পড়া কেন জরুরি, জ্ঞান কেন অত্যাবশ্যক

বই পড়া কেন গুরুত্বপূর্ণছবি : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় তৈরি

আধুনিক সভ্যতা বিকাশের কেন্দ্রে রয়েছে জ্ঞানচর্চা। এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যুদ্ধ শেষে পাঠাগার জ্বালিয়ে দেওয়া ও মনীষী নিধনযজ্ঞে। ইতিহাসের পাতায় এমন নজির অনেক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিরা একটি শহরের দখল হারাবার আগে সে শহরের পাঠাগার জ্বালিয়ে দিত। লাখ লাখ বই তারা পুড়িয়েছে। ভাবনাটি এমন—জ্ঞান ধ্বংস করলে, অর্থাৎ মাথা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললে সে দেশ বা জাতি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।

তবে পশ্চিম পাকিস্তান ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যে কাজ করেছে, তার নজির ইতিহাসে বিরল। তারা কেবল বই পোড়ায়নি, পাঠাগার ধ্বংস করেনি; তারা চেয়েছে জ্ঞানের আধার নিশ্চিহ্ন করে দিতে। যে মানুষগুলো ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কারিগর হতে পারতেন, যে মানুষগুলোর কাঁধে ভর করে একটি যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ উঠে দাঁড়াতে পারত, তাঁদের সরিয়ে দিয়ে চরম বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মমতা দেখিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী।

অবাক হতে হয় এই জেনে যে খ্রিস্টপূর্ব ২০৫ অব্দে, অর্থাৎ আজ থেকে চার হাজার বছরেরও আগে, চীনের কিন সাম্রাজ্যের (Qin Dynasty) বিরুদ্ধে বিপ্লবে জড়িয়ে পড়েন শাং ইউ (Xiang Yu)। কিন রাজবংশকে পরাস্ত করার পর শিয়ানইয়াং প্রাসাদের পাঠাগারের সব বই পুড়িয়ে দেন তিনি। হত্যা করেন রাজসভার পণ্ডিত সভাসদদের। হাজার বছরের যুদ্ধকৌশল পাল্টালেও জাতি ধ্বংসের হাতিয়ার বদলায়নি একটুও! সময়ের পরিক্রমায় এমনটি ঘটেছে বারবার।

প্রথম শতকে প্রাচীন মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়া পাঠাগার যেভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিল রোমান শাসকেরা। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে স্প্যানিশ কংকিসতাদর বিশপ দে লান্দার মেক্সিকোর ইউকাটান জয়ের সময়ে, যখন তিনি মায়া সভ্যতার অসংখ্য দলিল জ্বালিয়ে দেন। এটা পনের শতকের কথা। এ সময় তিনি বলেন: এই মায়া কোডেক্স নাকি মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়।

সময় গড়িয়ে বিংশ শতাব্দীতে এলেও সে একই সংঘটন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে বেলজিয়ামের লেউভেন (Leuven) বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার পুড়িয়ে দেয় জার্মানরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে পুড়িয়ে দেয় ওয়ারস’ আর পোজনান শহরের অসংখ্য পাঠাগার। এ যেন জ্ঞান নিধনের বিকৃত, প্রমত্ত উল্লাস। একটি জাতির পুঞ্জীভূত জ্ঞানের বিনাশ না করলে যেন প্রতিহিংসার সবটুকু গরল ঢেলে দেওয়া হয় না। জাতিটির দার্শনিক, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আমলা—অর্থাৎ এর গর্বকে খর্ব করতেই হবে যেন! সামরিক জয় আর সেনা হত্যা যেন তৃপ্ত করে না যুদ্ধবাজদের, গণহত্যা ও মনীষী নিধন হয়ে দাঁড়ায় অনিবার্য। জ্ঞান যদি অপ্রয়োজনীয় হতো, বাড়তি হতো, তবে এর বিনাশের জন্যে কোনো জাতিই এমনি করে উদ্যত হতো না। জ্ঞান ও জ্ঞানী যেমন একান্ত আবশ্যক, তেমনি অনিবার্য পঠন ও লেখনও নিতান্ত জরুরি।

