু এসব রাসায়নিক ওভাবে ভাঙে না। আমরা চেষ্টা করি, ন্যানোপদার্থ বা ন্যানোপ্রযুক্তি দিয়ে ওগুলোকে কিছুটা দুর্বল করে দিতে। রাসায়নিক বন্ধন দুর্বল করে দিতে পারলে, কিছুটা ভেঙে দিলে ব্যাকটেরিয়া নিজে বাকিটা করতে পারে। এটি আরেক ধরনের কাজ। এ দুটি বড় কাজ করার চেষ্টা করছি আমরা।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার কি দেশে ফেরার পরিকল্পনা আছে?

নিরুপম আইচ: দেশে ফেরার, মানে চাকরি নিয়ে ফেরা বা পরিবার নিয়ে, সে রকম পরিকল্পনা নেই। তবে কাজের ক্ষেত্রে আমরা কোলাবরেশন আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছি যেমন বুয়েটের সঙ্গে আমরা এখন—আসলে ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কায় বুয়েটের আমরা তিনজন আছি। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুজন আর আমি এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের। আমরা চেষ্টা করছি বুয়েটের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কার ভালো কোলাবরেশন তৈরি করতে। আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি, এমওইউ সাইন (চুক্তি স্বাক্ষর) করে যদি ভালোভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ শুরু করা যায়। আমি এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (পরিবেশ কৌশল) দিকে আছি, কাজ করছি। আর দুজন যাঁরা আছেন—রাজীব সাহা ও সুহৃদ দিশারি। তাঁরা কাজ করেন হেলথ (স্বাস্থ্য) ও এনার্জি (শক্তি) সেক্টরে—রিনিউয়েবল এনার্জি সেক্টরে। আর আমার স্ত্রী উপমা গুহ। ও কাজ করতে চায় বাংলাদেশে। ডেন্টাল ফিল্ডে (দাঁত নিয়ে)। সব মিলিয়ে চিন্তাভাবনা হলো, আমরা কীভাবে সাহায্য করতে পারি। শুধু সাহায্য নয়, বিভিন্নভাবে যেন দেশের কাজে লাগি।

বিজ্ঞানী নিরুপম আইচ
ফাইল ছবি
বিজ্ঞানচিন্তা:

আচ্ছা। আপনারা কোলাবরেশন যেটা করছেন, এটা তো অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় এটা বড় প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে কি আর কিছু করার পরিকল্পনা আছে?

নিরুপম আইচ: আসলে আমরা তো অনেক দিন বাইরে, তাই আমাদের জানতে হবে এখানে কী ধরনের গবেষণা হচ্ছে। সে কারণে বললাম, আমরা বেশি বেশি আসার চেষ্টা করব, যেন সহজে জানা যায়। আমরা মোটামুটি জানি, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে আমাদের ফিল্ডগুলোতে কী ধরনের পড়াশোনা হচ্ছে। অবশ্য সেটা মূলত বুয়েটকেন্দ্রিক। অন্যান্য ক্ষেত্রে কী রকম কাজ হচ্ছে, সেটা জানলে পরিকল্পনা করা যাবে, কীভাবে কন্ট্রিবিউট করা যায়। এখনো পরিকল্পনা করা হয়নি সেভাবে, কিন্তু ইচ্ছা আছে। এগুলো ভালোভাবে জানলে আমরা ধীরে ধীরে এ নিয়ে কাজ করতে পারব।

আসলে গভীরভাবে চিন্তা করতে শেখা খুব জরুরি। কিন্তু গবেষণার সুযোগ না বাড়লে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট বা ব্যাচেলর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা কীভাবে গভীরভাবে চিন্তা করবেন? এটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

কিছু ক্ষেত্রে এই বদল শুরু হয়েছে। গত ১৩ বছরে আমরা দেখছি, একটা নতুন জোয়ার এসেছে। যাঁরা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট, তাঁরা গবেষণা করছেন। শিক্ষকেরা অনেক সাহায্য করছেন। বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সেগুলো যদি দূর করা যায়, সে ক্ষেত্রে হয়তো আরও ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে শিক্ষার্থীদের। আমরা ভাবছি, ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কা এবং বুয়েটের মধ্যে এ রকম কোলাবরেশন করে আরও কী কী করা যায়। ওখানকার শিক্ষার্থীদের যে প্রশিক্ষণ দিই, সেগুলো এখানকার শিক্ষার্থীদেরও আমরা দিতে পারি। শিক্ষকদের আমরা ওসব জায়গায় সাহায্য করতে পারি কি না, সেই চেষ্টাও করছি। রিসার্চ মেথডোলজি (গবেষণার পদ্ধতি) শেখানো বা যন্ত্রপাতি হয়তো আনা হয়েছে। কিন্তু সেটা কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেই প্রশিক্ষণ হয়তো নেই। আমরা চিন্তা করছি, ওখান থেকে কোলাবরেশনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কাজ করানো যায় কি না। কিন্তু সমস্যা হলো, যথেষ্ট ফান্ডিং থাকে না। অনেক জায়গায় নতুনভাবে ল্যাব সেটআপ হচ্ছে, সেই ইনফ্রাস্ট্রাকচার (অবকাঠামো) বুয়েট কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আছে, এটা আমি জানি। অন্য বিভাগগুলোতে আছে কি না, তা আমি ভালো জানি না। বুয়েটের কথাও এ কারণে বলা। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে আমার অতটা ধারণা নেই। তবে অনেক জায়গাতে সেই অবকাঠামো বা সিস্টেম এখনো নেই।

আমরা ওখানে (যুক্তরাষ্ট্রে) হাইস্কুলে যাই। হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের আমাদের ল্যাবে নিয়ে আসি। তাদের দেখাই, কীভাবে কাজ করতে হয়। অনেক সময় হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের ল্যাবে তিন মাসের জন্য রাখা হয়। এতে তারা উদ্বুদ্ধ হয়। বাংলাদেশে এখন কিছুটা হচ্ছে। প্রথম আলো অনেক কিছু করছে, যেমন গণিত অলিম্পিয়াড, ফিজিক্স অলিম্পিয়াড।

আমাদের সময় অলিম্পিয়াড অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ২০০০ সালের দিকে গণিত অলিম্পিয়াডসহ বিভিন্ন অলিম্পিয়াড শুরু হয় দেশে। অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের এই সাফল্য একবারে হয়নি। এটা অনেক বছরের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। আমার মনে হয়, সে রকম উদ্যোগ নেওয়া গেলে কাজ করা যাবে। এখানে ল্যাব ফ্যাসিলিটি দরকার হচ্ছে না হয়তো। কিন্তু যখন আমাদের ফিল্ডগুলোর কথা বলছি, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কথা বললে সেখানে ল্যাব প্রয়োজন। সে রকম ল্যাবের সুবিধার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে হবে। আমরা হয়তো চেষ্টা করতে পারব। কিন্তু এ প্রোগ্রামগুলো বাংলাদেশে এখনো সেভাবে নেই। অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা অনেকটা একাই এ রকম একটা প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু ওটা শুধু একটা। এ রকম আরও অনেকে আছেন আগ্রহী। তাঁরা দেশে ফিরে সেঁজুতি সাহার মতো কাজ করতে চান। আমরা হয়তো এ রকম ফুলটাইম কাজ করতে পারব না। কিন্তু আমরা শুরু করতে চাই।

দেশে সায়েন্স ফেয়ার হয়। কিন্তু সায়েন্স ফেয়ার তো এক দিন। এতে কি বড় পরিসরে কিছু হচ্ছে? আউটরিচ প্রোগ্রাম হওয়া প্রয়োজন।
বিজ্ঞানচিন্তা:

বাংলাদেশে বিজ্ঞান জনপ্রিয় করতে, মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে কী করা উচিত বলে মনে করেন?

নিরুপম আইচ: এটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ টানছি। কারণ, আমি ওখানে থাকি। ওখানে কী হচ্ছে, তা দেখি। তাই বলছি, ওখানে যে শিক্ষা—প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিগুলোর (সহশিক্ষা কার্যক্রম) মধ্যে আমরা বিজ্ঞানও রাখি। তাদের যেমন সামার ক্যাম্প থাকে, শিক্ষার্থীরা সামার ক্যাম্পে যায়। কিন্তু দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য এ রকম কী আছে, আমি জানি না। সে রকম কিছু থাকলে খুব ভালো হয়।

দেশে সায়েন্স ফেয়ার হয়। কিন্তু সায়েন্স ফেয়ার তো এক দিন। এতে কি বড় পরিসরে কিছু হচ্ছে? আউটরিচ প্রোগ্রাম হওয়া প্রয়োজন। আউটরিচ প্রোগ্রামগুলো করা হয় শিশুদের নিয়ে যেমন আমি কিছুদিন আগে এ রকম একটা (প্রোগ্রাম) করলাম। ওয়াটার ফিল্ট্রেশন (পানি ফিল্টার করা) কীভাবে হয়, সেটা নিয়ে। শুধু তা–ই নয়, আমরা দেখাই কী কী দিয়ে ফিল্টার বানানো হয়। তখন একটা ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করানো হয়। তারা তিন স্তরের ম্যাটেরিয়াল সাজায়। কোনটা কীভাবে সাজাবে, তারা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখে। তারা হয়তো একভাবে করে দেখায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পানি পরিশোধন হচ্ছে না। তখন আরেকভাবে করে দেখে, হচ্ছে কি না। দেখে, পানি পরিশোধিত হচ্ছে। তখন তারা শেখে—আচ্ছা, এ কারণে হচ্ছে। এ ধরনের অ্যাকটিভিটি কিন্তু খুব বেশি কঠিন নয়। এগুলো যদি স্কুল থেকে শেখানো যায়, তাহলে ভালো। যেভাবে অলিম্পিয়াড হচ্ছে, প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, সে রকম করে যদি এসব অ্যাকটিভিটি করা যায়—প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকটিভিটি (হাতে-কলমে), সেগুলো অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। আসল কথা হলো, সরাসরি প্রশিক্ষণ না দিয়ে তাদের মজা করতে দিতে হবে। তাদের বুঝতে দেওয়া যাবে না যে ট্রেনিং হচ্ছে। তারা নিজেরাই দেখে উৎসাহিত হবে। খেলার ছলে যদি কিছু করা যায় আরকি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি কি বই পড়েন? অবসরে কি বই পড়ার সময় পান?

নিরুপম আইচ: সত্যি বলতে আমার বই পড়ার অত সময় হয় না। কারণটা সম্ভবত আমার সব সময় মনে পড়ে ইন্টারমিডিয়েটে (উচ্চমাধ্যমিকে) ‘পাঠকের মৃত্যু’ নামে (বনফুলের) একটা গল্প ছিল। আমারও বোধ হয় সে রকম হয়েছে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

কাদের লেখা পড়তেন কৈশোরে?

নিরুপম আইচ: মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা পড়তাম। কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা, রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা পড়তাম। শুরু হয়েছিল তিন গোয়েন্দা দিয়ে। এরপর সায়েন্স ফিকশন, মূলত জাফর স্যারের লেখা। এ ছাড়া নানা রকম বই পড়েছি তখন; মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনেক বই পড়েছি।

আমার মনে হয়, বই পড়া একধরনের এক্সারসাইজের মতো। কারণ, বই পড়ে আপনাকে ভিজ্যুয়ালাইজ করতে হচ্ছে মাথার ভেতরে।
বিজ্ঞানচিন্তা:

বই আমাদের কেন পড়া উচিত? আপনি কী মনে করেন? শৈশবে বই পড়ার কোনো ফল কি কর্মক্ষেত্রে পেয়েছেন?

নিরুপম আইচ: অবশ্যই। বই না পড়লে হয়তো আমার মনে এত কৌতূহল তৈরি হতো না। এখনো আমার গবেষণার জন্য পড়তে হয়। সেগুলো আমি ঠিকই পড়ি। কিন্তু শৈশবের সেই পড়ার অভ্যাস এখন আর নেই। ওই ধৈর্য রাখতে পারি না। এখন অনেক কিছু মনোযোগ সরিয়ে নেয়। কিন্তু বই পড়া জরুরি। কারণ ব্যাখ্যা করা একটু কঠিন।

আমার মনে হয়, বই পড়া একধরনের এক্সারসাইজের মতো। কারণ, বই পড়ে আপনাকে ভিজ্যুয়ালাইজ করতে হচ্ছে মাথার ভেতরে (দৃশ্যগুলো তৈরি করতে হচ্ছে মাথায়)। আমি বলছি না শুধু বই পড়া দিয়ে এটা সম্ভব। কিন্তু বই পড়ার কারণে মানুষের ভিজ্যুয়ালাইজেশন পাওয়ার (কোনো দৃশ্য কল্পনার ক্ষমতা) অনেক বাড়ে। এটা খুব জরুরি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

একটা বইয়ের নাম বলুন, যেটা কিশোর-তরুণ বা সবার পড়া উচিত বলে মনে করেন।

নিরুপম আইচ: এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। আমার সবচেয়ে প্রিয় বই মুহম্মদ জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ। এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় বই। একজন মানুষের আত্মত্যাগের উদাহরণ। এটা শুধু বন্ধুর জন্য নয়। বন্ধু হতে পারে, অন্য মানুষ হতে পারে, দেশের জন্য হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় না শুধু দেশের জন্য রাশেদ আত্মত্যাগ করেছে। সে বন্ধুদের জন্য আত্মত্যাগ করেছে, নিজের জন্য আত্মত্যাগ করেছে। অন্য অনেক বইয়ের কথা বলা যায়, তবে এটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বইটি আমাকে বেশ প্রভাবিত করেছিল।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনার বিজ্ঞানী হওয়ার পেছনে কি বিশেষ কোনো ঘটনা আছে?

নিরুপম আইচ: না। আমি চাইলে বলতে পারি, বিশেষ ঘটনা আছে। সবারই নাটকীয় কিছু না কিছু থাকে। কিন্তু আমার সে রকম কিছু নেই। আগে মনে করতাম, আমি কোনো দিন বিজ্ঞানী হতে পারব না।

বিজ্ঞানচিন্তা:

তাহলে ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন?

নিরুপম আইচ: কী হতে চেয়েছিলাম? ভালো প্রশ্ন। প্রথমে রিকশাওয়ালা হতে চেয়েছিলাম। কারণ, মনে হতো, এটা করতে মাথা খাটাতে হবে না। আমি কখনো চিকিৎসক হতে চাইনি। কারণ, অনেক পড়াশোনা করতে হয় চিকিৎসক হতে চাইলে। বিজ্ঞানী হওয়ার কোনো চিন্তা ছিল না। আমি শুধু জানতাম, আমার মা–বাবা টিচার। পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য টিচার। তাই ওটা চিন্তা করাই আমার জন্য সবচেয়ে সহজ ছিল। আমি খুব বেশি দূর চিন্তা করিনি। এটা করে ফেলব, ওটা করে ফেলব—এমন ভাবিনি। মাকে দেখেছি, পিএইচডি করেছেন। তাই আমার চিন্তা ছিল, পিএইচডি করতে হবে। কর্তব্য হিসেবে সেটা করতে গেলাম। কিন্তু শুরু করার পর দেখতে পেলাম, দিস ইজ ফ্যাসিনেটিং। ওটাই ভালো লেগে গেল। আমি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারছি যে (কোনো ঘটনার) ভেতরে কী ঘটছে। তখন মজা পেয়ে গেলাম। ওই ভালো লাগার কারণে বিজ্ঞানী হয়েছি।

বিজ্ঞানচিন্তা:

এটা তো একটা বড় ঘটনা, এই যে মজা পেয়ে গেলেন। এরপর তো আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, নাকি?

নিরুপম আইচ: পেছন ফিরে কেন, তখন তো মনে হলো, দিস ইজ ফান। বিজ্ঞানের মতো মজা আর কিছুতে নেই। আমি একটা নতুন জিনিস বানাব, নতুন চিন্তা করব। বিজ্ঞানে শুধু a+b+c মেলালে a+b+c হয় না। এর চেয়েও বড় কিছু হয়। এর মধ্যেও মজার সব বিষয় থাকে। এই জিনিস যখন বুঝে গেলাম, তখন থেকে এটা আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে। দিস ইজ সো মাচ ফান। তখন থেকে ভাবলাম, আমার নিজের একটা ল্যাব থাকতে হবে। যখন যা ইচ্ছা হবে, করতে পারব। যে বিষয়ে রিসার্চ করার ইচ্ছা হবে, করতে পারব। সেই মনে হওয়া থেকে আমার একাডেমিক দিকে যাওয়া।

নিরুপম আইচ
ফাইল ছবি
বিজ্ঞানচিন্তা:

বিজ্ঞানচিন্তার বেশির ভাগ পাঠক কিশোর-তরুণ। তাঁদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক কিছু বলুন।

নিরুপম আইচ: বিজ্ঞান আপনাকে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেয়। আসলে বিজ্ঞানের কথা না বলে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (প্রকৌশল) কথা বলা উচিত। কারণ, বিজ্ঞানী বলতে যা বোঝায়; সে হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার (প্রকৌশলী) আর সায়েন্টিস্টের (বিজ্ঞানী) মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। আমি বিজ্ঞানী, কিন্তু আমি মূলত প্রকৌশলী। তবে আমি প্রথমে বিজ্ঞানী, তারপর প্রকৌশলী। প্রকৌশলী হিসেবে আমরা বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করি। আর বিজ্ঞানী হিসেবে সমস্যা বুঝতে হয়। তারপর সমাধানের জন্য কীভাবে কাজ করা যায়, তা ভাবতে হয়, সে অনুযায়ী কাজ করতে হয়। সমস্যা বোঝা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন শিশুদের এ কথা বোঝানো কঠিন যে সমস্যা কী। সহজ করে বললে আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে—সব ক্ষেত্রে আমরা নানা রকম সমস্যায় পড়ি। যেকোনো সমস্যা সমাধান করতে আসলে বিজ্ঞান লাগে। ধাপে ধাপে ভাবতে হয়, কাজ করতে হয়, সমাধান করতে হয়। এটাই কিন্তু বিজ্ঞান।

বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য।

নিরুপম আইচ: আপনাদেরও ধন্যবাদ। বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল।

অনুলিখন: আব্দুল্লাহ আল মাকসুদ, শিক্ষার্থী, অ্যাপ্লাইড ফিজিকস অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়