সতর্কসংকেত: কোনটার কী মানে?

সাগর উত্তাল হলে ঝুঁকিতে পড়ে উপকূল ও আশপাশের জীবন। সবাইকে সতর্ক করার জন্য আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘোষণা করে সতর্ক সংকেত। আসন্ন দুর্যোগের ভয়াবহতা অনুযায়ী এ সংকেতের মাত্রা নির্ধারিত হয়। এসব সংকেতের অর্থ সবারই জেনে রাখা প্রয়োজন। আসুন জেনে নিই সতর্ক সংকেতগুলোর অর্থ…

ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। তাই এখানকার আবহাওয়া সব সময় অস্থিতিশীল আচরণ করে। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়ে প্রতিবছরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাধারণ মানুষকে তাই সব সময় কান খোলা রাখতে হয়, অপেক্ষা করতে হয় সতর্কসংকেতের। ১-২-৩ সতর্কসংকেত কিংবা ৮-৯-১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত। এসব সংকেতের মানে কী?

আবহাওয়ার সতর্কসংকেতের বেশ কয়েকটি ভাগ আছে—দূরবর্তী সতর্কসংকেত, দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত, স্থানীয় সতর্কসংকেত, স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত, বিপৎসংকেত, মহাবিপৎসংকেত ও যোগাযোগবিচ্ছিন্ন সংকেত। আবার সতর্কসংকেত সব এলাকার জন্য সমান নয়। বেশির ভাগ ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম সাগরে। পরে এটা স্থলভাগেও ধেয়ে আসে। কিন্তু সাগরই উত্তাল থাকে সবচেয়ে বেশি। এ জন্য সমুদ্রবন্দরকেন্দ্রিক সতর্কসংকেত অনেক বেশি—মোট ১১টি। নদীবন্দরগুলোর জন্য মাত্র চারটি। সমুদ্রগামী ও নৌগামীদের জন্য এ সংকেত কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আর বলার অবকাশ রাখে না।

সমুদ্রের জন্য আবহাওয়ার সতর্কসংকেত

১ নম্বর সর্তক সংকেত: সমুদ্রগামী নাবিক ও মৎস্যজীবীদের জন্য সতর্কসংকেতের শুরুটা হয় ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্কসংকেত দিয়ে। এ সংকেত মানে হলো, সমুদ্রবন্দর থেকে দূরে একটা ঝোড়ো হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ার বেগ সর্বোচ্চ ৬১ কিলোমিটার। অর্থাৎ ছোটখাটো একটা ঝড় বইছে দূরে। সুতরাং জাহাজ বা মাছ ধরার নৌকাকে অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে এ সময় সমুদ্রে চলাচল করতে হবে। এক্ষেত্রে বন্দরে ও উপকূলীয় এলাকায় একটি লাল পতাকা টাঙানো হয়।

২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত: গভীর সমুদ্রে হয়তো তখন একটা ঝড় তৈরি হয়েছে, যার বেগ ঘণ্টায় ৬১-৮৮ কিলোমিটার। অর্থাৎ এ সংকেতের মানে গভীর সমুদ্রে মাঝারি তীব্রতার একটি ঝড় হচ্ছে।

৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত: এ ক্ষেত্রে ঝোড়ো হাওয়াটা আসলে উপকূলেই বইছে। বিশেষ করে সমুদ্রবন্দর আক্রান্ত। বন্দর এলাকায় এর গতিবেগ ৩০-৪০ কিলোমিটার। যেহেতু উপকূল ঘেঁষেই ঝড়টা বইছে, তাই গভীর সমুদ্রে এই ঝড় আরও শক্তিশালী। এ অবস্থায় জাহাজ বা নৌকা বন্দর ত্যাগ করলে ঝড়ের কবলে পড়বে। এমনকি বন্দরে নোঙর করা জাহাজ বা নৌকাও ঝড়ে আক্রান্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে বন্দরে ও উপকূলীয় এলাকায় দুটি লাল পতাকা টাঙানো হয়।

৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত: এটি ৩ নম্বরের চেয়ে আরেকটু শক্তিশালী এবং এই ঝড়ে বন্দরের জাহাজ ও নৌকা ইতিমধ্যে ঝড়ে আক্রান্ত হয়েছে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ৫১-৬১ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

৫ নম্বর বিপৎসংকেত: এ সংকেতের অর্থ হলো সমুদ্রবন্দর আরেকটু তীব্র ঝড়ে আক্রান্ত হবে। এ সময় ছোট বা মাঝারি ঝড় বয়ে যাবে বন্দর এলাকা দিয়ে। ঘণ্টায় যার গতিবেগ হবে ৬২-৮৮ কিলোমিটার। এটা বন্দরকে বাঁ দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড়।

৬ নম্বর বিপৎসংকেত: এই ঝড়ের গতিবেগ ৫ নম্বরের মতোই। তবে এটা বন্দরকে ডান দিকে রেখে উপকূল এলাকা ত্যাগ করে।

৭ নম্বর বিপৎসংকেত: এর ঝড়ের গতি একই। তবে এ সংকেতের অর্থ হলো ঝড় সরাসরি বন্দরের ওপর দিয়ে চলে যেতে পারে অথবা বন্দরের কোল ঘেঁষে উপকূল ত্যাগ করবে। এক্ষেত্রে বন্দরে ও উপকূলীয় এলাকায় তিনটি লাল পতাকা টাঙানো হয়।

৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত: মহাবিপৎসংকেত শুরু হয় ৮ নম্বর থেকে। ঝড়ের বেগ তখন প্রচণ্ড—৮৯ কিলোমিটারের বেশি। এ সময় ঝড়টি বন্দরকে বাঁ দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এই মাত্রার ঝড়ে।

৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত: এটিও ৮ নম্বরের মতো। দুইয়ের পার্থক্য হলো ঝড় এ সময় উপকূল অতিক্রম করে বন্দরকে ডানে রেখে।

১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত: সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝড় যখন সরাসরি বন্দরের ওপর দিয়ে অতিক্রম করে, তখন ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের ঘোষণা দেন আবহাওয়াবিদেরা। এ সময় ঝড়ের গতিবেগ থাকে ৮৯ কিলোমিটারের বেশি। কিন্তু সরাসরি বন্দর অতিক্রম করে বলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি হয়।

১১ নম্বর যোগাযোগবিচ্ছিন্ন সংকেত: সর্বোচ্চ মাত্রার বিপৎসংকেত হলো ১১ নম্বর যোগাযোগবিচ্ছিন্ন সংকেত। এ সময় আবহাওয়া অফিসের সঙ্গে বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সব রকম যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় উপদ্রুত বন্দর বা সামুদ্রিক জাহাজগুলো। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

নদীর জন্য আবহাওয়ার সতর্কসংকেত

সমুদ্রবন্দরের তুলনায় নদীবন্দরগুলোতে ঝড়ের মাত্রায় অনেক তফাত। তাই বিপৎসংকেতেও পার্থক্য দেখা যায়। চারটি ভিন্ন সংকেতের মাধ্যমে নদীবন্দরগুলোকে সতর্ক থাকতে বলেন আবহাওয়াবিদেরা।

১ নম্বর নৌ সতর্কসংকেত: কালবৈশাখী যদি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে বন্দর বা এর আশপাশের এলাকা দিয়ে বয়ে যায়, সেটার জন্য ১ নম্বর নৌ সতর্কসংকেত জারি করেন আবহাওয়াবিদেরা। এই সংকেতের অর্থ হলো বন্দর এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষেত্রে আবহাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক নজর রাখা উচিত।

২ নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি: ঘণ্টায় ৬১ কিলোমিটার বা তার বেশি বেগে কোনো কালবৈশাখী বয়ে গেলে ২ নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। কালবৈশাখী না হয়ে একই বেগে নিম্নচাপ বয়ে গেলেও ২ নম্বর নৌ হঁশিয়ারি সংকেত দেওয়া হয়। এ ধরনের ঝড়ে ছোট, অর্থাৎ ৬৫ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের নৌযানগুলোকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়।

৩ নম্বর নৌ বিপৎসংকেত: এ সংকেতের অর্থ হচ্ছে নদীবন্দর সরাসরি মাঝারি ধরনের ঝড়ে আক্রান্ত হতে চলেছে। এ সময় বাতাসের বেগ থাকতে পারে ৬২-৮৮ কিলোমিটার। সব ধরনের নৌযানকেই নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হয় এ সংকেত পেলে।

৪ নম্বর নৌ মহাবিপৎসংকেত: বন্দর এলাকা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝড়ে আক্রান্ত হলে ৪ নম্বর নৌ মহাবিপৎসংকেত জারি করেন আবহাওয়াবিদেরা। এ সময় বাতাসের গতি থাকে ৮৯ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি। এ ধরনের সংকেত মানেই সব ধরনের নৌযানকে নিরাপদ এলাকায় থাকতে হবে।