নক্ষত্রশিশুর জন্ম

আদি নক্ষত্রছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
নক্ষত্রেরও জীবন আছে। শিশু নক্ষত্র জন্ম নেয়, বড় হয়, তারপর ঢলে পড়ে মৃত্যুর মুখে অথবা আইবুড়ো হয়ে কাটিয়ে দেয় একঘেয়ে নীরব জীবন। কিন্তু এই নক্ষত্রশিশুদের জন্মের গল্প কেমন?

একটা মজার তথ্য দিয়ে শুরু করি। রাতের আকাশে খালি চোখে শুধু নক্ষত্রই নয়, সৌরজগতের পাঁচটি গ্রহ দেখি আমরা। তবে এই পার্থক্য তাৎক্ষণিক বোঝা একটু কঠিন। আর পর্যবেক্ষক যদি অভিজ্ঞ না হন, তাহলে তো বোঝার প্রশ্নই আসে না। খাঁটি বাংলায় এদের সবাইকে কিন্তু এককথায় ‘তারা’ বলা হয়। প্রাচীনকালে মানুষ দীর্ঘদিন রাতের আকাশে চোখ রাখার পর ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছিল। তারা টের পেয়েছিল, কিছু জিনিস নিয়ম করে ঘুরপাক খাচ্ছে, আর কিছু তুলনামূলকভাবে স্থির বসে আছে। তুলনামূলক এই স্থির জিনিসগুলো আমাদের নক্ষত্র। আর ঘুরপাক খেয়ে চলা জিনিসগুলো গ্রহ।

আধুনিক বিজ্ঞানের হাত ধরে আমরা এখন জানি, নক্ষত্ররাও স্থির নয়। তারাও ছোটে। প্রচণ্ড তাদের গতি। তবে পৃথিবীতে বসে খালি চোখে এসব বোঝা যায় না। আরেকটা জিনিস আছে। এটা আমরা সবাই জানি। তবে ভুলে যাই কিংবা বলা যায়, মনে করার প্রয়োজন বোধ করি না। নক্ষত্ররা দিনের আকাশেও থাকে। কিন্তু তাদের খালি চোখে দেখা যায় না। সূর্যের প্রচণ্ড আলোর কাছে হেরে ভূত। সূর্য আড়াল হলেই আবারও হাসি হাসি মুখে হাজির। চোখ টিপে দেয় আমাদের উদ্দেশে।

নক্ষত্রেরও জীবন আছে। শিশু নক্ষত্র জন্ম নেয়, বড় হয়, তারপর ঢলে পড়ে মৃত্যুর মুখে অথবা আইবুড়ো হয়ে কাটিয়ে দেয় একঘেয়ে নীরব জীবন। কিন্তু এই নক্ষত্রশিশুদের জন্মের গল্প কেমন? সেটাই শোনাব এ লেখায়।

আন্তনাক্ষত্রিক গ্যাসের ঘনত্ব সাধারণত দুই ধরনের হয়। যেসব জায়গায় কম ঘনত্বের পারমাণবিক হাইড্রোজেন, মানে হাইড্রোজেন পরমাণু (H) বা আয়নিত হাইড্রোজেন (H+) বেশি থাকে, তাকে বলে এইচ ওয়ান (H I) অঞ্চল। আর বেশি ঘনত্বের শীতল হাইড্রোজেন অণু (H2) যেসব অঞ্চলে বেশি থাকে, তাকে বলা হয় এইচ টু (H II) অঞ্চল। এই এইচ টু অঞ্চলে মূলত নতুন নক্ষত্রদের জন্ম হয়
প্রোটোস্টার এল১৫২৭
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

দুই

নক্ষত্রের জন্ম হয় আন্তনাক্ষত্রিক স্থানে, নীহারিকার বুকে। ইংরেজিতে বলে ইন্টারস্টেলার স্পেস। জোড়া তারা না হলে, দুটি নক্ষত্রের মধ্যে অনেকটা দূরত্ব থাকে।