ওয়ারস' শহরের ধ্বংসপ্রাপ্ত জ্যাময়েস্কি পাঠাকার

মানবজাতির জন্মলগ্ন থেকেই ভাব প্রকাশের প্রয়াসে ভাষার উদ্ভব। কণ্ঠনিঃসৃত ৫০টির মতো ধ্বনি থেকে তৈরি হয় শব্দ, আর শব্দের গাঁথুনিতে বাঁধা পড়ে ভাবের প্রকাশ। মানুষে-মানুষে মিথষ্ক্রিয়ায় গড়ে ওঠে অবিন্যস্ত পিজিন (Pidgin) ভাষা, যা পরবর্তী প্রজন্মে সুবিন্যস্ত বা ক্রেওলাইজড হয় পরিপূর্ণ একটি ভাষায়। ভাষাহীন কোনো গোত্রের খোঁজ পাওয়া গেছে বলে আমার জানা নেই। তবে মৌখিক ভাষার জন্মের পরে এর পরিণতির জন্য প্রয়োজন পড়ে লিখিত স্ক্রিপ্টের।

সুমেরীয় আদি স্ক্রিপ্টের সৃষ্টি অবশ্য সাম্রাজ্যের কর আদায়ের লক্ষ্যে হয়েছিল। তবে উর্বর মানবমস্তিষ্ক এর যথার্থ ব্যবহার করেছে কাব্য রচনায়, দার্শনিক প্রপঞ্চ উপস্থাপনে আর জীবনমুখী গল্পের বর্ণনায়। জ্ঞানের সৃষ্টি ও সংরক্ষণ মানবোন্নয়নের ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে লিখিত ভাবনাবিন্যাস, অর্থাৎ গ্রন্থিত ভাবনার পঠনে এবং পঠন-পরবর্তী অনুচিন্তায় নির্গমনের প্রকৃত পথ বেছে নিয়েছে, এমন জাতির সংখ্যা হাতেগোনা। যে জাতি এটা করতে পেরেছে, তার জয়রথ রুখতে পারেনি কেউ। সতের শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, প্রায় কয়েক হাজার বছর ধরে মানবোন্নয়নের কেন্দ্রে অবস্থান করেছে প্রাচ্যের দেশগুলো। সভ্যতার কেন্দ্রে ছিল তারা। বিশ্ব অর্থনীতির সিংহভাগ ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। এরপর, মাত্র এক শতাব্দীর ভেতর, বিজ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান অন্বেষণকে কেন্দ্রে রেখে পাশ্চাত্যের দেশগুলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র স্থানান্তরিত করে ফেলেছে। হাজার বছরের প্রগতির মিছিলকে এক শতাব্দীতে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে কেবল জ্ঞানান্বষেণের মাহাত্ম্যে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই জ্ঞানসৃষ্টির সূত্রটি তবে কী?

অন রিডিং অ্যান্ড বুকস প্রবন্ধের প্রচ্ছদ

আর্থার শোপেনহাওয়ার ‘অন রিডিং অ্যান্ড বুকস’ প্রবন্ধে বলছেন, একটি গ্রন্থপাঠের রয়েছে নানা স্তর। প্রথমবার পড়ার সময় লেখকের চিন্তার খোঁজ পাবেন কেবল পাঠক। অর্থাৎ, গ্রন্থপাঠ জ্ঞানার্জনের প্রাথমিক স্তর। রচনার পেছনে যে চিন্তা রয়েছে, তা লেখক পাঠকের জন্য সম্পন্ন করে রেখেছেন। পাঠককে চিন্তার অবকাশ তিনি দেননি। তবে দ্বিতীয়বার রচনাটি পড়ার সময় এর অন্তর্গত ভাবটি অনুধাবন করা সম্ভব হবে, যা পাঠকের মনে চিন্তার উদ্রেক করবে। তবে এখানে থেমে গেলে চলবে না। এরপর, ভাবনার চূড়ান্ত স্তরে, পাঠক নিজস্ব চিন্তা থেকে যখন লিখনে মনোনিবেশ করবেন, তখন নতুন জ্ঞানের সঞ্চার ঘটবে। মেঠোপথ যেমন একবার পরিক্রমণে তৈরি হয় না, পদতলে বারবার তৃণদল দলিত হলে তবেই পথের ইঙ্গিত দেখা দেয়, তেমনি মানবজমিন একবার কর্ষণে ভাবনার পদাঙ্ক রেখে যাওয়া অসম্ভব। পঠন, পুণর্বার পঠন—বারবার পড়াই চিন্তা ও পরবর্তী জ্ঞান তৈরির মূল শর্ত।   

তবে যেকোনো রচনাপাঠই কি যথার্থ? লেখার মূল্যমান বিচারের কি কোনো প্রয়োজন রয়েছে? শোপেনহাওয়ার বলছেন: উন্নত, কালজয়ী লেখাই কেবল পাঠ করা উচিত। নিম্ন মানের ভুলে ভরা রচনা মস্তিষ্কে বিষ উদ্গিরণ করে। জীবনে সময় অল্প, তাই কেবল শ্রেষ্ঠ লেখা পঠনেই নিমজ্জিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাঁর ভাষায়: খারাপ লেখা যথাসম্ভব কম পড়া, আর ভালো লেখা বেশি পড়ার শেষ নেই। খারাপ বই বুদ্ধিবৃত্তিক বিষের মতো, মনন ধ্বংস করে দেয়। তাই ভালো জিনিস পড়তে মন্দকে ত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়, কারণ জীবন খুব ছোট। সময় ও শক্তি—দুটোই আমাদের সীমিত। (অন রিডিং বুকস, আর্থার শোপেনহাওয়ার রচনা সমগ্র)

আসন্ন ফেব্রুয়ারির আগুনঝরা সময়কে সামনে রেখে তাই আমাদের সংকল্প করতে হবে পড়ার। জাতি হিসেবে এ অভ্যাস আমরা প্রায় হারাতে বসেছি। রাজপথে কোনো রিক্সা বা বাস আরোহীকে আজ পড়তে দেখা যায় না বললেই চলে। বাড়ির আসবাবের বাহার চোখ ধাঁধানো, অথচ সমস্ত সংসার তন্নতন্ন করে একটি বইয়ের সন্ধান মেলে না।

এহেন ক্ষীণ ভাবনার সময় ফুরিয়েছে। বিশ্ব আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সন্ধানে ব্যস্ত। জ্ঞানের প্রসার ও নতুন প্রযুক্তির রথযাত্রার পাশে দাঁড়িয়ে কেবল প্রণাম ঠোকার সময় শেষ। আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ করতে হলে, জাতিকে প্রগতির পথে যেতে হলে, এ ভাষাভাষির মানুষকে, এ জাতির সন্তানকে জ্ঞানার্জনে মন দিতে হবে। বাংলায় চিন্তাশীল রচনা আজ একান্ত জরুরি, যা পরবর্তী প্রজন্মে আরেকজন রবীন্দ্রনাথ, আরেকজন নজরুল, আরেকজন মাইকেল, বিদ্যাসাগর, কিংবা জগদীশচন্দ্রের জন্ম দেবে। এ যাত্রার শুরুটুকু অন্তত হোক—জ্ঞান সৃষ্টির আদিসুর, পঠনে মনোনিবেশ করুক বাংলার মেধাবী মানুষ। ভাষার জয় হোক! জয় হোক একুশের! 

লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশ প্রকৌশল অনুষদ, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন