খাদ্য যখন মাইক্রোপ্লাস্টিক

খাবারের প্লেটে প্লাস্টিক! অসম্ভব! এত খাবার থাকতে প্লাস্টিক খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না! শিরোনাম দেখে আপনার মনে এ কথাই প্রথমে আসা স্বাভাবিক। অথচ আপনি প্রতিদিনই এই প্লাস্টিক খাচ্ছেন! কী, অবাক হলেন? মাছে ফরমালিন খেতে পারেন, শাকসবজির সঙ্গে কীটনাশক খেতে পারেন, প্যাকেটজাত খাবারে ক্ষতিকারক কেমিক্যাল খেতে পারেন, তাহলে প্লাস্টিক কেন নয়? চলুন দেখে নিই, কীভাবে আমাদের অজান্তেই খাবারের প্লেটে চলে আসছে প্লাস্টিক।

পৃথিবীজুড়ে এক আতঙ্কের নাম প্লাস্টিকদূষণ। মাটিতে, নদীতে এমনকি সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এই প্লাস্টিক। প্লাস্টিক কেন এত ক্ষতিকর? কারণটা কমবেশি আমরা সবাই জানি। প্লাস্টিক পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায় না। কারণ, এটি অপচনশীল বস্তু। ধরুন, আপনি কোনো প্লাস্টিকের বোতল কোনো একটা স্থানে রেখে এলেন। কোটি বছর পরও গিয়ে দেখবেন, ওই জায়গায় ওই স্থানে অবিকল রয়েছে ওই প্লাস্টিকের বোতলটি। অবশ্য কোটি বছর আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ০ শতাংশ! আবার আপনার এদিক–সেদিক প্লাস্টিক ছুড়ে ফেলার কারণে কোটি বছর জন্মদিন পালন করার আগেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল! মাটি আর পানি—এই দুই স্থানেই আছে প্লাস্টিকের বিশাল রাজত্ব। বাদ ছিল বাতাস। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এই বাতাসেও রাজত্ব তৈরি করে বসে আছে প্লাস্টিক! এরা খুবই ছোট আকারের প্লাস্টিক, বাতাসে উড়ে চলা ধূলিকণা সাইজের। আকারে ছোট বলে এদের নাম মাইক্রোপ্লাস্টিক। অবশ্য চোখে দেখা এমন আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিকও আছে। এরা আসলে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা। প্লাস্টিকের পণ্য তৈরি বা রিসাইকেল করার সময় তৈরি হয় এই অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা। এরপর এরা ভেসে বেড়ায় বাতাসে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা ফুসফুসে গেলে তা আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজে নানা রকম সমস্যা তৈরি করে। এভাবে অজান্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক বাতাসকে দূষিত করে। তবে আজকাল কারখানাগুলো জেনে–বুঝে তৈরি করছে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক! অর্থাৎ জেনেশুনেই আমরা পরিবেশদূষণ করছি। কীভাবে? বেশ কয়েক বছর আগেও সাবান বা শ্যাম্পুর হরেক রকম রংই ভোক্তাদের আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এখন শ্যাম্পুর তরলে রঙের সঙ্গে দেখা যায় অনেক চকচকে কণা। সাবানেও তা–ই। এসব গ্লিটার কণাকে মাইক্রোবিডস বলা হয়। মেকআপসামগ্রী তো গ্লিটার ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। এই গ্লিটার আসলে মাইক্রোপ্লাস্টিক ছাড়া আর কিছুই নয়! চকচকে এই মাইক্রোপ্লাস্টিককে আমরা চোখে দেখতে পাই, কিন্তু শ্যাম্পু বা ফেসওয়াশে অনেক আগে থেকেই মাইক্রোবিডসের ব্যবহার ছিল। চুল বা ত্বককে আরও মসৃণ করে তোলে এই মাইক্রোবিডস। ভোক্তাও খুশি, তাই কোম্পানিগুলো হয়তো অতি উৎসাহে এই মাইক্রোবিডসগুলোকে চকচকে করে একেবারে দৃশ্যমান করে তুললেন। সারা বিশ্বে দোকানের তাকে তাকে পৌঁছে গেল মাইক্রোপ্লাস্টিকভর্তি বোতল।

অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, বোতলের প্লাস্টিক তৈরি করতে যে পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক লেগেছে, বোতলের ভেতরের তরলে তার থেকে বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে! আবার আমাদের দৈনন্দিন অনেক কাজের কারণে মাইক্রোপ্লাস্টিক পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। যেমন, আমরা বিভিন্ন কৃত্রিম সুতার কাপড় পরি। পলিস্টিরিন, নাইলন বা অন্যান্য পলিমারের তৈরি কাপড় যখন আমরা পানিতে ধুই, তখন কাপড় থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিকের আঁশ বের হয়ে পানিতে মিশে যায়। এই পানি বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে চলে যায় একেবারে সমুদ্রে। আবার গোসলের পানির সঙ্গে ওই সাবান বা শ্যাম্পুর মাইক্রোপ্লাস্টিকেরও শেষ আবাস হয় সমুদ্রে। তাই সাগর এখন শুধু বড়সড় প্লাস্টিকের বোতল, প্যাকেট বা টুকরাই নয়, বরং ক্ষুদ্র থেকে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা দিয়ে সয়লাব হয়ে গেছে।

মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিশাল জীবনচক্র তো জানা হলো। কিন্তু খাদ্যচক্রে কীভাবে এই মাইক্রোপ্লস্টিক চলে এল? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ঢুকে যেতে হবে খাদ্যজালে। এই যে পানিতে মিশে যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, তা চলে যাচ্ছে সমুদ্রে বা মাটিতে। মাটিতে ফসল হচ্ছে। গাছেরা মাটি থেকে পানি আর খাদ্যরস সংগ্রহের পাশাপাশি শুষে নিচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। সেই উদ্ভিজ্জ খাবার আমরা খাচ্ছি। আর সঙ্গে খাচ্ছি মাইক্রোপ্লাস্টিক!

এবার আসি প্রাণিজ খাদ্যে। সমুদ্রের মাছেরা বিভিন্ন বড় সাইজের প্লাস্টিকের টুকরা বা ব্যাগ ভুল করে খেয়ে ফেলে। মৃত সামুদ্রিক মাছের পেটে এমন অনেক প্লাস্টিকের নমুনা পাওয়া গেছে। আর অদৃশ্য মাইক্রোপ্লাস্টিক যে কত সহজে তাদের পেটে চলে যাচ্ছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। যদি মাইক্রোপ্লাস্টিক খাওয়ার পর সহজেই মাছেদের শরীর থেকে বের হয়ে যেত, তাহলে হয়তো দুশ্চিন্তার কিছু থাকত না। কিন্তু এই মাইক্রোপ্লাস্টিক তাদের শরীরে টিকে থাকতে পারে বেশ কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত। আর আমাদের রান্নার চুলায় ওঠার আগে দূর হয় না মাইক্রোপ্লাস্টিক, থেকে যায় মাছেদের শরীরেই।

মার্ক ব্রাউনি নামের এক গবেষক ২০০৮ সালে এক প্রজাতির ঝিনুকের রক্ত মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পেয়েছিলেন। পরে সিডনির নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। খাদ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি মানুষের শরীরে কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, সে নিয়ে ব্রাউনি আরও গবেষণা করেছেন। তিনি দেখেছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক রক্ত জমাট বাঁধিয়ে ফেলতে পারে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে জমা হয়ে অঙ্গকে বিকল করে ফেলতে পারে। যেমন যকৃৎ বিকল হয়ে যেতে পারে। এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এমন আরও ছোট–বড় নানা সমস্যা দেখা যায়।

মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বাঁচার উপায় কী? আসলে মাইক্রোপ্লাস্টিক খাবারে চলে এলেই আমাদের জন্য সব থেকে ক্ষতিকর। তাই নিরাপদ খাবার গ্রহণ করা জরুরি। তবে দুঃখের বিষয় হলো কোনো খাবারই এখন আর নিরাপদ নয়, কারণ মাছ–মাংস থেকে সবুজ শাকসবজি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। এখন খাবার মেন্যু বদলের আগে জরুরি অভ্যাস আর রুচি বদল করার। প্লাস্টিকের পণ্য রিসাইকেল করলেও প্লাস্টিকদূষণ থেকে মুক্তি নেই। তাই প্লাস্টিকের তৈরি সব জিনিস ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ব্যবহার করতে হবে বিকল্প প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি জিনিস।

আমরা চাইলেই প্লাস্টিকের ব্যাগ বা পলিথিনের পরিবর্তে কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করতে পারি। কৃত্রিম তন্তুর বদলে প্রাকৃতিক সুতি তন্তুর পোশাক পরতে পারি। বাহারি ক্ষতিকারক পণ্যে আকৃষ্ট না হয়ে প্রাকৃতিক প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহার করতে পারি। আমরা ভোক্তারা যদি সরে আসি, তাহলে প্রস্তুতকারকেরা আর প্লাস্টিকের দিকে ঝুঁকবেন না। ভোক্তার চাহিদার কথায় মাথা রেখে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজে থেকেই নতুন নতুন মানসম্মত প্রাকৃতিক পণ্য বাজারজাত করা শুরু করবে। তখন বাঁচবে পৃথিবী, বাঁচবে প্রাণীরা, বাঁচব আমরা। পৃথিবী থেকে দূর হবে মাইক্রোপ্লাস্টিক নামের অভিশাপ।

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান