পোশাক থেকে শুরু করে বিছানার চাদর—দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে আক্ষরিক অর্থে জড়িয়ে আছে কাপড় বা ফেব্রিক। মানুষের কাপড় ব্যবহারের ইতিহাস বেশ পুরানো। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ৩৫ হাজার বছর ধরে মানুষ কাপড় তৈরি করছে। এ কাপড় বিশেষ করে থান কাপড় কেটেই তৈরি করা হয় নানা পরিধেয় বস্ত্র, ব্যাগ, পর্দাসহ আরও অনেক কিছু। ইংরেজিতে থান কাপড়কে বলে ফেব্রিক বা টেক্সটাইল। অভিধানে ফেব্রিক শব্দ মানে আঁশ বা তন্তু থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি একধরনের কাপড়।
আঁশ চুলের চেয়েও পাতলা ও লম্বা সুতার মতো বস্তু। আঁশের বড় উৎস প্রকৃতি। বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহ থেকে আঁশ সংগ্রহ করা হয়। উদ্ভিদের মধ্যে সাধারণত তুলা ও রেশম গাছ থেকে আঁশ সংগ্রহ করা হয়। পাট, খড় বা কলাগাছের মতো আঁশযুক্ত গাছ থেকেও তন্তু সংগ্রহ করে সুতা বানানো সম্ভব। প্রাণীদের মধ্যে সাধারণত ভেড়ার পশম সংগ্রহ করা হয়। এই পশমকে আঁশ হিসেবে ব্যবহার করে তৈরি করা হয় সুতা।
তবে এখন কৃত্রিমভাবেও তৈরি করা হয় আঁশ ও সুতা। প্রায় দেড়শো বছর আগে এ কৌশল আয়ত্ব করে মানুষ। প্রযুক্তির সহায়তায় জ্বালানি তেল বা পেট্রোলিয়াম কিংবা কয়লার মতো উপাদান থেকে তৈরি করা হয় কৃত্রিম আঁশ। এ আঁশ থেকে পানিরোধী কিংবা গুলিরোধী বিশেষ ধরনের কাপড় তৈরি করা যায়। কৃত্রিম সুতায় বোনা কাপড়ের মধ্যে পলিস্টার বা নাইলন অন্যতম। এখন প্রশ্ন হলো, চুলের মতো চিকন এসব আঁশ কীভাবে কাপড় বা পোশাকে রূপান্তরিত হয়?
মূলত দুই ধাপে কাপড় তৈরি হয়। প্রথমে আঁশ বা পশম থেকে তৈরি করা হয় সুতা। এরপর সুতা থেকে বোনা হয় কাপড়। আঁশ থেকে সুতা তৈরির কাজটি বেশ কঠিন। কারণ, তুলার আঁশ গড়ে মাত্র ৩ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। আর ভেড়ার পশম কাঁটা হয় সাড়ে সাত সেন্টিমিটার লম্বা হলে। আবার সব তন্তু বা আঁশ সমানও হয় না।
এসব তন্তু পাকিয়ে তৈরি করা হয় লম্বা মোটা সুতা। পাকানোর ফলে তন্তুগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে লেগে যায়। মানে আটকে থাকে। পাকানো তন্তুগুলো সহজে আলগা হয় না। ফলে তৈরি হয় সুতা। আগে তন্তু পাকিয়ে সুতা বানানোর কাজটি চরকা বা হাতে ঘোরানো বিশেষ চাকার মাধ্যমে করা হত। একে বলা হয় সুতা কাটা।
এরপর সুতাকে লম্বা একটি নলের মধ্য দিয়ে টেনে নেওয়া হয়। যত টানা হয়, ততই বাড়ে সুতার দৈর্ঘ্য। কোন উৎস থেকে এবং কেমন যন্ত্র দিয়ে সুতা তৈরি করা হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে সুতার বৈশিষ্ট্য আলাদা হয়। ফলে বাজারে পাতলা, মোটা, শক্ত, নরম, স্থিতিস্থাপক বিভিন্ন ধরনের সুতা পাওয়া যায়।
সুতা তো হলো। এবার কাপড়ের বোনার পালা। সুতা থেকে কাপড় বোনার কাজ কিছুটা কঠিন। শত শত সুতাকে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বরাবর একটি আরেকটির ওপর-নিচ দিয়ে পাঠানো হয়। অনেকটা দাবার বোর্ডের মত। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরি, দৈর্ঘ্য বরাবর ১০টি সুতা আছে। তাহলে প্রস্থ বরাবর সুতাটি ১, ৩, ৫, ৭ ও ৯ নম্বার সুতার ওপর দিয়ে যাবে। বাকি সুতাগুলো নিচ দিয়ে যাবে। বিপরীত উপায়ে আবার প্রস্থ বরাবর একটা সুতা যোগ করতে হবে। এভাবে হাজারও সুতা বুনে তৈরি হয় কাপড়।
শুধু হাতের সাহায্যে কাজটি করা ভীষণ কঠিন। তাই অনেক আগের থেকেই মানুষ সুতা থেকে কাপড় বোনার জন্য নানা ধরনের যন্ত্র তৈরি করেছে। তাঁত তেমনই এক যন্ত্র। কাঠ দিয়ে তৈরি এ যন্ত্রে আলাদা আলাদা সুতাকে জায়গামতো বসিয়ে, বিশেষ উপায়ে শারীরিক শক্তি ব্যবহার করে বোনা হতো কাপড়। আগে আমাদের দেশে গ্রামগঞ্জে প্রচুর তাঁতশিল্পী ছিলেন। বড় জায়গাজুড়ে ঘর বানিয়ে দিনরাত খটখট শব্দে বুনতেন কাপড়। এখন তা অনেকটাই কমে গেছে। তন্তু থেকে সুতা তৈরি এবং সুতা থেকে কাপড় তৈরির পুরো বিষয়টি করা হয় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে। তবে কাপড় থেকে পোষাক বানানোর বেশিরভাগ কাজ এখনও হাতে করা হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: দ্য কনভারসেশন