হকিংকে চিঠি লিখেছিলেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর, কী ছিল সেই চিঠিতে?
সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর নিঃসন্দেহে বিশ শতকের সবচেয়ে দক্ষ গাণিতিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীদের একজন। তাঁর গবেষণা জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার প্রায় সব বিষয়কে প্রভাবিত করেছে। ব্যক্তিজীবনে বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ছিলেন ভীষণ পড়ুয়া। বয়সে বিভেদ না করে তিনি ছোট-বড় সবার কাছ থেকে শিখতে চাইতেন। ১৯৬৭ সালে ৫৭ বছর বয়সী চন্দ্রশেখর ২৫ বছর বয়সী গবেষক স্টিফেন হকিংকে চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে জানতে চেয়েছিলেন হকিংয়ের গবেষণা ‘অন দ্য অকারেন্স অব সিঙ্গুলারিটিজ ইন কসমোলজি’ সম্পর্কে। বাংলা করলে কথাটার মানে দাঁড়ায়, মহাবিশ্ব তত্ত্বে পরমবিন্দুর উপস্থিতি।
স্টিফেন হকিং পরে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন, এ কথা আমরা সবাই জানি। বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর তাঁর চিঠিতে আসলে হকিংয়ের কাজের কিছু গাণিতিক দিক জানার জন্য লিখেছিলেন। সেই সঙ্গে চেয়েছিলেন কিছু তথ্যসূত্র বা রেফারেন্স, যাতে সেগুলো পড়ে গবেষণার নানা দিক ভালোভাবে বোঝা যায়।
চিঠিতে চন্দ্রশেখর হকিংকে লেখেন, ‘মহাবিশ্ব তত্ত্বে পরমবিন্দুর উপস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি রয়েল সোসাইটিতে আপনার যে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে, তা পড়ে এর প্রতিটি ধাপ আমি গাণিতিকভাবে বোঝার চেষ্টা করছি। আমি যেন আপনার গবেষণাপত্র পড়তে গিয়ে ক্রমে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি। তাই “প্রেসক্রিপশন” হিসেবে কিছু তথ্যসূত্র দিন, যা পড়ে এই গবেষণাপত্রের বিষয়বস্তু ভালোভাবে বুঝতে পারি। এতে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ বোধ করব।’ শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভ থেকে এই চিঠি পড়া যায়।
সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর ছিলেন একজন ভারতীয়-মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। তিনি জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে কৃষ্ণগহ্বর ও নাক্ষত্রিক বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেন।
সেই চিঠির উত্তরে বিজ্ঞানী হকিং টপোলজি ও ডিফারেনশিয়াল জ্যামিতির ওপর নির্দিষ্ট কিছু বইয়ের পরামর্শ দেন চন্দ্রশেখরকে। নিজের কিছু গবেষণাপত্রও দেখার পরামর্শ দেন। সেই সঙ্গে (বিনয় করে) জানান, এ বিষয়ে তিনিও খুব একটা গণিত জানতেন না। এই বইগুলো পড়েই তাঁর গাণিতিক জ্ঞান খানিকটা পোক্ত হয়েছে। এই চিঠিটিও দেখতে পারেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভ থেকে।
সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর ছিলেন একজন ভারতীয়-মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। তিনি জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে কৃষ্ণগহ্বর ও নাক্ষত্রিক বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেন। চন্দ্রশেখর ১৯১০ সালে ব্রিটিশ ভারতের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৭ সালে চেন্নাইয়ের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্নস্ট রাদারফোর্ড এবং স্যার আর্থার এডিংটনের অধীনে কাজ করেন। ১৯৩০ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেন, একটি শ্বেত বামন নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের ১.৪ গুণের বেশি হতে পারে না। এই সীমাকে চন্দ্রশেখর সীমা বলা হয়। যদি কোনো শ্বেত বামনের ভর এই সীমা অতিক্রম করে, তাহলে সেটি নিজের মহাকর্ষীয় টানের কারণে সংকুচিত হয়ে একটি নিউট্রন নক্ষত্র অথবা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। পরে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চন্দ্রশেখরের তত্ত্বটি সঠিক প্রমাণিত হয়। তাঁর এই কাজ নাক্ষত্রিক বিবর্তন এবং কৃষ্ণগহ্বর গবেষণার ভিত্তি গড়ে দেয়। ১৯৮৩ সালে চন্দ্রশেখর তাঁর এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর প্রায় ৪০০টিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।