রসায়ন
লিচু খেয়ে শিশুরা মারা যাচ্ছে কেন?
গত কয়েক বছর ধরেই লিচু খেয়ে শিশুমৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কেন? গবেষণা বলছে, এর পেছনে বিশেষ এক রাসায়নিক দায়ী। ছোট বাচ্চারা যদি খালি পেটে অনেকগুলো আধপাকা লিচু খায়, তাহলে লিচুতে থাকা একটি বিশেষ রাসায়নিক তাদের জন্য বিপদজনক হতে পারে। অবশ্য পেট ভরা থাকলে বা পাকা লিচু হলে বিপদের আশঙ্কা খুব অল্প। বিস্তারিত জানাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জাভেদ ইকবাল।
পত্রিকায় মাঝে মাঝে খবর আসে, লিচু খেয়ে শিশুদের মৃত্যু। অনেকে এটা উড়িয়ে দেয়, কারণ লিচু আমাদের পরিচিত ও পছন্দের ফল। তাহলে এটা কি গুজব, নাকি লিচু খেয়ে আসলেই মানুষ মারা যেতে পারে?
বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে আসলেই মানুষ মারা যেতে পারে। তার মধ্যে একটা হলো, খালি পেটে যদি কোনো শিশু অনেক লিচু খায়, তাহলে এটা ঘটতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এটার আশঙ্কা খুব কম। বাংলাদেশে রামবুটান পাওয়া যায় আজকাল। সেটা এবং লিচু পরিবারের আরও কিছু ফল আছে, যেগুলি খেলেও এই বিপদ হতে পারে। তবে নিয়মিত খাবারের পর পাকা লিচু খাওয়া নিরাপদ, অন্তত এই লেখায় বর্ণিত রোগের জন্য।
কিন্তু কেন এটা ঘটে? এর ছোট উত্তর হলো, কাঁচা লিচুতে এক ধরনের রাসায়নিক থাকে, যা শিশুদের জন্য বিষ। এটা শুধু শিশুদের জন্য বিপদজনক। কারণ তাদের শরীর ছোট, তাই অল্পতেই মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
লিচু খেলে কীভাবে মৃত্যু ঘটতে পারে, তা জানার আগে ডায়াবেটিস, ইনসুলিন আর রক্তের চিনির ব্যাপারে একটু জেনে নিই।
মনে করুন, কোষের দেয়ালে একটা তালাবদ্ধ বিশেষ রকমের দরজা আছে। আর শুধু এই দরজা দিয়েই চিনি কোষের ভেতরে ঢুকতে পারে। এই দরজাটার তালা খোলার চাবি হলো ‘ইনসুলিন’ নামে একটা হরমোন
রক্তের চিনি সরাসরি আমাদের কোষে ঢুকতে পারে না। মনে করুন, কোষের দেয়ালে একটা তালাবদ্ধ বিশেষ রকমের দরজা আছে। আর শুধু এই দরজা দিয়েই চিনি কোষের ভেতরে ঢুকতে পারে। এই দরজাটার তালা খোলার চাবি হলো ‘ইনসুলিন’ নামে একটা হরমোন। আমাদের প্যানক্রিয়াস বা অগ্নাশয় ইনসুলিন তৈরি করে। ইনসুলিন না পেলে খাবার থেকে হজম প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া চিনি কোষের ভেতরে ঢুকতে পারে না। যাদের ডায়াবেটিস হয়, তাদের ইনসুলিন কম থাকে, তখন রক্তে চিনি থাকলেও সেটা কোষে ঢুকতে পারে না। তাই রক্তে চিনির পরিমান (Blood Sugar) বেড়ে যায়। সেটা মেপে বোঝা যায় ডায়াবেটিস হয়েছে কি না।
এবার একটা দৃশ্যকল্প ভাবি। বিকাল পাঁচটা বাজে। দবীরউদ্দিন সাহেব সকাল থেকে কিছু খাননি। পেটে যেহেতু খাবার পড়েনি, তার রক্তে তাই চিনির পরিমাণ কম। কিন্তু নার্স এসে তার রক্তে চিনির পরিমাণ না মেপেই তাকে ইনসুলিন ইনজেকশন দিয়ে দিল। বাড়তি ইনসুলিন পেয়ে সব কোষের চিনি-দরজা খুলে গেল, কোষগুলি সব চিনি হজম করে নিল। তার কিছুক্ষণ পর কোষগুলো আর চিনি পাবে না। জ্বালানির অভাবে তারা একে একে কাজ বন্ধ করে দেওয়া শুরু করবে। তখন দুর্বল লাগবে, মাথা ঘুরবে, অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন কেউ কেউ। চিনি এ রকম অস্বাভাবিক কমে যাওয়াকে বলা হয় হাইপোগ্লাইসেমিয়া। হাইপো মানে নিচু বা কম। আর গ্লাইকো মানে যা থেকে চিনি তৈরি হয়। এটাকে ডায়াবেটিক শকও বলা যায়। হাইপোগ্লাইসেমিয়া অন্য কারণেও হতে পারে। যেমন প্রচুর ব্যায়াম করলে, অথবা না খেলে সব চিনি শেষ হয়ে গিয়ে স্বল্পকালীন হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। আবার দবীরউদ্দিন সাহেব ঠিকমত খাওয়ার পর তাকে ভুলে ইনসুলিনের বেশি ডোজ দিয়ে দিলে, কিংবা ভুল সময়ে দিলেও তার হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। এর চিকিৎসা হতে পারে সঙ্গে সঙ্গে চিনি বা গ্লুকোজ খাওয়ানো।
হাইপোগ্লাইসেমিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে মস্তিষ্কে। জ্বালানি (চিনি) না পেয়ে মস্তিষ্কে এক ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি হবে, ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং নিউরনের দেয়াল ভেঙ্গে যাবে। যথেষ্ট পরিমাণ নিউরন মারা যাওয়া মানে ব্রেন ড্যামেজ। ফলাফল, এক সময় মৃত্যু।
লিচুতে মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যাতে হাইপোগ্লাইসেমিয়া নিয়ে এত লম্বা ভূমিকা করার যথেষ্ট কারণ আছে। লিচুতে মিথাইলিন সাইক্লোপ্রপাইল গ্লাইসিন (Methylenecylopropylglycine—MCPG) নামে একটা অ্যামিনো অ্যাসিড আছে। এটার খুব কাছের আত্মীয় ‘হাইপোগ্লাইসিন এ’ (Hypoglycin A)। এখানেও হাইপো আর গ্লাইসিন। তাহলে এই অ্যামিনো অ্যাসিডটার কাজ কী হতে পারে? যদি নাম থেকে ভেবে থাকেন, এটার সঙ্গে চিনির পরিমাণ কমানোর কোনো বিষয় আছে, তাহলে ঠিকই ধরেছেন। (বিভিন্ন তথ্যসূত্রে MCPG বা hypoglycin A দেখা যেতে পারে।) দুটো একইভাবে কাজ করে। তাই দুটোকেই এ লেখায় সমার্থক ধরা হচ্ছে।
লিচুর বিচিতে এমসিপিজি-র পরিমাণ অনেক বেশি। কাঁচা লিচুতেও এর পরিমাণ বেশি। লিচু যত পাকতে থাকে, তার পরিমাণ তত কমতে থাকে। ঠিক দবীরউদ্দিন সাহেবের ইনসুলিনের মতোই এটাও রক্তে চিনির পরিমাণ কমিয়ে দেয়। সুতরাং কেউ যদি খালি পেটে অনেক অনেক কাঁচা-পাকা লিচু খায়, তাহলে তার হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।
লিচুর সময়ে, যখন গাছের নিচে মাটিতে অনেক লিচু পড়ে থাকে, বাচ্চারা সেগুলি কুড়িয়ে খায়। অনেক দরিদ্র ঘরের বাচ্চা সারাদিন আর কিছু খায় না, লিচু খেয়েই পেট ভরে ফেলে। সব লিচু যদি ঠিকভাবে না পেকে থাকে, তাহলে সেগুলিতে এমসিপিজি-র পরিমাণ আরও বেশি থাকে। খালি পেট, শুরুতেই রক্তে চিনি কম ছিল। এখন লিচু হজম হয়ে রক্তে নতুন করে চিনি ঢুকল ঠিকই, কিন্তু বিশাল পরিমাণ এমসিপিজিও ঢুকল। ফলাফল—রক্তের সব চিনি দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।
মস্তিষ্কের প্রদাহ বা ইনফ্লেমেশনকে বলা হয় এনসেফালাইটিস। এটার অনেক কারণ হতে পারে। তার মধ্যে আছে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, বিষ ইত্যাদি। কয়েক ধরনের মশার কামড়েও এটা ছড়াতে পারে।
মুজাফফরপুর এলাকায় ভারতের সবচেয়ে বেশি লিচু হয়। আর প্রতি বছর লিচুর সময়ে সেখানে প্রচুর বাচ্চা মারা যায়। অন্তত ১৯৯৫ থেকে এ ধরনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৪ সালে কিছু বিজ্ঞানী সেটার কারণ খোঁজা শুরু করেন
২০১২ সালের ১৬ জুন দিনাজপুরের একজন ডাক্তার আইইডিসিআরকে (IEDCR, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট—কোভিডের কারণে যার নাম আমরা এখন সবাই জানি) জানালেন, তার এলাকায় প্রচুর বাচ্চার এনসেফালাইটিস হচ্ছে। আইইসিডিআর ও আইসিডিডিআর’বি—এটাকে আমরা কলেরা হাসপাতাল বলে বেশি চিনি—ডাক্তার, মহামারী বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে তৈরি একটা টিম পাঠায় সেই এলাকায়। তারা ২০১২ সালের ১৭ জুন থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উপাত্ত সংগ্রহ করেন। এ সময়ে ১ থেকে ১২ বছর বয়সী যত বাচ্চা দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অজ্ঞান হয়ে বা খিঁচুনি নিয়ে ৩১ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ভর্তি হয়েছিল, তাদের রেকর্ড নিরীক্ষা করেন। আর সমাজবিজ্ঞানীরা তাদের বাসায় গিয়ে উপাত্ত নেন।
অসুখের শুরু থেকে অজ্ঞান হওয়ার গড় সময় দেখা গেল আড়াই ঘন্টা। যাদের মৃত্যু হয়েছে, সেটাও খুব তাড়াতাড়ি হয়েছে। তাই বিজ্ঞানীরা ইনফেকশন (ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি) হওয়ার আশঙ্কা খুব কম ধরে নিলেন। ধারণা করলেন, কোনো বিষের কারণে এটা হচ্ছে। তারা এই বাচ্চারা কোথায় গিয়েছে, সেখানে কী সার ও কীটনাশক দেওয়া হয়েছে, তারা কী খেয়েছে, সেগুলোর খোঁজ নিলেন।
দেখা গেল, এ সময়টা লিচু ধরার সময়। আর বাচ্চাদের অনেকেই লিচু বাগানে গিয়েছিল। সুতরাং তাঁরা এবার লিচুর দিকে নজর দিলেন। ভারতের কিছু ঘটনা থেকে তাঁরা লিচু ও হাইপোগ্লাইসিনের সম্পর্ক জানতেন। বাংলাদেশের লিচু বাগানে তাঁরা এন্ডোসালফান নামে বিশ্বের ৮০টা দেশে নিষিদ্ধ একটা কীটনাশকের ব্যবহার দেখলেন। সেই সঙ্গে লেবেলবিহীন আরও অনেক কীটনাশকও দেখতে পেলেন।
তাই তাঁরা কোনো নির্দিষ্ট উপসংহার বা সিদ্ধান্ত না দিলেও হাইপোগ্লাইসিন আর কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের দিকে আঙুল তুললেন। বাংলাদেশে এই রোগীদের সময় মতো রক্ত পরীক্ষা করা হয়নি। তাই তাঁরা এর বেশি কিছু নির্দিষ্টভাবে বলতে পারলেন না। তবে ভবিষ্যতে রক্ত পরীক্ষা ও সরাসরি রক্তে (ইন্ট্রাভেনাস) চিনি দিয়ে চিকিৎসার কথা তাঁরা বলেছেন।
ভারতেও এটা নিয়ে আগে গবেষণা হয়েছে। তবে সবচেয়ে গভীর গবেষণা হয়েছে ২০১৪ সালে। মুজাফফরপুর এলাকায় ভারতের সবচেয়ে বেশি লিচু হয়। আর প্রতি বছর লিচুর সময়ে সেখানে প্রচুর বাচ্চা মারা যায়। অন্তত ১৯৯৫ থেকে এ ধরনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৪ সালে কিছু বিজ্ঞানী সেটার কারণ খোঁজা শুরু করেন।
বিজ্ঞানীরা তাই রিপোর্টে লিখলেন, হাইপোগ্লাইসিন এ আর এমসিপিজি-র কারণে মস্তিষ্কের সমস্যা, অর্থাৎ এনসেফালোপ্যাথি হচ্ছে। সেটা যাতে না হয়, তাই তাঁদের ঠিকমত খাওয়া, লিচু খাওয়ার পরিমাণ কমানো এবং কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে রক্তে চিনির পরিমান বাড়ানোর উপদেশ দিলেন
২০১৪ সালের ২৬ মে থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত খিঁচুনি বা এনসেফালাইটিস নিয়ে মুজাফফরপুর এলাকায় ১৫ বছরের কম বয়সী ৩৯০ জন শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে ১২২ জন মারা যায়। বিজ্ঞানীরা ভর্তির সময়ের রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টে তাদের মধ্যে ২০৪ জনের রক্তে চিনির পরিমাণ কম দেখতে পান। তারপর তারা আগের দিন কী খেয়েছে, সে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, অনেকেই আগের দিন রাতে লিচু ছাড়া আর কিছু খায়নি।
বিজ্ঞানীরা তাই রিপোর্টে লিখলেন, হাইপোগ্লাইসিন এ আর এমসিপিজি-র কারণে মস্তিষ্কের সমস্যা, অর্থাৎ এনসেফালোপ্যাথি হচ্ছে। সেটা যাতে না হয়, তাই তাঁদের ঠিকমত খাওয়া, লিচু খাওয়ার পরিমাণ কমানো এবং কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে রক্তে চিনির পরিমান বাড়ানোর উপদেশ দিলেন।
সুতরাং বাসার বাচ্চাদের পাকা লিচু পরিমিত পরিমাণে দিতে পারেন। তবে কেবল নিয়মিত খাওয়ার পরে। শুধু লিচু দিয়ে পেট ভরানো উচিত নয়।
এখন আরেকটা প্রশ্ন আসতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের কি ইনসুলিনের বদলে লিচু দিয়ে চিকিৎসা করা যেতে পারে? উত্তর হলো, খুব জোরালোভাবে ‘না’। প্রতিটি লিচুতে কী পরিমাণ হাইপোগ্লাইসিন বা এমসিপিজি আছে, সেটা অজানা। পাশাপাশি দুটো লিচুতে তার পরিমাণও ভিন্ন হতে পারে। প্রতিদিন ইনসুলিন ডোজের ভুলে এখনই মানুষ মারা যাচ্ছে। দবীরউদ্দিন সাহেবের যে ঘটনা বলা হয়েছে, সেটা শুধু কল্পনা নয়, বাস্তবেও এরকম ঘটনা ঘটে। তাই লিচু খেয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা না করাই ভাল। তবে ভবিষ্যতে হয়তো লিচু বা লিচুর বিচি থেকে ডায়াবেটিসের ওষুধ তৈরি হতে পারে।
লেখক: খন্ডকালীন শিক্ষক, ব্র্যান্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র
সূত্র: ১. https://wa.kaiserpermanente.org/healthAndW.../index.jhtml...
২. https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/15554413/
৩. https://www.ajtmh.org/.../jour.../tpmd/97/3/article-p949.xml
৪. https://www.thelancet.com/.../PIIS2214-109X.../fulltext...
৫. https://www.thelancet.com/.../PIIS2214-109X(17.../fulltext