মানুষ ৪ লাখ বছর আগে প্রথম আগুন জ্বালিয়েছিল ইংল্যান্ডে, দাবি বিজ্ঞানীদের

শিল্পীর তুলিতে পাইরাইট এবং ফ্লিন্ট ব্যবহার করে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরির ধারণাছবি: ক্রেইগ উইলিয়ামস/দ্য ট্রাস্টিস অব দ্য ব্রিটিশ মিউজিয়াম

আগুন! মানবসভ্যতার ইতিহাসে চাকা আবিষ্কারের আগেও যদি কোনো বড় আবিষ্কার থাকে, তবে তা আগুন। আগুন আমাদের রান্না শিখিয়েছে, বন্য পশুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আগুনের জাদুকর আসলে কারা? হোমো সেপিয়েন্সরা নাকি নিয়ান্ডারথালরা?

এত দিন আমরা ভাবতাম, নিয়ান্ডারথালদের বুদ্ধি আমাদের তুলনায় কম ছিল। কিন্তু যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ডের এক প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট থেকে পাওয়া কিছু পাথরের টুকরো সেই বিশ্বাসে বড় ধাক্কা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ডের সাফোকের বার্নহাম নামের এক জায়গায় মাটির নিচে পাওয়া গেছে ৪ লাখ বছরের পুরোনো কিছু প্রমাণ। সেই প্রমাণ বলছে, নিয়ান্ডারথালরা শুধু আগুন ব্যবহারই করত না, পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাতেও জানত! যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কিউরেটর নিক অ্যাশটন বলেছেন, ‘আমার ৪০ বছরের ক্যারিয়ারে এটাই সবচেয়ে রোমাঞ্চকর আবিষ্কার!’

২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের সাফোকের বার্নহামে প্রথম আয়রন পাইরাইটের টুকরা পাওয়া যায়
ছবি: জর্ডান ম্যানসফিল্ড/পাথওয়েস টু অ্যানসিয়েন্ট ব্রিটেন প্রোজেক্ট

চার লাখ বছরের পুরোনো আগুন!

বার্নহাম জায়গাটি প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে পরিচিত সেই ১৯০০ সালের শুরু থেকেই। সেখানে অনেক পুরোনো পাথরের হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে নতুন করে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হলে বেরিয়ে আসে আসল রহস্য।

গবেষকেরা সেখানে পোড়া মাটি, কয়লা এবং পুড়ে যাওয়া পাথরের হাতিয়ার খুঁজে পান। মাটির একটা কোণায় লাল হয়ে যাওয়া কাদা দেখে বোঝা যায়, সেখানে বারবার আগুন জ্বালানো হতো। অর্থাৎ ওটা ছিল একটা আদিম চুলা।

কিন্তু সবচেয়ে বড় চমকটা ছিল অন্য জায়গায়। গবেষকেরা সেখানে খুঁজে পান পাইরাইট বা ফুলস গোল্ডের ছোট ছোট টুকরো। এখন প্রশ্ন হলো, পাইরাইট এত স্পেশাল কেন? কারণ, পাইরাইট পাথরকে যদি ফ্লিন্ট পাথরের সঙ্গে জোরে ঠোকা হয়, তবে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বা স্পার্ক তৈরি হয়। বার্নহাম এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে পাইরাইট পাওয়া যায় না। এর মানে হলো, কেউ একজন ইচ্ছে করে এই পাথরগুলো সেখানে বয়ে নিয়ে এসেছিল, আগুন জ্বালানোর উদ্দেশে!

‘নিয়ান্ডারথালরা পুরোপুরি মানুষের মতোই ছিল। তাদের মস্তিষ্ক আমাদের মতোই বড় ছিল। তারা নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারত। মানুষ হিসেবেও তারা উন্নত ছিল।’
ক্রিস স্ট্রিংগার, গবেষক, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, যুক্তরাজ্য

গবেষকদের মতে, আগুন জ্বালানোর ক্ষমতা মানুষের গতিপথ বদলে দিয়েছিল। আগুন ব্যবহার করে রান্না করা খাবার খাওয়া শুরু করার ফলেই আমাদের পূর্বপুরুষদের মস্তিষ্ক বড় হতে শুরু করে। কাঁচা মাংস হজম করতে যে শক্তি লাগত, রান্না করা খাবারে তা লাগত না। ফলে সেই বাড়তি শক্তি মস্তিষ্ক গঠনে কাজে লাগে। তা ছাড়া আগুনের পাশে বসে গল্প করা বা আড্ডা দেওয়ার মাধ্যমেই হয়তো আদিম মানুষের ভাষা ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়েছিল।

আরেকটা প্রশ্ন হলো, নিয়ান্ডারথালরা কি হোমো সেপিয়েন্সদের চেয়ে বুদ্ধিমান ছিল। এত দিন বিজ্ঞানীরা জানতেন, নিয়ান্ডারথালরা আগুন ব্যবহার করত। কিন্তু সেই প্রমাণগুলো ছিল মাত্র ৫০ হাজার বছর পুরোনো। আর এখন বার্নহামের এই আবিষ্কার সেই সময়সীমাকে পিছিয়ে নিয়ে গেছে ৩ লাখ ৫০ হাজার বছর আগে! অর্থাৎ, আজ থেকে ৪ লাখ বছর আগেই তারা এই প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছিল।

গবেষকেরা যুক্তরাজ্যে বার্নহামে খননকাজ করছেন
ছবি: জর্ডান ম্যানসফিল্ড/পাথওয়েস টু অ্যানসিয়েন্ট ব্রিটেন প্রোজেক্ট

যদিও বার্নহামে কোনো মানুষের হাড়গোড় পাওয়া যায়নি, কিন্তু ওই একই সময়ের কাছাকাছি যুক্তরাজ্যের সোয়াঁসকম্ব নামে স্থানে নিয়ান্ডারথালদের মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল। তাই যুক্তরাজ্যের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষক ক্রিস স্ট্রিংগার নিশ্চিত যে, বার্নহামের আগুনের কারিগর ছিল শুরুর দিকের নিয়ান্ডারথালরাই।

ক্রিস স্ট্রিংগার বলেন, ‘নিয়ান্ডারথালরা পুরোপুরি মানুষের মতোই ছিল। তাদের মস্তিষ্ক আমাদের মতোই বড় ছিল। তারা নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারত। মানুষ হিসেবেও তারা উন্নত ছিল।’

কিন্তু বার্নহামের প্রমাণ বলছে, ৪ লাখ বছর আগে ইউরোপের মাটিতে নিয়ান্ডারথালরা নিজের ইচ্ছামতো আগুন তৈরি করতে পারত।

আগুনের ব্যবহার নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তর্ক অনেক দিনের। কেনিয়ায় ১৫ লাখ বছর আগের বা ইসরায়েলে ৮ লাখ বছর আগের পোড়া চিহ্ন পাওয়া গেছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো হয়তো ছিল দাবানল বা প্রাকৃতিক আগুনকে কাজে লাগানোর উদ্দেশে। মানে, তারা আগুন জ্বালাতে পারত না, শুধু জ্বলন্ত আগুন ধরে রাখত।

কিন্তু বার্নহামের প্রমাণ বলছে, ৪ লাখ বছর আগে ইউরোপের মাটিতে নিয়ান্ডারথালরা নিজের ইচ্ছামতো আগুন তৈরি করতে পারত। মজার ব্যাপার হলো, ওই একই সময়ে আফ্রিকায় আমাদের পূর্বপুরুষ হোমো সেপিয়েন্সরা বাস করত। কিন্তু তারা তখনো আগুন জ্বালাতে শিখেছিল কি না, তার কোনো প্রমাণ নেই।

হতে পারে, ইউরোপের হাড়কাঁপানো শীতে টিকে থাকার জন্যই নিয়ান্ডারথালরা এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে বাধ্য হয়েছিল। আর পরে তাদের দেখাদেখি বা তাদের থেকেই হয়তো এই জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকায়!

লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স