জন্মদিন
জামাল নজরুল ইসলাম: মহাবিশ্বের নিয়তির সন্ধান
আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের সমাধান করেছেন তিনি। অনুসন্ধান করেছেন মহাবিশ্বের ভবিতব্য। গণিতের ভাষায় যেমন তা প্রকাশ করেছেন, তেমনি লিখেছেন সাধারণ মানুষের জন্যও। জামাল নজরুল ইসলামের জন্মদিনে বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
বিজ্ঞানজগতে বাংলাদেশের গর্ব বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও কসমোলজিতে তাঁর যুগান্তকারী অবদান রয়েছে। তাঁর মৌলিক গবেষণাগুলোকে প্রধানত পাঁচটি ধাপে ভাগ করা যায়—কণাপদার্থবিজ্ঞানের ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশনের গাণিতিক বিশ্লেষণ, জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের সঠিক সমাধান, মহাজাগতিক ধূলিকণার ক্ষেত্র সমীকরণের সমাধান, মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি ও গাণিতিক অর্থনীতি।
জামাল নজরুল ইসলামের মৌলিক গবেষণা শুরু হয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন তিনি গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি শুরু করেছেন। তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজার ছিলেন ব্রিটিশ গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী জন ক্লেটন টেইলর। তিনি আবার অধ্যাপক আবদুস সালামের ছাত্র। ১৯৫৬ সালে আবদুস সালাম ও রিচার্ড ইডেনের তত্ত্বাবধানে তিনি কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরিতে পিএইচডি করেছেন। এরপর যোগ দিয়েছিলেন লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে, অধ্যাপক আবদুস সালামের ডিপার্টমেন্টে। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত সেখানে অধ্যাপনা করেন। এরপর ১৯৬১ সালে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকস ও থিওরেটিক্যাল ফিজিকস ডিপার্টমেন্টে। সেই বছরই সেখানে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন জামাল নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন জন টেইলরের প্রথম পর্যায়ের ছাত্রদের একজন। তখন মাত্র ২২ বছরের তরুণ তিনি, আর তাঁর সুপারভাইজার জন টেইলরের বয়স তখন ৩১।
গাণিতিক দক্ষতায় তুখোড় জে এন ইসলামের আগ্রহ পার্টিক্যাল ফিজিকসের সমসাময়িক গাণিতিক সমস্যা সমাধানের প্রতি। কাজ শুরু করলেন মাত্র তিন বছর আগে, ১৯৫৮ সালে উদ্ভাবিত ‘ম্যান্ডেলস্ট্যাম ভেরিয়েবল’ নিয়ে।
যাঁর নামে এই ভেরিয়েবল, সেই অধ্যাপক স্ট্যানলি ম্যান্ডেলস্ট্যাম তখন ইংল্যান্ডেই ছিলেন। বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিকসের অধ্যাপক তখন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে জন্ম তাঁর। বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন ১৯৫৬ সালে। ১৯৫৮ সালে পোস্টডক্টরেট ফেলোশিপ করার সময় তিনি কণাপদার্থবিজ্ঞানে রিলেটিভিস্টিক, তথা আপেক্ষিকতার আলোকে গাণিতিক হিসাবের সুবিধার্থে উদ্ভাবন করেন একটা বিশেষ সুবিধাজনক পদ্ধতি, যা তাঁর নামেই পরিচিতি লাভ করে—ম্যান্ডেলস্ট্যাম ভেরিয়েবলস। দুটি কণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ঘটার সময় তাদের শক্তি, ভরবেগ ও পারস্পরিক কৌণিক অবস্থান—সব কটি কার্যকরভাবে গাণিতিক সমীকরণে প্রকাশ করার জন্য ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশন খুব কার্যকর।
ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশন উদ্ভাবনের ১০ বছর আগে, ১৯৪৮ সালে মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকসের হিসাব–নিকাশ সহজ করার জন্য উদ্ভাবন করেছেন ‘ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম’। ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশন অনেকটা সে রকম পদ্ধতি হলেও ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর প্রথম গবেষণাতেই চতুর্মাত্রিক ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের সঙ্গে ম্যান্ডেলস্ট্যাম পদ্ধতির সমন্বয় ঘটালে কী হয়, তা গাণিতিকভাবে করে দেখালেন। ১৯৬২ সালের ১৮ মে তিনি জার্নাল অব ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিকস–এ প্রকাশের জন্য পাঠালেন নিজের প্রথম গবেষণাপত্র ‘মডিফায়েড ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশন ফর হেভি পার্টিকেলস’। সে বছরই নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়।১
নিজের প্রথম গবেষণাপত্রে জামাল নজরুল ইসলাম ম্যান্ডেলস্ট্যামের পদ্ধতি অনেক ভারী কণার ওপর প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে ভারী কণার ক্ষেত্রে ফোর্থ অর্ডার ফাইনম্যান অ্যামপ্লিচ্যুড কাজ করে না। এ গবেষণায় তিনি বার্গম্যান-ওয়েইল ফর্মুলা ব্যবহার করেছেন। অনেকগুলো গাণিতিক চলক বা ম্যাথমেটিক্যাল ভেরিয়েবলকে একসঙ্গে সমন্বয় করে ইন্টিগ্রাল ফর্মুলায় ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বার্গম্যান-ওয়েইল ফর্মুলা খুব কার্যকর গাণিতিক পদ্ধতি। ১৯৩৫ সালে ফরাসি গণিতবিদ আঁন্দ্রে ওয়েইল এবং ১৯৩৬ সালে পোলিশ-আমেরিকান গণিতবিদ স্টিফেন বার্গম্যান আলাদাভাবে এই ফর্মুলা আবিষ্কার করেন।
প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর দ্বিতীয় গবেষণাপত্র ‘অ্যাকনডস অ্যান্ড কাস্পস অ্যান্ড দ্য ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশন’ প্রকাশের জন্য পাঠান জার্নাল অব ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিকস–এ। ১৯৬৩ সালের জুলাই সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়।২ এ গবেষণাতেও তিনি ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম ও ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশনের সমন্বয়ের সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করেন ল্যান্ডাউ সমীকরণে প্রয়োগের মাধ্যমে। কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরিতে কণার বিক্ষেপণের মাত্রা হিসাব করার জন্য ফাইনম্যান ইন্টিগ্রালের শর্তগুলো নির্ধারিত হয় ল্যান্ডাউ সমীকরণের মাধ্যমে। সোভিয়েত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী লেভ ল্যান্ডাউ ১৯৬২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তরল হিলিয়ামের সুপারফ্লুইডিটি আবিষ্কারের জন্য।
১৯৬২ সালে অধ্যাপক জন টেইলরের গ্রুপে যোগ দেন সদ্য পিএইচডি করা ব্রিটিশ তরুণ পিটার ভিনসেন্ট ল্যান্ডশফ। জামাল নজরুল ইসলামের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় অংশ নিতে পিটারও খুব আগ্রহী। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই জন টেইলর, পিটার ল্যান্ডশফ ও জামাল নজরুল ইসলাম যৌথভাবে ‘সিঙ্গুলারিটি অব দ্য রেজ্জে অ্যামপ্লিচ্যুড’ নামে একটা গবেষণাপত্র তৈরি করেন।
ইতালির তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী টুলিও রেজ্জে ১৯৫৯ সালে স্ক্যাটারিং ম্যাট্রিক্স প্রপার্টিজ গবেষণাপত্রে প্রকাশ করেছেন উচ্চশক্তির কণার বিক্ষেপণের সূত্র ‘রেজ্জে থিওরি’। রেজ্জে অ্যামপ্লিচ্যুড হিসাব করা হয় বিক্ষেপণের মাত্রা থেকে। কণাপদার্থবিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছিল এই গবেষণাপত্র। পরে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি, স্ট্রিং থিওরি এবং অন্যান্য ভারী কণার মিথস্ক্রিয়ার হিসাব কষতে ব্যবহৃত হয় এ গবেষণাপত্র। জামাল নজরুল ইসলাম রেজ্জে অ্যামপ্লিচ্যুডের সীমাবদ্ধতা নির্ণয় করেছেন ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশন বিশ্লেষণের মাধ্যমে। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে ফিজিক্যাল রিভিউয়ে প্রকাশিত হয় এই গবেষণাপত্র।৩
১৯৬৩ সালের এপ্রিলে জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর পরের গবেষণাপত্র ‘লিডিং ল্যান্ডাউ কার্ভস অব সাম ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম’ পাঠালেন ইতালির নোভো সিমেন্টো জার্নালে। এই গবেষণায় ল্যান্ডাউ কার্ভের সঙ্গে ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের উপযোগিতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ম্যান্ডেলস্ট্যাম রিপ্রেজেন্টেশন পরীক্ষা করে দেখা হয়। অবশ্য এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে অক্টোবর মাসে। তার আগেই তিনি তাঁর পিএইচডি থিসিস জমা দিয়েছেন।৪
১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যতটুকু গবেষণা করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম, সেটুকু যথেষ্ট ছিল তাঁর পিএইচডি থিসিসের জন্য। ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি তাঁর পিএইচডি থিসিস ‘অ্যানালাইটিক প্রপার্টিস অব এস-ম্যাট্রিক্স এলিমেন্টস’ (Analytic Properties of S-Matrix Elements) জমা দেন। এর মাধ্যমে মাসখানেক পরই অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি।
তবে পিএইচডির ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি বিভাগে যোগ দেন রিসার্চ ফেলো হিসেবে। কোরিয়ান বংশোদ্ভূত পদার্থবিজ্ঞানী ইয়ং সু কিম মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে ১৯৬২ সালে যোগ দিয়েছেন মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে। ইউএস এয়ারফোর্স আর ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের দুটি রিসার্চ গ্র্যান্টের আওতায় তিনি তাঁর প্রথম রিসার্চ ফেলো হিসেবে বেছে নেন জামাল নজরুল ইসলামকে।
মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে দুই বছর ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। কণাপদার্থবিজ্ঞানের দুরূহ গণিত নিয়েই গবেষণা চালিয়ে গেছেন সেখানেও। ১৯৬৫ সালের জুনে ফিজিক্যাল রিভিউয়ে প্রকাশিত হলো ডক্টর কিমের সঙ্গে তাঁর যৌথ গবেষণাপত্র ‘অ্যানালিটিক প্রপার্টি অব থ্রি-বডি ইউনিটারিটি ইন্টিগ্রাল’।৫ এই গবেষণা তাঁর আগের গবেষণাগুলো থেকে কিছুটা আলাদা হলেও বিষয়ের দিক থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র নয়। বিক্ষেপণের সময় তিনটি কণার মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার জটিল গাণিতিক শর্তাবলি নির্ণয়ে ম্যান্ডেলস্ট্যাম প্রেজেন্টেশন ও ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের বিশ্লেষণ এ গবেষণাতেও আছে।
জামাল নজরুল ইসলাম ম্যান্ডেলস্ট্যাম প্রেজেন্টেশন–সংক্রান্ত অত্যন্ত জটিল যেসব গাণিতিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, সেগুলো পরে কণাপদার্থবিজ্ঞানের গাণিতিক বিশ্লেষণ এবং কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির গণিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যে স্ট্রিং থিওরি তখনো জন্ম লাভ করেনি, সেই স্ট্রিং থিওরিতেও এসব গাণিতিক বিশ্লেষণ ব্যবহার করা হচ্ছে।
১৯৬৫ সালের শরৎকালে মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আবার কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ফিরে এলেন জামাল নজরুল ইসলাম। এবার যোগ দিলেন প্রফেসর ফ্রেড হয়েলের কসমোলজি গ্রুপে। গাণিতিক কসমোলজির গবেষণা শুরু করলেন এখানে এসে।
১৯৬৪ সালে রয়্যাল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ পরপর তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকার।৬ এই তিনটি গবেষণাপত্রে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির আলোকে স্টেডি-স্টেট থিওরির সমর্থনে তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা দুজন। স্টেডি-স্টেট থিওরির সমর্থনে তাঁরা একটি কাল্পনিক ক্রিয়েশন ফিল্ড বা সি-ফিল্ডের ধারণা প্রবর্তন করেন। এ তত্ত্ব সঠিক হলে মহাবিশ্ব প্রসারিত হলেও তার গড় ঘনত্ব সব সময় অপরিবর্তিত থাকবে। সে ক্ষেত্রে অনবরত নতুন পদার্থের উদ্ভব হতে হবে। সি-ফিল্ডের প্রভাবে শূন্য থেকে হাইড্রোজেন পরমাণুর উদ্ভব হতে থাকে যতটুকু দরকার হয়, যখন দরকার হয়। গ্রিন ফাংশনের সাহায্যে সি-ফিল্ডের গাণিতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকার। তাঁরা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের সাহায্যে তড়িৎ–চৌম্বক ক্ষেত্র এবং সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রয়োগে ভরক্ষেত্রের গাণিতিক বিশ্লেষণও করেন গ্রিন ফাংশনের মাধ্যমে। এ জন্য মহাকর্ষের একটি নতুন তত্ত্বও দেন তাঁরা।৭ সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই তাঁদের এই নতুন তত্ত্বে। কেবল পার্থক্য হলো সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ব্যাখ্যায় এবং মহাকর্ষ ধ্রুবকের মান নির্ধারণে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা সমীকরণের বিশেষ পর্যায়ে [যখন Rik = 0] শূন্য মহাবিশ্ব বা মহাশূন্য অবস্থা তৈরি হতে পারে, যেখানে শূন্যস্থানের জন্যও স্থান দরকার হয়। ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের মহাকর্ষের নতুন তত্ত্ব অনুসারে, শূন্যস্থান একেবারেই শূন্য। তাকে স্থান দেওয়ার কোনো দরকার নেই। শুধু তা–ই নয়, যেকোনো স্থানে কমপক্ষে দুটি কণা থাকতে হবে এই নতুন তত্ত্ব অনুসারে।
জামাল নজরুল ইসলাম ফ্রেড হয়েলের গ্রুপে যোগ দিয়েই প্রথম যে গবেষণাটি করলেন, সেটা হয়েল ও নারলিকারের সি-ফিল্ড, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ও ম্যাস-ফিল্ডে যেভাবে গ্রিন ফাংশন প্রয়োগ করা হয়েছে, সেভাবে ডিরাক-ফিল্ডে গ্রিন ফাংশনের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা।
ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের সঙ্গে আলোচনা–পর্যালোচনার পর জামাল নজরুল ইসলাম রয়্যাল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশ করেন ‘গ্রিন ফাংশন ফরমুলেশন অব দ্য ডিরাক ফিল্ড ইন কার্ভড স্পেস’।৮ বলা যায়, এ গবেষণাপত্রের মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর গবেষণার নতুন ক্ষেত্র—সাধারণ আপেক্ষিকতা। তিনিই প্রথম গ্রিন ফাংশনের মাধ্যমে ডিরাক–ফিল্ডের গাণিতিক ফর্মুলা আবিষ্কার করেন।
১৯৬৬ সালে ফ্রেড হয়েল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রথম ইনস্টিটিউট এটাই। এর আগে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি অবজারভেটরি স্থাপিত হয়েছিল ১৮২৩ সালে। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সোলার ফিজিকস অবজারভেটরি। ১৯৭২ সালে এই তিন বিভাগকে একত্র করে প্রতিষ্ঠা করা হয় কেমব্রিজ ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমি। থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হলেন ফ্রেড হয়েল। প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন জয়ন্ত নারলিকার। জামাল নজরুল ইসলামও এ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন গবেষণা-বিজ্ঞানী হিসেবে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি এ প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত বিজ্ঞানী হিসেবে গবেষণা করেছেন।
ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের নতুন মহাকর্ষ তত্ত্বের আলোকে বিভিন্ন ধরনের ফিল্ড ইকুয়েশনের ক্ষেত্রে গ্রিন ফাংশন ফর্মুলা কেমন হবে, সে–সম্পর্কিত জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণাপত্র যে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে
১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি ইনস্টিটিউটে গবেষণা করে সাতটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন জামাল নজরুল ইসলাম। এ সময় তাঁর গবেষণার মূল বিষয় ছিল সাধারণ আপেক্ষিকতা ও মহাকর্ষ, যেগুলো ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি বা গাণিতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মৌলিক গাণিতিক ভিত্তি।
১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করে আবার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছিলেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের নতুন মহাকর্ষ তত্ত্বের আলোকে বিভিন্ন ধরনের ফিল্ড ইকুয়েশনের ক্ষেত্রে গ্রিন ফাংশন ফর্মুলা কেমন হবে, সে–সম্পর্কিত জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণাপত্র যে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে, তা আগেই বলেছি। এবার তিনি যেকোনো ধরনের মহাকর্ষ ক্ষেত্রে কণাগুলোর মিথস্ক্রিয়ার গ্রিন ফাংশন ফর্মুলা প্রকাশ করলেন তাঁর ‘গ্রিন ফাংশন ফরমুলেশন অব ইন্টারঅ্যাকশনস অব আর্বিটারি ফিল্ডস’ গবেষণাপত্রে।৯
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে কাজ করার সময় ফ্রেড হয়েল ও জয়ন্ত নারলিকারের নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব–সংক্রান্ত ক্ষেত্র-সমীকরণের ওপর জামাল নজরুল ইসলামের শেষ গবেষণাপত্র ‘কনফর্মাল ফ্রেমস অ্যান্ড ফিল্ড ইকুয়েশনস ইন আ কনফর্মাল থিওরি অব গ্র্যাভিটেশন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে।১০ তত দিনে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ এবং অন্যান্য প্রমাণ সামনে আসার পর ফ্রেড হয়েলের স্টেডি-স্টেট ইউনিভার্সের ধারণা নিষ্প্রভ হয়ে যেতে শুরু করেছে। জামাল নজরুল ইসলাম এবার তাঁর গবেষণায় সরাসরি নক্ষত্রের দিকে মনোযোগ দিলেন।
নক্ষত্রের গঠনসংক্রান্ত গবেষণাপত্র পড়তে শুরু করলেন তিনি। জ্যোতির্বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ানের ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অব স্টেলার স্ট্রাকচার বইটি শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। নক্ষত্রের গঠন সম্পর্কে জানার জন্য এর চেয়ে নির্ভরযোগ্য বই সে সময় আর ছিল না। জামাল নজরুল ইসলাম এই বই পড়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যের পদার্থবিজ্ঞান-কসমোলজি গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলেন।
১৯৬৯ সালের মে মাসের মধ্যে জামাল নজরুল ইসলাম শেষ করলেন তাঁর ‘সাম জেনারেল রিলেটিভিস্টিক ইনইকুয়ালিটিস ফর আ স্টার ইন হাইড্রোস্ট্যাটিক ইকুইলিব্রিয়াম’ গবেষণাপত্রের প্রথম খণ্ড। প্রফেসর ফ্রেড হয়েল তা পাঠিয়ে দিলেন রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে। ১৯৬৯ সালে সোসাইটির মান্থলি নোটিশ-এ তা প্রকাশিত হলো।১১ ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করলেন এই গবেষণার দ্বিতীয় খণ্ড। জয়ন্ত নারলিকারের মাধ্যমে সেটা প্রকাশিত হলো ১৯৭০ সালে।১২ নক্ষত্রগুলোর অভ্যন্তরীণ গ্যাসের চাপ এবং বাইরের মহাকর্ষ বলের চাপের মধ্যে সমতা রক্ষার জন্য সাধারণ আপেক্ষিকতার যেসব গাণিতিক চলক বিভিন্ন ধরনের শর্ত মেনে চলে, সেগুলো সহজীকরণ করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম এই দুটি গবেষণাপত্রে। আইনস্টাইনের ক্ষেত্র-সমীকরণ সমাধানে তাঁর এই পদ্ধতি খুব কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি ইনস্টিটিউটে তাঁর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) যোগ দেন ভিজিটিং অ্যাসোসিয়েট হিসেবে। এক বছর ছিলেন সেখানে। তখন তাঁর হোস্ট ছিলেন প্রফেসর কিপ থর্ন। বিশ্বখ্যাত এই ইনস্টিটিউটে তখন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় জামাল নজরুল ইসলামের।
১৯৭২ সালে জামাল নজরুল ইসলাম ক্যালটেক থেকে সিয়াটলের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে অ্যাস্ট্রোনমির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তাঁর হোস্ট ছিলেন প্রফেসর জর্জ ওয়ালেরস্টেইন ও ফিলিপ কার্ল পিটারস। প্রফেসর ওয়ালেরস্টেইন নক্ষত্রের গঠন ও তাদের রাসায়নিক বিবর্তনের নিউক্লিওসিন্থেসিস নিয়ে গবেষণা করছিলেন সেই সময়। আর প্রফেসর পিটারস কাজ করছিলেন উইক ফিল্ড গ্র্যাভিটেশনাল স্ক্যাটারিং সম্পর্কে। তাঁদের সান্নিধ্যে থেকে জামাল নজরুল ইসলাম কসমোলজির বিভিন্ন বিষয় শিখেছেন, যা তাঁর গবেষণাকে সমৃদ্ধ করেছে।
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে আবার কয়েক মাসের জন্য প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে গেলেন জামাল নজরুল ইসলাম। সেখানে সেবার তাঁর দীর্ঘ আলোচনা হয় গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসনের সঙ্গে। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত জামাল নজরুল ইসলামের নক্ষত্রের হাইড্রোস্ট্যাটিক ইকুইলিব্রিয়াম–সংক্রান্ত গবেষণাপত্রগুলো পড়ে ফ্রিম্যান ডাইসন জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণার প্রতি খুব আগ্রহী ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে তৈরি হয় সম্মানজনক বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের লেকচারার পদে যোগ দেন জামাল নজরুল ইসলাম। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তিনি কসমোলজিতে সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রায়োগিক দিকের ব্যাপারে ব্যাপক পড়াশোনা করেন।
১৯৭৫ সালে জামাল নজরুল ইসলাম যোগ দেন কার্ডিফের ইউনিভার্সিটি কলেজের (বর্তমানে কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি) অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমি ডিপার্টমেন্টে। এ ডিপার্টমেন্টে প্রফেসর হিসেবে যোগ দিয়েছেন শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নলিন চন্দ্র বিক্রমসিঙ্গে এবং লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছেন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী বার্নার্ড শোৎজ। কার্ডিফে জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণা সহযোগী ছিলেন বার্নার্ড শোৎজ। তাঁরা একসঙ্গে গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেছেন।
১৯৭৮ পর্যন্ত কার্ডিফ কলেজে ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। এ সময় তাঁর গবেষণার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির আইনস্টাইনের সমীকরণের সঠিক সমাধান খুঁজে বের করা। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তাঁর ৯টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতা বিষয়ে, বিশেষ করে আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের সমাধান বিষয়ে।
মহাবিশ্বে স্থান–কালের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয় মহাকর্ষ বল দিয়ে। এর সঠিক গাণিতিক ব্যাখ্যার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব হলো আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতা, যা মহাকর্ষ বলের ফিল্ড ইকুয়েশন বা ক্ষেত্র সমীকরণে প্রকাশ করা যায়। অন্যদিকে মহাবিশ্বের বস্তু ও শক্তিগুলোর মধ্যে যে অবিরাম জটিল মিথস্ক্রিয়া চলছে, তা ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমীকরণ হলো ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ, যেগুলো তড়িৎ–চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব রিপ্রেজেন্ট করে। মহাবিশ্বের গণিত বুঝতে হলে এই দুটির কোনোটা ছাড়া চলবে না। আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ মহাবিশ্বকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে। জামাল নজরুল ইসলাম আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের বিভিন্ন অবস্থার সমাধান করার চেষ্টা করেছেন তাঁর অনেকগুলো গবেষণাপত্রে।
১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হলো আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ সমাধানে তাঁর গবেষণাপত্র ‘আ ক্লাস অব অ্যাপ্রোক্সিমেট স্টেশনারি সলিউশনস অব দ্য আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল ইকুয়েশনস’।১৩
আইনস্টাইনের ভ্যাকুয়াম ফিল্ড ইকুয়েশনের ঘূর্ণমান অবস্থার সমাধান তখনো পাওয়া যায়নি। জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালে আইনস্টাইনের সেসব সমীকরণের সমাধান প্রকাশ করলেন তাঁর ‘আ ক্লাস অব অ্যাপ্রোক্সিমেট এক্সটেরিওর রোটেটিং সলিউশনস অব আইনস্টাইন’স ইকুয়েশনস’।১৪
এর কয়েক মাস পরই প্রকাশিত হলো আইনস্টাইনের সমীকরণের সার্বিক ঘূর্ণনের সমাধানসমৃদ্ধ গবেষণাপত্র ‘অন দ্য এক্সিস্ট্যান্স অব আ জেনারেল রোটেটিং সলিউশন অব আইনস্টাইন’স ইকুয়েশনস’।১৫
আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির স্ট্যাটিক ফিল্ড ইকুয়েশনের সমাধান করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালের দুটি গবেষণাপত্রে। স্ট্যাটিক ফিল্ড সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় না। শুধু তা–ই নয়, স্ট্যাটিক ফিল্ডে কোনো ঘূর্ণন থাকে না, অর্থাৎ স্পেস টাইমে কোনো ভাঁজ পড়ে না। সেখানে মহাকর্ষক্ষেত্র সময়ের অপেক্ষক নয়। আইনস্টাইনের ভ্যাকুয়াম ফিল্ডকে স্ট্যাটিক ফিল্ড ধরে তার জেনারেল রিলেটিভিস্টিক সমাধান করেছেন জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘অন দ্য স্ট্যাটিক ফিল্ড ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ গবেষণাপত্রে।১৬ পরের বছর প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণার দ্বিতীয় খণ্ড ‘অন দ্য স্ট্যাটিক ফিল্ড ইন জেনারেল রিলেটিভিটি: টু’।১৭ এই গবেষণায় স্ট্যাটিক ফিল্ড তথা ভ্যাকুয়াম ফিল্ড ইকুয়েশনের সমাধান করা হয়েছে আগের চেয়ে ভিন্ন পদ্ধতিতে।
সেই সময় (১৯৭৭-৭৮) জামাল নজরুল ইসলামের মতো আর কেউ এত বিস্তারিত ও বহুমাত্রিক গণিতের মাধ্যমে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সমাধান করেননি। স্টিফেন হকিং এ ব্যাপারে নিজে আগ্রহী হয়ে জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তাঁর পেপারগুলো রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশ করার জন্য।
জামাল নজরুল ইসলামের পরবর্তী গবেষণাপত্র ‘আ ক্লাস অব এক্স্যাক্ট ইন্টেরিয়র সলিউশনস অব দ্য আইনস্টাইন-ম্যাক্সওয়েল ইকুয়েশনস’ রয়্যাল সোসাইটিতে প্রকাশের জন্য পাঠালেন স্টিফেন হকিং।১৮
১৯৭৮ সালে লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটির গণিত বিভাগে যোগ দেন জামাল নজরুল ইসলাম। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। এ সময়ে তিনি কসমোলজি ও মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে যুগান্তকারী গবেষণাপত্র রচনা করেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে তাঁর ছয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এই গবেষণাপত্রগুলোর মধ্যে আছে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিণতির গাণিতিক রূপরেখা, আদি পৃথিবীর ব্ল্যাকহোলগুলোর বর্তমান অবস্থান কী হতে পারে, চার্জিত কণার ওপর জেনারেল রিলেটিভিটি থিওরির সমীকরণ এবং তাদের সম্ভাব্য সমাধান।
আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে রোটেটিং ফিল্ড বা ঘূর্ণমান ক্ষেত্রের গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন জামাল নজরুল ইসলাম।
১৯৭৭ সালে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির কোয়ার্টারলি জার্নাল-এ একটি ছোট্ট টেকনিক্যাল পেপার ‘পসিবল আলটিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স’ প্রকাশ করেন জামাল নজরুল ইসলাম। এরপর নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়াইনবার্গ, ফ্রিম্যান ডাইসন, স্টিফেন হকিং, জয়ন্ত নারলিকার প্রমুখ বিজ্ঞানী তাঁকে অনুরোধ করলেন এই টেকনিক্যাল পেপারের একটি জনপ্রিয় সংস্করণ রচনা করতে, যা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হবে। এর আগে এ রকম বিষয়ে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র বই প্রকাশিত হয়েছে। স্টিভেন ওয়াইনবার্গের ফার্স্ট থ্রি মিনিটস প্রকাশিত হয়েছে মাত্র এক বছর আগে। জামাল নজরুল ইসলাম সবার অনুরোধে রচনা করলেন দ্য আলটিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স।
১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তো বটেই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। পরে জামাল নজরুল ইসলামকে অনুসরণ করে এ রকম বই আরও অনেকে লিখেছেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত স্টিফেন হকিংয়ের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম-এর আইডিয়া দ্য আলটিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স থেকে উৎসারিত। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী পল ডেভিস ১৯৯৪ সালে প্রকাশ করলেন তাঁর জনপ্রিয় বই দ্য লাস্ট থ্রি মিনিটস, যা জামাল নজরুল ইসলামের বইটির পরের অধ্যায় বলা চলে। পল ডেভিস তাঁর বইয়ের সাবটাইটেলে উল্লেখ করেছেন ‘কনজেকসার্স অ্যাবাউট দ্য আলটিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স’।
আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে রোটেটিং ফিল্ড বা ঘূর্ণমান ক্ষেত্রের গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন জামাল নজরুল ইসলাম। তাঁর গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে রচনা করেছেন তাঁর আরেকটি মাইলফলক গবেষণাগ্রন্থ রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি। ১৯৮৫ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এই বই মূলত গবেষক ও শিক্ষার্থী–গবেষকদের জন্য লেখা। এ গবেষণার জন্য কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি জামাল নজরুল ইসলামকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি দেয়।
জনপ্রিয় বিজ্ঞান মানুষের কৌতূহল মেটায়, হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহও কিছুটা তৈরি করে। কিন্তু সত্যিকারের বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য দরকার বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ। জামাল নজরুল ইসলামের দ্য আলটিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স-এ মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় ব্যাখ্যা করা হয়েছে গণিত ব্যবহার না করে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের মূল ভাষা গণিত। মহাবিশ্বের উৎস, গঠন, বিবর্তন ও পরিণতির গণিত বুঝতে হলে একটা নির্ভরযোগ্য বইয়ের দরকার। সেই প্রয়োজনীয়তাও মিটিয়েছেন জামাল নজরুল ইসলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে তিনি রচনা করেছেন অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি। ১৯৯২ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর সব সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমোলজির শিক্ষার্থীদের জন্য এই বই প্রধান বইতে পরিণত হয়েছে। ২০০১ সালে এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে এর অনলাইন সংস্করণ।
দেশের টানে দেশে ফিরে এসে তিনি স্থাপন করেছেন আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। সেখান থেকে শতাধিক গবেষক তৈরি হয়েছে। কর্মজীবনের শেষের দিকে তিনি গাণিতিক অর্থনীতির গবেষণায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সঠিক অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারিত হলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারবে। ২০০৮ থেকে ২০১৩—এই পাঁচ বছরে তিনি গাণিতিক অর্থনীতি বিষয়ে ২০টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।
