ছোট পাখি মুনিয়া

বিলের টলটলে জলে শরতের সোনারোদ পড়েছে কেবল। ফুটে আছে শাপলা—নীল ও লাল। চাঁদমালারা সোনারোদে হাসছে যেন। দু-পাঁচ জায়গায় ফুটে আছে পদ্ম ফুল। বিলের পশ্চিম পাড় জোড়া কাশবনের দেয়াল—ফুলে ফুলে সাদা তো বটেই, সকালের রোদ্দুরে দেয়ালটা যেন জ্বলছে। দেয়ালে বাতাস সৃষ্টি করেছে অলৌকিক সফেদ ঢেউ। আর ওই ঢেউয়ের ভেতরেই উড়ছে-ঘুরছে কিছু ছোট পাখি আর ঠোঁটে কাশফুলের টুকরো কেটে উড়ে চলেছে এদিক-সেদিক—চারদিকে। ছোট পাখিগুলো ঠোঁটে-পায়ে কাশফুলগুচ্ছ ধরে যখন ছন্দে ছন্দে দুলে দুলে বিলের জল ছুঁইছুঁই করে উড়ে যাচ্ছে বাসা বানানোর জায়গাটিতে, তখন জলে ওদের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় পরিষ্কার। ছোট পাখিগুলোর এখন বাসা বাঁধার ভরা মৌসুম তো! মহাব্যস্ত ওরা।

বিলটার পূর্ব-দক্ষিণ ও উত্তর প্রান্তে ওদের বাসা বাঁধার গাছ অনেকই আছে। কমপক্ষে ১৮টি পাখি জলের ওপর দিয়ে যাতায়াত করছে কাশবনে—ফেরার সময় এদের হুবহু সাদা রঙের উড়ন্ত সাপ বলেই মনে হচ্ছে। কাশফুল ওদের বাসার আবশ্যিক অনুষঙ্গ। বাসা করে গোলগাল ধরনের ছোট বা মাঝারি ফুটবল আকারের—প্রবেশ দরজা খুঁজে পাওয়া দুরূহ কাজ। উপকরণ থাকে ছোট ছোট বাঁশপাতা, কাশফুলগাছের শিকড়, পাটের আঁশ, শুকনো ঘাস, কুটো, ধানপাতা, কচুরিপানার শিকড়সহ আরও অনেক কিছু। বাসার ভেতরে ওরা শুধু কাশফুল দিয়ে মখমলের মতো গদি বানায়—ওখানে কিছুটা লম্বাটে (করমচা ফলের মতো) আকারের চকচকে ডিম পাড়ে ৫ থেকে ৮টি। ডিমগুলোকে মনে হয় মুক্তোদানা। দুজনে পালা করে ১২ থেকে ১৬ দিন ডিমে তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে ছানা হয়। ছানারা উড়তে শেখে ১৬ থেকে ২১ দিন পর।

বাসা ছেড়ে ছানারা বাইরে এসে যখন গাছের শাখায় শরীরে শরীর মিশিয়ে পাশাপাশি সারিতে বসে থাকে, তখন দেখতে লাগে দারুণ সুন্দর। অবশ্য মা-বাবা পাখি বাসা বাঁধার জায়গা পছন্দে ব্যয় করে ৪ থেকে ৮ দিন। বাসা বানাতে সময় লাগে সপ্তাহখানেক। এদের বাসা বানানোর পছন্দের জায়গা হলো বরই, বাবলা, দেবদারু, নারকেলগাছের মাথার ভেতর। এমনকি তাল, খেজুর চারা, সুপারিগাছের মাথার ভেতর, উলুঘাসবন, বাঁশের কঞ্চিসহ ঘন পাতাওয়ালা যেকোনো জায়গাতেও বাসা বাঁধে এরা।

বাসা বানানোর সময় মুনিয়ারা মিহি-করুণ সুরে আনন্দসংগীত চালিয়ে যায়। এমনিতেই গলাটা এদের মিনমিনে, সুরেলা-বিষণ্ন—যেনবা কান্না মেশানো থাকে ডাক ও গানে। অতি নিরীহ নির্ভেজাল পাখি। আমি নিজেই সাক্ষী বেশ কবারের—বন্দুকের গুলির শব্দে এরা হুঁশ হারিয়ে তলায় পড়ে যায়, অবশ্য একটু বাদেই হুঁশ ফিরলে উড়ে যায়। গুলির শব্দে জলের ওপরের হিজলগাছ থেকে ১০ থেকে ১২টি পাখি পড়ে জলে ভেসে গেল একবার—তাড়াতাড়ি ডোঙা নিয়ে গিয়ে ডোঙায় তুলি। পরে উড়ে যায় একেক করে।

ডিম-ছানার অনেক শত্রু আছে এদের। গেছোসাপ, দাঁড়াশ সাপ, গুইসাপ এদের ডিম-ছানা গেলে। সুযোগ পেলে কাঠবিড়ালিরা অকারণে এদের বাসা তছনছ-লন্ডভন্ড করে (কাঠবিড়ালির বাসার সঙ্গে এদের বাসার গড়ন ও উপকরণের অনেক মিল আছে)। গ্রীষ্মের শেষভাগ থেকে হেমন্তের প্রথম ভাগ পর্যন্ত এদের বাসা বাঁধার মৌসুম। কাশবন-ঘাসবন, ঝোপঝাড় বা খোলা মাঠে ছানাপোনাসহ খাবারের সন্ধানের সময় এই পাখিরা নিচে নামে। তখন ওত পেতে থাকা সোনাব্যাঙদের শিকার হয়। লাফ দিয়ে সোনাব্যাঙ গপাত করে মুখে পুরে নেয় ছোট্ট পাখিদের। সোনাব্যাঙ এদের জন্য বিভীষিকা!

ছোট সুন্দর এই গানের পাখির নাম কবিতার মতো সুন্দর—মুনিয়া। আমাদের দেশে যে কয়েক প্রজাতির মুনিয়ার দেখা মেলে, তার ভেতর এরাই সচরাচর দৃশ্যমান পাখি। ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলেও দেখা মেলে—বাসাও করে নিয়মিত। ইলেকট্রিক তারে বসে থাকতেও দেখা যায়। এই শহরে বেশি বাসা করে ঘোমটা দেবদারুগাছে। এটি হলো তিলা মুনিয়া বা ছিটে মুনিয়া। ইংরেজি নাম স্কেলি–ব্রেস্টেড মুনিয়া। বৈজ্ঞানিক নাম Lonchura punctulata। দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটার। ওজন ১৩ দশমিক ৫ গ্রাম। সারা দেশেই দেখা যায় এদের। ঘন লালচে বাদামি চিবুক, কপাল, বুক ও মুখমণ্ডল, লালচে বাদামি মাথা, কালো ঠোঁট। বুকের নিচটা ও পেট সাদা। বুকজুড়ে এদের যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টাইলস—যেন ধ্রুপদি শিল্পকর্ম। মাছের আঁশের সঙ্গেও তুলনা করা চলে। পাখিটির সব সৌন্দর্য এই বুকে। চোখের মণি লালাভ। পা কালচে। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছানারা দেখতে সাদামাটা। মাথা-চিবুক-পিঠ হালকা বাদামি, তলপেট সাদাটে, বুক বাফ রঙা। তিলা মুনিয়াদের মূল খাবার নানা রকমের শস্যদানা, ঘাসের বীজ ইত্যাদি। এরা ঝাঁকে চলতে ভালোবাসে।

লেখক: পাখি বিশারদ

ছবি: আ ন ম আমিনুর রহমান