এখানে একটা জিনিস জানিয়ে রাখি। দুটো গ্রহের মাঝের দূরত্ব বা স্থানকে বলা হয় ইন্টারপ্ল্যানেটারি স্পেস বা আন্তগ্রহীয় স্থান। দুটি গ্যালাক্সির মধ্যকার স্থানকে বলা হয় আন্তগ্যালাক্টিক স্থান বা ইন্টারগ্যালাক্টিক স্পেস। তার মানে, আন্তনাক্ষত্রিক স্থান বলতে একটা গ্যালাক্সির ভেতরে দুটি নক্ষত্রের মধ্যবর্তী দূরত্বকে বোঝায়।

আমরা জানি, একটা গ্যালাক্সিতে অনেক নক্ষত্র ও নীহারিকা থাকে। আর একটা নক্ষত্রকে ঘিরে ঘোরে অনেক গ্রহ। নক্ষত্রকে ঘিরে ঘোরা গ্রহদের নিয়ে হয় সেই নক্ষত্রের জগৎ। যেমন সূর্যকে ঘিরে আমাদের সৌরজগৎ। সত্যি বলতে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নক্ষত্রজগতে একটা নয়, দুটি নক্ষত্র থাকে। এই দুটি নক্ষত্র একসঙ্গে একটা সিস্টেম গঠন করে, তাদের বলে জোড়া তারা বা বাইনারি স্টার। আর গ্রহদের ঘিরে ঘোরে এক বা একাধিক উপগ্রহ। আবার গ্যালাক্সির কথা যদি ভাবি, অনেক গ্যালাক্সি একসঙ্গে মিলে তৈরি করে গ্যালাক্সি ক্লাস্টার বা গ্যালাক্সিপুঞ্জ। আর অনেক ক্লাস্টার মিলে তৈরি হয় সুপারক্লাস্টার। দৃশ্যমান মহাবিশ্ব, মানে মহাবিশ্বের যতটুকু আমরা দেখতে পাই, সেটা এ রকম অনেক সুপারক্লাস্টারের সমষ্টি। এ থেকে মহাবিশ্ব কতটা বিশাল, তার একটা ধারণা পাওয়া যায়, অনুভব করা যায়।

যাহোক, প্রসঙ্গে ফিরি। আন্তনাক্ষত্রিক স্থানে, নীহারিকার বুকে নক্ষত্রদের জন্ম হয়। রাতের আকাশে খালি চোখে দুটি নক্ষত্রের মধ্যে যে দূরত্ব দেখতে পাই, সেটাই এই আন্তনাক্ষত্রিক স্থান। এখানে থাকে মূলত প্রচুর গ্যাস, ধুলা বা ছাই, চৌম্বকক্ষেত্র এবং তড়িচ্চুম্বক বিকিরণ বা মহাজাগতিক রশ্মি। এই গ্যাসগুলো অণু-পরমাণু বা আয়ন হিসেবে থাকে। আর এই গ্যাসের প্রায় ৯৯ শতাংশ হয় হাইড্রোজেন। এ ছাড়া কিছু কার্বন, অক্সিজেন, সিলিকন, লোহা ও অন্যান্য ভারী মৌল থাকে।

অণু-পরমাণু আমরা বুঝি। কথা হলো, আয়ন মানে কী? পরমাণুতে প্রোটন আর ইলেকট্রনের সংখ্যা সমান হয়। যে কটি প্রোটন থাকে, ঠিক সে কটি ইলেকট্রন থাকে। কোনোভাবে ইলেকট্রনের সংখ্যা বেড়ে গেলে পরমাণুটি ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হয়। কারণ, এতে ধনাত্মক প্রোটনের চেয়ে ঋণাত্মক ইলেকট্রনের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। উল্টোভাবে, ইলেকট্রন কমে গেলে পরমাণুটি পরিণত হয় ধনাত্মক আয়নে।

আন্তনাক্ষত্রিক গ্যাসের ঘনত্ব সাধারণত দুই ধরনের হয়। যেসব জায়গায় কম ঘনত্বের পারমাণবিক হাইড্রোজেন, মানে হাইড্রোজেন পরমাণু (H) বা আয়নিত হাইড্রোজেন (H+) বেশি থাকে, তাকে বলে এইচ ওয়ান (H I) অঞ্চল। আর বেশি ঘনত্বের শীতল হাইড্রোজেন অণু (H2) যেসব অঞ্চলে বেশি থাকে, তাকে বলা হয় এইচ টু (H II) অঞ্চল। এই এইচ টু অঞ্চলে মূলত নতুন নক্ষত্রদের জন্ম হয়।

এইচ টু অঞ্চল
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

এইচ টু অঞ্চলের পদার্থগুলো মহাকর্ষের টানে ধীরে ধীরে একসঙ্গে জড়ো হতে থাকে। এভাবে কয়েক মিলিয়ন বছর বা আরও বেশি সময় ধরে হাইড্রোজেন গ্যাস ও ধূলিকণা জমতে জমতে তৈরি হয় আন্তনাক্ষত্রিক গ্যাসের বিশাল মেঘ। এই মেঘের এমাথা থেকে ওমাথা কয়েক আলোকবর্ষ বিস্তৃতও হতে পারে। মনে রাখতে হবে, আলোকবর্ষ কিন্তু সময়ের একক নয়, দূরত্বের একক। আলো এক বছরে যতটুকু দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে, তা-ই এক আলোকবর্ষ। তার মানে, জমে ওঠা এই গ্যাস মেঘের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছুটে যেতে আলোর লেগে যেতে পারে কয়েক বছর, যদি আলো এর মধ্য দিয়ে যেতে পারে আরকি। সংখ্যাটা অবশ্য নির্দিষ্ট নয়, তবে এটা ১০ আলোকবর্ষের মতো হতে পারে। মজার বিষয় হলো, এই গ্যাসমেঘের চারপাশের অঞ্চলে যেসব ধূলিকণা থাকে, সেগুলোর ব্যাস দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের খুব কাছাকাছি হয়। তাই এসব ধূলিকণার ওপর দৃশ্যমান আলো বা এর চেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো (যেমন অতিবেগুনি রশ্মি) পড়লে প্রতিফলিত ও বিচ্ছুরিত হয় বেশি। তাদেরকে পেরিয়ে তাই দৃশ্যমান আলো আর ভেতরে যেতে পারে না। এলাকাটি দৃশ্যমান আলো ও এর চেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর জন্য পরিণত হয় দুর্ভেদ্য দুর্গে। বলে রাখি, দৃশ্যমান আলোর চেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো, যেমন বেতার বা অবলোহিত আলো এর মধ্য দিয়ে যেতে পারে। তাই এ ধরনের আলো দিয়ে এসব অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।

এইচ টু অঞ্চলে তৈরি হওয়া এ রকম বিশাল, ঘন ও শীতল মেঘপুঞ্জকে ইংরেজিতে বলে জায়ান্ট মলিকিউলার ক্লাউড। অর্থাৎ সুবিশাল আণবিক মেঘ। এখানকার তাপমাত্রা ১০ কেলভিনের মতো নিতান্ত অল্প হতে পারে, আর এর ভর হতে পারে সর্বোচ্চ এক মিলিয়ন সৌরভরের মতো। অর্থাৎ সূর্যের এক মিলিয়ন গুণ বেশি। এ অঞ্চলের প্রতি ঘনমিটারে এক মিলিয়ন মিলিয়ন, মানে ১০১২টির মতো হাইড্রোজেন পরমাণু একসঙ্গে জমা হতে পারে।

উল্টো দিকে, এর আশপাশ অঞ্চলে, সুবিশাল আণবিক মেঘের বাইরে প্রতি ঘনমিটারে ১০০ মিলিয়ন বা ১০টির বেশি হাইড্রোজেন কণা জমা হতে পারে না। আর এখানকার পরমাণুগুলোর তাপমাত্রাও হয় প্রায় ১০ গুণ বেশি, ১০০ কেলভিনের মতো। আগেই বলেছি, এ অঞ্চলের ধূলিকণাগুলোর ব্যাস অতিবেগুনি রশ্মিকে ঠেকিয়ে দিতে পারে। ফলে এইচ টু অঞ্চলের সুবিশাল আণবিক মেঘের মধ্যে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে, তাতে কেউ বাগড়া দিতে পারে না।

এদিকে এইচ টু অঞ্চলে জমা হওয়া সুবিশাল আণবিক মেঘের মধ্যকার হাইড্রোজেন মহাকর্ষের আকর্ষণে আরও কাছে আসছে। প্রতিমুহূর্তে এর ওপর মহাকর্ষ বলের আকর্ষণ আরও বাড়ছে। ফলে আরও দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে এই মেঘ। অর্থাৎ বেড়ে যাচ্ছে মেঘের ভেতরের হাইড্রোজেনগুলোর গতি। একে অন্যের আরও কাছাকাছি চলে আসছে হাইড্রোজেনগুলো। ধাক্কা খাচ্ছে প্রচণ্ডভাবে। এর ফলে উৎপন্ন হচ্ছে তাপ। হু হু করে বাড়ছে প্রতি ঘনমিটারে তাপমাত্রা, ঘনত্ব ও চাপ। এই তাপমাত্রা বাইরে বেরিয়ে যায় অবলোহিত বিকিরণ হিসেবে (এটাকে গবেষণাগারে পর্যবেক্ষণ করা যায়। কীভাবে, সে গল্প পরে কখনো শোনাব)। আর চাপ কাজ করে মহাকর্ষের বিরুদ্ধে। এটিই প্রটোস্টার বা আদি নক্ষত্র। একটা নক্ষত্র যখন জন্ম নিতে থাকে, গড়ে উঠতে থাকে, তখন তাকে বলে আদি নক্ষত্র। মানে নক্ষত্রটা এখনো তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এর কেন্দ্র এখনো জ্বলে ওঠেনি।

আদি নক্ষত্র অত্যন্ত উজ্জ্বল অবলোহিত রশ্মি বিকিরণ করে। এ জন্য চারপাশের ঘন কালো আন্তনাক্ষত্রিক মেঘের পর্দার আড়ালেও একে শনাক্ত করা যায়।

সুপারনোভা
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

বাইরের প্রচণ্ড চাপ বা সুবিশাল আণবিক মেঘের মধ্যকার প্রবল মহাকর্ষীয় আকর্ষণ একসময় এত বেড়ে যায় যে গ্যাসের বাইরের দিকের চাপ মেঘকাঠামো আর ধরে রাখতে পারে না। ভেঙে পড়ে নক্ষত্রটির পুরো কাঠামো। এর নাম মহাকর্ষীয় ভাঙন বা মহাকর্ষীয় পতন (Gravitational collapse)। কোন দিকে ভেঙে পড়ে? কেন্দ্রের দিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ যেমন চারপাশ থেকে ভেঙে পড়তে থাকলে এর কেন্দ্রের দিকে পড়বে, ঠিক তেমনি নক্ষত্রটির পুরো কাঠামো ও এর বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়ে কেন্দ্রের দিকে। এ রকম ভেঙে পড়ার ফলে আদি নক্ষত্রটিতে জন্ম নেয় মহাকর্ষীয় বিভব শক্তি। ঝরনার পানি নিচের দিকে পড়ার সময় যেমন মহাকর্ষীয় বিভব শক্তি তৈরি হয়, সে রকম। এই শক্তির খানিকটা তাপে রূপান্তরিত হয়। আর প্রবল বেগে ভেঙে পড়তে থাকে আদি নক্ষত্রের কাঠামো। সেই সঙ্গে কেন্দ্রে গ্যাসের বাইরের দিকমুখী চাপ বাড়তে থাকে প্রচণ্ডভাবে।

এতক্ষণে এই আদি নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অঞ্চল অস্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। মহাকর্ষ বল একে ভেঙেচুরে প্রবলভাবে আরও সংকুচিত করতে চাইছে, আর বাইরের দিকমুখী প্রচণ্ড চাপ ঠেকিয়ে দিচ্ছে এই সংকোচনকে। অর্থাৎ দুই দিকের চাপ প্রায় সমান হয়ে গেছে। ফলে কেন্দ্রের সংকোচন থেমে যায়। একসময় এর তাপমাত্রা হয় প্রায় এক হাজার কেলভিন।

চারদিক থেকে অবশ্য তখনো ভেঙে পড়ছে আদি নক্ষত্রটির বিভিন্ন অংশ, তবে এর পরিমাণ অনেক কমে গেছে। এটা ঠিক কীভাবে বন্ধ হয়, এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। দেখা গেছে, আদি নক্ষত্রদের প্রচণ্ড শক্তিশালী নক্ষত্রবায়ু থাকে। এই নক্ষত্রবায়ু বাইরের অপ্রয়োজনীয় সবকিছু সরিয়ে দেয়।

এই সবকিছু হতে কত সময় লাগবে, তা নির্ভর করে এর ভরের ওপর। সূর্যের মতো ভরের নক্ষত্রদের জন্য এ সময়ের পরিমাণ ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখ বছরের মতো। এ সময় আদি নক্ষত্র দৃশ্যমান আলো বিকিরণ করতে শুরু করে।

এ অবস্থায় এসে আদি নক্ষত্রটির একটা স্থিতিশীল অবস্থায় চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয় না। কেন্দ্রের সংকোচন প্রায় থেমে গিয়েছিল। মহাকর্ষ বল একে আরও সংকুচিত করতে চাইছে, আর বাইরের দিকমুখী প্রচণ্ড চাপ ঠেকিয়ে দিচ্ছে তাকে। তারপরও যে নক্ষত্রটি স্থিতিশীল অবস্থায় চলে যায় না, এর কারণ শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন হাইড্রোজেন পরমাণুর ধাক্কাধাক্কির ফলে উৎপন্ন তাপ তো কম নয়। এভাবে একসময় নক্ষত্রের কেন্দ্রের তাপমাত্রা এক কোটি কেলভিনে পৌঁছে যায়। এই তাপ শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলকে সক্রিয় করে তোলার জন্য যথেষ্ট। সক্রিয় হয় শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল।

ভর কীভাবে শক্তিতে পরিণত হয়, সে রেসিপি বলে গেছেন আলবার্ট আইনস্টাইন। এর নাম বিশেষ আপেক্ষিকতা সূত্র

হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন থাকে। এর চার্জ ধনাত্মক। সমধর্মীরা একে অন্যকে বিকর্ষণ করে, আর ভিন্নধর্মীরা আকর্ষণ করে পরস্পরকে। এই আকর্ষণ ও বিকর্ষণ হলো তড়িচ্চৌম্বকীয়। নক্ষত্রের কেন্দ্রে, খুব অল্প জায়গায় প্রচণ্ড ঘনভাবে অবস্থান করছে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন। প্রচণ্ড তড়িচ্চৌম্বকীয় বিকর্ষণ এখানে কাজ করার কথা। আর গ্যাসের বহির্মুখী চাপ তো আছেই। এতক্ষণ এই চাপ ও তড়িচ্চৌম্বকীয় বিকর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করার মতো শক্তি ছিল মহাকর্ষের। এখন আর তা সেভাবে নেই। মহাকর্ষ তাদের যে হারে পরস্পরের কাছে ছুটে যেতে চাপ দিচ্ছে, প্রায় একই হারে একে ঠেকিয়ে দিচ্ছে তড়িচ্চুম্বকীয় বিকর্ষণ ও গ্যাসের বহির্মুখী চাপ। কিন্তু মহাকর্ষের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, তড়িচ্চুম্বক বলের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বল এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। শুরু করেছে কারিকুরি। এর শক্তি বোঝাতে বিজ্ঞানীরা এই বলের নাম রেখেছেন শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল বা সবল বল (Strong Nuclear Force)।

শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের সীমা ১০-১০। এই সীমার ভেতরে থাকা দুটি হাইড্রোজেনের তড়িচ্চৌম্বকীয় বিকর্ষণ শক্তিশালী বলের সামনে অসহায়। শক্তিশালী বল এ সময় হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস দুটিকে জোর করে টেনে এক সুতায় বেঁধে ফেলে। কোনো ট্যাঁ-ফোঁ করার উপায় নেই। মিলেমিশে এক হয়ে যায় দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসে নিউক্লিয়াসে ঘটা এই বিক্রিয়াকে বলে নিউক্লিয়ার ফিউশন। জ্বলে ওঠে নক্ষত্র।

আগে বলেছি, হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন থাকে। তার মানে, দুটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে থাকে দুটি প্রোটন। শক্তিশালী বলের চাপে এ দুটি প্রোটন যখন একসঙ্গে মিলেমিশে নতুন ধরনের নিউক্লিয়াস তৈরি করতে বাধ্য হয়, তখন নতুন তৈরি হওয়া নিউক্লিয়াসটিতে স্বাভাবিকভাবে প্রোটনের সংখ্যা হয়ে যায় দুটি। আমরা জানি, হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসে দুটি প্রোটন থাকে। অর্থাৎ এখানে দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় হিলিয়াম উৎপন্ন করতে বাধ্য হয়েছে।

এখানে একটা মজার বিষয় ঘটে। দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের মোট ভর যতটুকু, উৎপন্ন হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের মোট ভর ততটুকু হয় না। খানিকটা কম হয়। দেখে মনে হবে, অল্প কিছু ভর হারিয়ে গেছে। আসলে হারায়নি। পরিণত হয়েছে শক্তিতে। ভর কীভাবে শক্তিতে পরিণত হয়, সে রেসিপি বলে গেছেন আলবার্ট আইনস্টাইন। এর নাম বিশেষ আপেক্ষিকতা সূত্র। E = mc2। এই সূত্র চেনেন না, এমন কেউ নেই। সবাই এটাও জানেন, এখানে E হলো শক্তি, c হলো আলোর বেগ আর m হলো আমাদের আলোচ্য ভর।

অনেকে মজা করে একটা কথা বলেন, ‘রবি: জন্ম থেকে জ্বলছি।’ তার মানে, আমাদের সূর্য বা রবি জন্মের সময় থেকে জ্বলছে। কথাটা কিন্তু সত্যি। আদি নক্ষত্রের কেন্দ্র যে মুহূর্তে জ্বলে ওঠে, শুরু হয়ে যায় ফিউশন বিক্রিয়া, ঠিক সে মুহূর্তে আদি নক্ষত্র পরিণত হয় নক্ষত্রে। এভাবে জন্ম হয় নক্ষত্রের।

নীহারিকার কোলে নক্ষত্র শিশুদের জন্ম
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
অনেকে হয়তো নক্ষত্রের মৃত্যুর গল্প শুনেছেন। একেক ধরনের নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটে একেকভাবে। এ রকম একধরনের নক্ষত্রের নাম সুপারনোভা বা অতি নবতারা। মৃত্যুর সময় এরা বিস্ফোরিত হয়। এই বিস্ফোরণ দেখার মতো ঘটনা বটে

তিন

এবারে টুকটাক কিছু প্রশ্ন নিয়ে আমরা আলোচনা করব। প্রথম প্রশ্ন, আন্তনাক্ষত্রিক স্থানে যেসব পদার্থ, হাইড্রোজেন গ্যাস, ধূলিকণা থাকে, সেগুলো আসে কোত্থেকে? এই প্রশ্নের জবাব দেয় নেবুলার থিওরি বা নীহারিকা তত্ত্ব।

নীহারিকা মানে, সরল করে বললে একধরনের আন্তনাক্ষত্রিক মেঘ। এটি ধূলিকণা, হাইড্রোজেন গ্যাস এবং প্লাজমা দিয়ে গঠিত। আগে একসময় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, মানে আমাদের আকাশগঙ্গার বাইরের ছড়িয়ে থাকা বিস্তৃত যেকোনো জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুকে বলা হতো নীহারিকা। যেমন অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিকে একসময় বলা হতো অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা। এখন বিজ্ঞানীদের সে ভুল ভেঙে গেছে। নীহারিকা বলে তাই এখন সুনির্দিষ্টভাবে একধরনের আন্তনাক্ষত্রিক মেঘকে বোঝায়। এই মেঘ কোথায় থাকে? কেন, আন্তনাক্ষত্রিক স্থানে।

অনেকে হয়তো নক্ষত্রের মৃত্যুর গল্প শুনেছেন। একেক ধরনের নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটে একেকভাবে। এ রকম একধরনের নক্ষত্রের নাম সুপারনোভা বা অতি নবতারা। মৃত্যুর সময় এরা বিস্ফোরিত হয়। এই বিস্ফোরণ দেখার মতো ঘটনা বটে। বিস্ফোরণের ফলে মৃত নক্ষত্রটির দেহের সবকিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এসব পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে আন্তনাক্ষত্রিক স্থানে। এভাবে তৈরি হয় কিছু নীহারিকা। আবার গ্যালাক্সিদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে নীহারিকা তৈরি হয়। মোটকথা, মৃত গ্রহ, নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি—যেকোনো কিছুর অবশেষ আন্তনাক্ষত্রিক স্থানের ধূলিকণা ও গ্যাসের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে নীহারিকা তৈরি হতে পারে।

এই নীহারিকাই স্টেলার নার্সারি বা নক্ষত্রের আঁতুড়ঘর নামে পরিচিত। এখানে জন্ম নেয় নক্ষত্র। যে এইচ টু অঞ্চলের কথা আমরা বলেছি, আন্তনাক্ষত্রিক গ্যাস মেঘ, এসব আসলে নীহারিকার অংশ। কী অদ্ভুত না? এক প্রজন্ম মারা যাচ্ছে, তার অবশেষ থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন শিশু নক্ষত্র। ঠিক যেন রূপকথার ফিনিক্স! জন্ম নিয়েই যে উগরে দিচ্ছে ভয়ংকর আগুন। রূপকথা নয়, নিখাদ বাস্তব!

নীহারিকা থেকে খানিকটা দূরে কোনো সুপারনোভা বিস্ফোরিত হলে বা কোনো কৃষ্ণগহ্বর থেকে শকওয়েভ ছড়িয়ে পড়লে তার প্রচণ্ড ধাক্কা ঢেউ তোলে নীহারিকার বুকে। এই ধাক্কার ফলে আন্তনাক্ষত্রিক গ্যাসগুলো একসঙ্গে জড়ো হয়, তৈরি করে গ্যাস মেঘ

এখন প্রশ্ন হলো, নীহারিকার মধ্যকার কিছু গ্যাসের কি হঠাৎ মহাকর্ষের টানে জড়ো হয়ে যেতে ইচ্ছা করে? এ রকম যদি হবে, তাহলে একটা নীহারিকার সব গ্যাস ও ধূলিকণা এক হয়ে নক্ষত্র তৈরি করে ফেলে না কেন?

বিষয়টা আসলে এত সহজ নয়। বেশির ভাগ আন্তনাক্ষত্রিক স্থানের তাপমাত্রা যথেষ্ট বেশি এবং ঘনত্ব যথেষ্ট কম। ফলে এসব জায়গায় ভেতরের দিকে (মানে একে অন্যের প্রতি) তারা যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ অনুভব করে, প্রায় কাছাকাছি মানের বহির্মুখী চাপও অনুভব করে। ফলে নীহারিকা একটা স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে। তার ওপর ভেতরের গ্যাসীয় পদার্থগুলো আবার পাক খায়। ফলে উৎপন্ন হয় চুম্বকীয় চাপ বা ম্যাগনেটিক প্রেশার। এটাও বহির্মুখী, মানে মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে। সব মিলিয়ে নীহারিকা এত স্থিতিশীল, উচ্ছল ও চুম্বকীয় ধরনের হয় যে এসব গ্যাস একসঙ্গে হয়ে নক্ষত্র গঠন করার কথা নয়।

নীহারিকার মধ্যকার গ্যাসগুলো স্থবির নয়, তারা এক জায়গায় বসে নেই। চলাচল করছে ভেসে ভেসে। এ রকম দুটি গ্যাস মেঘের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে গ্যাসগুলো এত কাছে চলে আসতে পারে, ফলে তারা হয়ে উঠতে পারে নক্ষত্রের আঁতুড়ঘর। আরেকটি উপায় হলো বাইরের চাপ বা ধাক্কা। নীহারিকা থেকে খানিকটা দূরে কোনো সুপারনোভা বিস্ফোরিত হলে বা কোনো কৃষ্ণগহ্বর থেকে শকওয়েভ ছড়িয়ে পড়লে তার প্রচণ্ড ধাক্কা ঢেউ তোলে নীহারিকার বুকে। এই ধাক্কার ফলে আন্তনাক্ষত্রিক গ্যাসগুলো একসঙ্গে জড়ো হয়, তৈরি করে গ্যাস মেঘ।

আমাদের সৌরজগৎ আগে ছিল সৌর-নীহারিকা (Solar nebula)। নামটি আসলে বিজ্ঞানীরা সূর্যের সঙ্গে মিল রেখে দিয়েছেন। ডিম আগে না মুরগি আগে, এ রকম কোনো বিষয় এখানে নেই। এই নীহারিকার গ্যাস মেঘগুলো এত ছড়িয়ে ছিল যে তাদের মধ্যকার দুর্বল মহাকর্ষ তাদের একসঙ্গে জড়ো করতে পারত না কিছুতেই। সম্ভব হতো না মহাকর্ষীয় ভাঙন। এর খানিকটা দূরে একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে। পৃথিবীতে কিছু উল্কার বুকে এমন কিছু তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া গেছে, যেগুলো এ রকম কোনো সুপারনোভা বিস্ফোরণের অবশেষ। এই বিস্ফোরণ ঘটেছে সৌরজগৎ গঠিত হওয়ার ১০ থেকে ১০০ মিলিয়ন বছর আগেকার কোনো সময়ে। আরও আগে হলে এসব তেজস্ক্রিয় পদার্থ এত দিনে ক্ষয়ে বিলীন হয়ে যেত। অর্থাৎ সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে নীহারিকার গ্যাস মেঘে মহাকর্ষীয় ভাঙন ঘটে, ফলে জন্ম নেয় নক্ষত্র।

সূর্যেরও এ রকম বায়ু আছে, সৌরবায়ু। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র ঘিরে জ্বলজ্বলে প্লাজমার একটি আবরণ থাকে। তার নাম করোনা। সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের চারপাশে যে আভা দেখা যায়, সেটাই সূর্যের করোনা। এটি কয়েক মিলিয়ন কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত

একটা মজার তথ্য দিই। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নীহারিকার নাম হেলিক্স নীহারিকা। এটি সূর্যের কাছাকাছি ভরের কোনো মৃত নক্ষত্রের অবশেষ। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব ৭০০ আলোকবর্ষ।

দ্বিতীয় আরেকটি প্রশ্ন, নক্ষত্রবায়ু কী? নক্ষত্রবায়ু মানে, নক্ষত্রের ওপরের বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচণ্ড বেগে বেরিয়ে আসা গ্যাসের প্রবাহ। সূর্যেরও এ রকম বায়ু আছে, সৌরবায়ু। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র ঘিরে জ্বলজ্বলে প্লাজমার একটি আবরণ থাকে। তার নাম করোনা। সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের চারপাশে যে আভা দেখা যায়, সেটাই সূর্যের করোনা। এটি কয়েক মিলিয়ন কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। এই করোনার গ্যাসের বহির্মুখী চাপের ফলে প্রবলভাবে বেরিয়ে আসে সৌরবায়ু। ধারণা করা হয়, তরুণ বয়সে সৌরবায়ু আরও ভয়ংকর ছিল। সূর্যের জন্মের পর আশপাশের অপ্রয়োজনীয় সবকিছু তাড়িয়ে দিয়েছে এটি।

এ ধরনের নক্ষত্রবায়ুর ফলে শুধু আশপাশের অপ্রয়োজনীয় পদার্থই যে দূরে সরে যায়, তা নয়; নক্ষত্র নিজেও ভর হারায়। কারণ, নক্ষত্রবায়ু মূলত গ্যাসের প্রবাহ। এটা বেরিয়ে আসছে নক্ষত্র থেকে।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, সূর্য ও নক্ষত্রের ব্যাপারে আমরা এত কিছু জানি, কিন্তু এসব নক্ষত্রবায়ুর উৎপত্তির সঠিক কারণ আমরা আজও জানি না।

তবু আমরা মুগ্ধ চোখে দেখি রাতের আকাশের হাজারো নক্ষত্র। আর দিনের আকাশে তাকালে দেখি আমাদের সবচেয়ে আপন নক্ষত্রটিকে। পৃথিবীর বিশাল ও বৈচিত্র্যময় জীবন যার কাছে বড় ঋণী।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা