বইয়ের গন্ধরহস্য

নতুন বইয়ের গন্ধকে তিনটি মূল উৎসে ভাগ করা যেতে পারে। ১. বইয়ের কাগজ ও এটি প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত রাসায়নিক, ২. বইটি মুদ্রণে ব্যবহৃত কালি এবং ৩. বই বাঁধাইয়ে ব্যবহৃত আঠা।

আমরা প্রত্যেকেই পুরোনো বইয়ের সুরভির সঙ্গে সুপরিচিত। লাইব্রেরি কিংবা সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের দোকানগুলোতে যে অদ্ভুতভাবে মাতাল করা ম–ম গন্ধটি ছড়িয়ে থাকে। একইভাবে, নতুন কেনা বইয়ের পাতা খুলে নতুন ছাপানো কালি আর কাগজের সুগন্ধ কে না উপভোগ করে? অন্য সব সুগন্ধির মতো নতুন–পুরোনো বইয়ের গন্ধের পেছনে কিছু রাসায়নিক উৎস রয়েছে। কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে এই রাসায়নিক যৌগগুলো ও তাদের প্রক্রিয়াগুলো পর্যবেক্ষণ করা যায়।

বেশ কিছু কারণে নতুন বইয়ের গন্ধ যতখানি পাওয়া যায়, তার নির্দিষ্ট যৌগিক অবস্থান নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। প্রথমত, এ বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা খুব অল্প। আসলে এর স্বল্পতার কারণ, অগ্রাধিকারের তালিকায় না থাকা। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন বইয়ে আলাদা আলাদা রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে একটি বই অন্য বইয়ের থেকে আলাদা গন্ধ ছড়ায়। এ ছাড়া এই গবেষণা উপেক্ষিত থাকার আরও একটি কারণ হচ্ছে, এতে শত শত রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতি।

নতুন বইয়ের গন্ধকে তিনটি মূল উৎসে ভাগ করা যেতে পারে। ১. বইয়ের কাগজ ও এটি প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত রাসায়নিক, ২. বইটি মুদ্রণে ব্যবহৃত কালি এবং ৩. বই বাঁধাইয়ে ব্যবহৃত আঠা।

সাধারণত অ্যাসিড হাইড্রোলাইসিস এই প্রক্রিয়াগুলো বিস্তৃত উদ্বায়ী জৈব যৌগ তৈরি করে, ফলেই পুরোনো বইয়ের গন্ধের সৃষ্টি

কাগজ উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়। যদিও কাঠের মণ্ড থেকে বৃহৎ পরিমাণে কাগজ তৈরি করা হয় (কিছু তুলা ও সুতা থেকেও হয়), সেখানে কস্টিক সোডা হিসেবে সোডিয়াম হাইড্রো–অক্সাইড থাকে, যেটা মণ্ডর তন্তুকে ফুলে উঠতে এবং এর পিএইচ বৃদ্ধিতে কাজ করে। এরপর এই তন্তুগুলোকে সাদা করার জন্য হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডসহ আরও কয়েকটি রাসায়নিকের সঙ্গে মেশানো হয়। এ ছাড়া প্রচুর পানিও মেশানো হয়। এই পানিতে কাগজের বৈশিষ্ট্য উৎপন্নকারী বিভিন্ন অ্যাডিটিভ মিশ্রিত থাকে। যেমন একেডি (অ্যালকাইল কিটিন ডাইমার)। এটা সাধারণত কাগজের পানি প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাইজিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া আরও কিছু যৌগ ব্যবহৃত হয়।

এত এত রাসায়নিকের ভিড়ে শুধু যেসব রাসায়নিক বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটায় এবং বাতাসে উদ্বায়ী যৌগ (ভিওসি) ছড়াতে পারে, আমরা কেবল তাদের গন্ধ শনাক্ত করতে পারি। মুদ্রণের কালি ও বাইন্ডিংয়ে ব্যবহৃত আঠার ক্ষেত্রেও একই কথা। বাইন্ডিংয়ের কাজে যে আঠাগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর বেশির ভাগ জৈব কো-পলিমারের ওপর ভিত্তি করে প্রচুর পরিমাণে ছোট ছোট অণু রাসায়নিকভাবে একসঙ্গে জোট বেঁধে থাকে। এ ছাড়া কাগজের আঠা ও কালির পার্থক্য নতুন বইয়ের গন্ধকে প্রভাবিত করে। সুতরাং সব নতুন বই থেকে একই গন্ধ পাওয়া যায় না। সম্ভবত কোনো গবেষণায় এখনো বইয়ের সুগন্ধির সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়নি।

কিন্তু যে সুগন্ধি নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা চালানো হয়েছে, সেটি হচ্ছে পুরোনো বইয়ের গন্ধ। এর কারণ, যেসব জৈব যৌগ পরিবেশে ছড়ায়, তাদের ঘনত্ব মূল্যায়ন করা। ফলে গন্ধে অবদান রাখা অনেকগুলো যৌগের মধ্যে কিছুটা বেশি নিশ্চিত হওয়া যায়। সাধারণত কাগজের যৌগগুলোর রাসায়নিক ভাঙনের ফলে এই গন্ধ পাওয়া যায়। যার মধ্যে ১০০ বছর আগের বইয়ের তুলনায় আধুনিক বইয়ে সেলুলোজ ও লিগনিনের উপস্থিতি অনেকাংশে কম। এই দুই উপাদানই গাছ থেকে পাওয়া যায়। আবার নিউজপ্রিন্টের কাগজে লিগনিন তুলনামূলকভাবে কম। এটি জারণ প্রক্রিয়ায় অ্যাসিডে বিভক্ত হয়ে সেলুলোজকে ভাঙতে সাহায্য করে। এটিই মূলত বয়সের সঙ্গে কাগজের হলদেটে ভাবের জন্য দায়ী। ‘পুরোনো বইয়ের গন্ধ’ ব্যাপারটা এই রাসায়নিক ক্ষয়ের ফলেই উদ্ভূত। আধুনিক উচ্চমানের কাগজ হয়তো লিগনিনকে অপসারণ করে প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব, কিন্তু আশপাশের অ্যাসিডের কারণে সেলুলোজের ভাঙন অনেক ধীরগতির হলেও চলবেই।

আপনি যদি ইতিমধ্যে এই নতুন কিংবা পুরোনো কোনো বইয়ের পর্যাপ্ত গন্ধ না পেয়ে থাকেন, তাহলে জেনে নিশ্চয়ই অবাক হবেন, এই গন্ধগুলো বাজারে কিনতেও পাওয়া যায়।

সাধারণত অ্যাসিড হাইড্রোলাইসিস এই প্রক্রিয়াগুলো বিস্তৃত উদ্বায়ী জৈব যৌগ তৈরি করে, যার ফলে পুরোনো বইয়ের গন্ধের সৃষ্টি। কিছুসংখ্যক নির্বাচিত অংশ তাদের জোরালো করে, যেমন বেনজালডিহাইড একটি বাদামের মতো সুগন্ধ ছড়ায়, ভ্যানিলিন ভ্যানিলার গন্ধ যুক্ত করে, ইথাইল বেনজিন ও টলুইন মিষ্টি গন্ধ উৎপন্ন করে এবং ২-ইথাইল হেক্সানল মৃদু ফুলের গন্ধ ছড়ায়।

এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত অন্যান্য অ্যালডিহাইড ও অ্যালকোহলের গন্ধ হালকা হলেও এরাও অবদান রাখে। এ ছাড়া উৎপাদিত অন্যান্য যৌগ পুরোনো বইয়ের অবক্ষয়ের পরিমাণ নির্দেশক প্রয়োজনীয় যৌগও চিহ্নিত হয়েছে। ফুরফরাল তাদের মধ্যে অন্যতম। আঠারো শতকের মাঝামাঝি কিংবা আরও পরে প্রকাশিত বই থেকে ছড়ানো ফুরফরালের ওপর নির্ভর করে এর বয়স ও রচনা নির্ধারণ করা হয়। তুলা বা লিনেন (শণ) কাগজে রচিত বইগুলো থেকে উৎপাদিত গন্ধের তীব্রতা এর প্রকাশের বর্ষের সঙ্গে বাড়তে থাকে। পরিশেষে বলা যায়, অনেকগুলো সুগন্ধির মধ্য থেকে আমরা কোনো নির্দিষ্ট একটা যৌগ বা যৌগিক পরিবারকে সুগন্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি না। তবে আমরা সম্ভাব্য অবদানকারীদের শনাক্ত করতেই পারি।

কিন্তু আপনি যদি ইতিমধ্যে এই নতুন কিংবা পুরোনো কোনো বইয়ের পর্যাপ্ত গন্ধ না পেয়ে থাকেন, তাহলে জেনে নিশ্চয়ই অবাক হবেন, এই গন্ধগুলো বাজারে কিনতেও পাওয়া যায়।

বইয়ের গন্ধের রসায়ন

নতুন কিংবা পুরোনো—উভয় প্রকার বই-ই শ খানেক বিভিন্ন প্রকারের উদ্বায়ী যৌগ কিংবা ভিওসি ছড়ায়। এই যৌগগুলোর আবার রয়েছে বৈচিত্র্যময় উৎস। কিছু আসে যৌগের ক্ষয়ের ফলে আর বাকিটা বই তৈরির কাগজের ধরন, বাইন্ডিং আঠা আর মুদ্রণের কালি থেকে।

পুরাতন বইয়ের গন্ধের রহস্য
নতুন বইয়ের সুবাসের পেছনের বিজ্ঞান

লেখক: শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সূত্র: কম্পাউন্ড কেমিস্ট্রি