জীবাশ্ম জ্বালানি না থাকলে কী হতো?

শিল্প বিপ্লবের আগে জ্বালানির প্রয়োজন ছিল মূলত রান্না-বান্না, ঘর গরম করা এবং ধাতু গলিয়ে বিভিন্ন হাতিয়ার ও জিনিস বানানোর কাজে। সে সময়ের প্রধান জ্বালানি ছিল শুকনো কাঠ ও কাঠ কয়লা। জ্বালানির চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকায় ১৬ শতকেই কাঠের যোগানে টান পড়তে শুরু করে।

১৬ শতকের শেষ দিকে আবিষ্কৃত হয় খনিজ কয়লা। এর কিছুকাল পরেই শিল্প বিপ্লবের নতুন যুগের সূচনা ঘটে। পৃথিবীতে জ্বালানি চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। শিল্প বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তিই ছিল কয়লা। পরে ধীরে ধীরে আবিষ্কার হয় তেল বা গ্যাসের মতো নবায়ন অযোগ্য জ্বালানি।

আজকের পৃথিবী বিদ্যুৎ ছাড়া কল্পনা করা কঠিন। বিদ্যুতের বড় অংশ তৈরি হয় এসব জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে। শুধু কি বিদ্যুৎ? পৃথিবীজুড়ে মানুষ প্রতিনিয়ত ছুটছে। এই ছোটাছুটির জন্য যে যানবাহন তার শক্তিও আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। যেদিক থেকেই দেখি না কেন, সভ্যতার এই অগ্রগতির পেছনে জীবাশ্ম জ্বালানির বড় অবদান রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানি না থাকলে সভ্যতা কি এতদূর আসতে পারত? জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়া পৃথিবীটা কেমন হতো?

কয়লা এবং পেট্রোলিয়াম জাতীয় তেল যে শুধু জ্বালানি হিসেবেই ব্যবহৃত হয়, তা কিন্তু নয়। প্লাস্টিক, সিন্থেটিক রবারের মতো উপাদান তৈরি করা করার কাজেও ব্যবহৃত হয় জীবাশ্ম জ্বালানি। এ জ্বালানি না থাকলে হাইড্রোকার্বনের দীর্ঘ চেইন অণুগুলো সংশ্লেষণ করতে হতো ইথানল বা ভোজ্য তেল থেকে। ইথানল ও ভোজ্য তেল থেকে এসব উপাদান সংশ্লেষণ করার পদ্ধতিটি বেশ জটিল। ফলে প্লাস্টিক এবং সিন্থেটিক রবারের মতো উপাদান আবিষ্কৃত হতো অনেক দেরীতে। এসব পণ্যের দামও হতো অনেক বেশি।

জীবাশ্ম জ্বালানি না থাকলে কৃষি ক্ষেত্রে তার বড় প্রভাব পড়ত। কৃষি কাজে গাছের বৃদ্ধির জন্য বিশ্বজুড়ে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। এর মূল উপাদান অ্যামোনিয়া। আর অ্যামোনিয়া উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস। 

বুঝতেই পারছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি না থাকলে সারের উৎপাদন তীব্রভাবে ব্যহত হতো। জমিতে ফসলের উৎপাদন বাড়ত না। যার প্রভাব পড়ত জনসংখ্যায়। শিল্প বিপ্লবের পর আমরা পৃথিবীতে জনসংখ্যার যে বিস্ফোরণ দেখতে পাই, তা হয়ত ঘটত না। জনসংখ্যা বাড়ত খুব ধীর গতিতে।

জিন প্রযুক্তির উন্নয়নে কারণে খাদ্য উৎপাদন বাড়লে হয়ত তখন বাড়ত জনসংখ্যা। কিন্তু সেজন্য তো প্রয়োজন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। প্রয়োজন বিদ্যুৎ।

জীবাশ্ম জ্বালানি না থাকলে সবচেয়ে বড় সমস্যা হতো বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনে। তেল বা গ্যাস পুড়িয়ে যত সহজে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, অন্য কোনোভাবে এখনও তত সহজভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। তেল, গ্যাস বা কয়লা ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, বাতাস, পানি এবং সৌরশক্তি ব্যবহার করে। তবে এসব ক্ষেত্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ এখনও বেশ কম। নিউক্লিয়ার ফিউশন ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু এটা বেশ ব্যয়বহুল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়া পৃথিবীতে বিদ্যুতের আবিষ্কার বা ব্যবহার থেমে থাকত না। তবে কমে যেত সভ্যতার গতি। কিংবা পুরো সভ্যতাই গড়ে উঠত ভিন্নভাবে।

জীবাশ্ম জ্বালানি সভ্যতার উন্নয়নে অনেক অবদান যেমন রেখেছে, তেমনি মানুষের মাত্রাতিরিক্ত এই জ্বালানি ব্যবহার ঝুঁকির মুখে ফেলেছে পৃথিবীর প্রাণ বৈচিত্র্যকে। গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে বেড়ে গেছে পৃথিবীর উষ্ণতা। জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব এখন অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। পোড়া ধোঁয়া প্রতিনিয়ত বিষাক্ত করে তুলছে পৃথিবীর বাতাসকে। জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়া আমরা হয়ত এতটা দ্রুত উন্নতির শিখরে উঠতাম না, কিন্তু পৃথিবীটা হয়ত আরও একটু সুস্থ থাকত। হতো আরও একটু সুন্দর।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস