গভীর সমুদ্রের অজানা জগৎ

সমুদ্র দেখার আগ্রহ আমার কখনো শেষ হয় না। সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হয়, বিস্ময় আর রহস্যে ঘেরা একটা জগৎ আমার সামনে। অথচ আমি এর পুরোটা দেখতে পাচ্ছি না। যেখানে আগ্রহ আর রহস্য, সেখানেই প্রশ্ন, কৌতূহল আর বিজ্ঞানীদের আনাগোনা। গভীর সমুদ্রের অজানা এ জগৎকে জানতে দুঃসাহসী অভিযান করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর যে জায়গা, সেটার নাম চ্যালেঞ্জার ডিপ। এটা প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা ট্রেঞ্চের একটা অংশ। এর গভীরতা প্রায় ১১ হাজার ৩৪ মিটার। কিন্তু এতটা গভীরে কোনো মানুষের পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

আহমেদ নামে একজন মিসরীয় ২০১৪ সালে লোহিত সাগরে ৩৩২ মিটার পর্যন্ত পৌঁছে বিশ্বরেকর্ড করেছেন। এ রেকর্ড ভাঙ্গতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে বহু ডুবুরির। কারণ গভীর সমুদ্রে চাপ এত বেশি যে সেই চাপে মানবদেহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। সাধারণত ২০০ মিটার গভীর থেকে ধীরে ধীরে সমুদ্রের ভেতর আলো কমতে থাকে। আর ১ হাজার মিটার গভীরে সব কিছু অন্ধকার। গভীর সমুদ্রের তাপমাত্রাও খুব কম, ভীষণ ঠান্ডা সেখানে। এত সব চ্যালেঞ্জ সামলে সমুদ্রের রহস্য ভেদ করতে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন সাবমারসিবল। এক ধরনের ছোট ডুবোযান। বিজ্ঞানীরা যখন জাহাজে করে সমুদ্র অভিযানে বের হন, তখন তাঁদের জাহাজে আরও অনেক যন্ত্রপাতির সঙ্গে অনেক সময় সাবমারসিবলও থাকে। সমুদ্রের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে জাহাজ থেকে একে সমুদ্রে পাঠানো হয়। গভীর সমুদ্রের পানি এবং সমুদ্রের তলদেশের উপাত্ত সংগ্রহে এরা দারুণ কাজ করে।

তবে সবমারসিবল আর সাবমেরিন আসলে এক নয়। সাবমেরিন সাধারণত আকারে বড় হয়। এতে যথেষ্ট পাওয়ার এবং গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা থাকে। কাজেই একটা বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে আবার স্বাধীনভাবে সেখানে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু সাবমারসিবলের একটা সাপোর্ট সিস্টেম অথবা জাহাজের দরকার হয়। সাবমারসিবলে স্টিল ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, লাইট, উপাত্ত এবং নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, কোনো কিছু ধরার জন্য হাইড্রলিক বাহু, সোনার সিস্টেম, লেজার সিস্টেম, বিভিন্ন সেন্সরসহ অনেক কিছু থাকতে পারে। 

সাবমারসিবল আলভিন

সাবমারসিবল সাধারণত তিন ধরনের হয়। হিউম্যান অকুপাইড ভেহিকল (এইচওভি), রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকল (আরওভি) এবং অটোনোমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিকল (এইউভি)। এইচওভি-র নাম থেকেই বোঝা যায়, এর ভেতরে মানুষ থাকতে পারে। কিন্তু আরওভি এবং এইউভিতে কোনো মানুষ থাকে না। এসব সাবমারসিবলের কারণেই হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট (যেখানে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা প্রায় ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), টাইটানিক জাহাজ, মারিয়ানা ট্রেঞ্চসহ আরও নানা অভূতপুর্ব বিষয় সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি।  

এইচওভি-র মধ্যে বেশ নামকরা একটি হলো আলভিন। ১৯৬৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় চার হাজারের বেশি অভিযানে অংশ নিয়েছে এটি। এখন অবশ্য যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর ব্যাটারি, লাইট, ইমেজ সিস্টেমসহ সবকিছুতেই নিত্যনতুন প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে। একজন ডুবুরি যা করতে পারেন, এর ভেতর বসে একজন মানুষও সে কাজগুলো অনায়াসে করতে পারবে।

ভিডিও গেম খেলার সময় যেমন জয়স্টিক ব্যবহার করা হয়, আরওভি সাবমারসিবলগুলোকে অনেকটা সেভাবে জাহাজ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সাধারণত জাহাজের সঙ্গে ক্যাবল দিয়ে এরা সংযুক্ত থাকে। ক্যাবলের মাধ্যমেই সিগন্যাল আদান-প্রদান হয়। আরওভি হারকিউলিস তো প্রায় ১১৩ কিলোগ্রাম যত্রপাতি এবং নমুনা আনা-নেওয়া করতে পারে। এমনকি রিয়েল-টাইম টেলিপ্রেজেন্স বা ভিডিও কল করার মতো ভিডিও ক্যামেরাও আছে এর সঙ্গে। সমুদ্রে না থেকেও শিক্ষার্থী এবং বিজ্ঞানীরা অভিযানের সময় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন। ভোক্সওয়াগন বিটলস আকারের এই আরওভি সমুদ্রের প্রায় ৪ হাজার মিটার গভীর পর্যন্ত চাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে প্রায় তিন দিন ধরে।

কোনো কোনো গবেষণার ক্ষেত্রে এইচওভি এবং আরওভি একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়। টাইটানিক জাহাজ নিয়ে গবেষণায় এইচওভি আলভিন এবং আরওভি জেসন জুনিয়র একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছিল।

এইউভি সাবমারসিবলগুলো সবচেয়ে ছোট। এদের খরচও কম। কোনোরকম পাইলট বা সুপারভাইজার দরকার হয় না। সমুদ্রে পাঠানোর আগেই কী কী উপাত্ত কীভাবে সংগ্রহ করা হবে, সেসব এর মধ্যে প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়।  কিন্তু সমস্যা হলো, এর আকার ছোট। ব্যাটারি পাওয়ার সংরক্ষণের জন্য এখানে একসঙ্গে অনেক ধরনের সেন্সর এবং যন্ত্রাংশ সংযোজন করা যায় না। তবে বিভিন্ন কাজে এইউভি ব্যবহার করা হয়। যেমন সমুদ্র তলদেশের মানচিত্র তৈরি এবং সার্ভে করা, সমুদ্রের তাপমাত্রা, লবণাক্ততা এসব তথ্য সংগ্রহ ইত্যাদি। কিছু এইউভিতে ‘রিমাস শার্কক্যাম’ থাকে। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু সামুদ্রিক প্রাণীকে অনুসরণ করা সম্ভব হয়। যেমন বিখ্যাত সাদা হাঙর। এ ছাড়া স্প্রে গ্লাইডার সমুদ্রের তাপমাত্রা, চাপ, লবণাক্ততা, সমুদ্রস্রোত, সামুদ্রিক ক্লোরোফিল এবং বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারে।  

সমুদ্র গবেষণায় বিভিন্ন ধরনের সাবমারসিবলের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। এদেরকে আরও উন্নত এবং সহজলভ্য করার প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। গভীর সমুদ্রের বিশাল এক জগত এখনো আমাদের অজানা। তবে নিত্যনতুন বিস্ময়কর তথ্য আমাদের প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করছে। সেই সঙ্গে সামনে নিয়ে আসছে আরও অনেক নতুন প্রশ্ন এবং আবিষ্কারের উদ্দীপনা।  

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ডিপার্টমেন্ট অব ওশান অ্যান্ড আর্থ সায়েন্সেস, ওল্ড ডোমিনিয়ন ইউনিভার্সিটি, ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র