হকিং কেন বাজিতে হেরেছিলেন

১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন স্টিফেন হকিং। আজ তাঁর জন্মদিন। আজকের এই দিনে জেনে নেই, স্টিফেন হকিং কেন তাঁর বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরে হেরেছিলেন। কী নিয়ে বাজি ধরেছিলেন দুই বন্ধু?

নতুন কোনো বৈজ্ঞানিক ধারণার সূচনা ঘটে প্রশ্ন ও কৌতূহলের মাধ্যমে। প্রকৃতি কীভাবে কাজ করে? কেন একটি ঘটনা এমনভাবে ঘটল? এমন না হয়ে অমন হলে কেমন হতো? অনেক সময় প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে লেগে যায় যুগ যুগ সময়। তখন সম্ভাব্য অবস্থা সম্পর্কে অনেক সময় বাজি ধরেন বিজ্ঞানীরা। তুলে ধরেন নিজের মতের পক্ষে যুক্তি। স্টিফেন হকিং এ ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। অন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে অন্তত তিনটি বাজি ধরেছেন, যেগুলো বিখ্যাত হয়েছে, আলোচিত হয়েছে বিজ্ঞান জগতে। মজার ব্যাপার হলো, সব বাজিতেই তিনি হেরে গেছেন। অন্যদিকে রসিক বিজ্ঞানী হকিংয়ের সব বাজির সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল মজার কিছু ঘটনাও।

তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বাজিটি কৃষ্ণগহবর নিয়ে। এ বাজিতে গত বছরের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী কিপ থর্নও ছিলেন হকিংয়ের পক্ষে। প্রতিপক্ষ আরেক তাত্ত্বিক পদার্থবিদ জন প্রেস্কিল। বাজির বিষয় ব্ল্যাকহোল ইনফরশেন প্যারাডক্স। বর্তমান পদার্থবিদ্যার প্রধান দুই স্তম্ভ সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মেকানিকসের বিরোধেরও বড় একটি ক্ষেত্র এই প্যারাডক্স। সাধারণ আপেক্ষিকতার হিসাব থেকে দেখা যায়, কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে ঢুকে পড়ে উধাও হয়ে যেতে পারে কোনো তথ্য। যেমন একটি বস্তুকে গিলে ফেলল কৃষ্ণগহ্বর। সেই বস্তু সম্পর্কে তথ্য পরে আর জানা সম্ভব হয় না।

কোয়ান্টাম মেকানিকস কাজ করে তরঙ্গ ফাংশন নিয়ে। এটি বলছে, কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি ভৌত ব্যবস্থার তরঙ্গ ফাংশনের মান জানলে অন্য যেকোনো সময়েও এর মান (অবস্থা) জানা যাবে। অর্থাত্, তথ্য কখনোই বিলুপ্ত হতে পারে না। কোয়ান্টাম মেকানিকসের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা (নিলস বোরের দেওয়া ও সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যাখ্যা) অনুসারে, কোনো ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্যই লেখা থাকে এর তরঙ্গ ফাংশনের মধ্যে।

স্টিফেন হকিং

১৯৭৪ সালে হকিং দেখালেন, কোয়ান্টাম মেকানিকসের বদৌলতে কৃষ্ণগহ্বর ধীরে ধীরে ভরশক্তি হারাতে পারে। এ প্রক্রিয়ার নাম হকিং বিকিরণ। কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে বিখ্যাত আরেকটি উপপাদ্য হলো নো-হেয়ার থিওরেম বা লোমহীন উপপাদ্য। এটি বলছে, তিনটি জিনিস দিয়ে কৃষ্ণগহ্বরের সব বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়। ভর, বৈদ্যুতিক চার্জ ও কৌণিক ভরবেগ। কৃষ্ণগহ্বর শুরুতে কী দিয়ে গঠিত হয়েছিল বা এতে পরে কোন জাতীয় পদার্থ এসে যুক্ত হয়েছে, সেসব তথ্য সংরক্ষণ করে না সে। যেমন ধরুন দুটি কৃষ্ণগহ্বর পরস্পর মিলিত হয়ে এক হয়ে গেল। তবে একটি ছিল সাধারণ বস্তু দিয়ে গড়া। আরেকটি গড়া অ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থ দিয়ে। কিন্তু বাইরের দুনিয়ায় বসে (কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের বাইরে থেকে) সেটা আমরা জানতে পারব না। সেই তথ্য লুক্কায়িতই থাকবে। ২০১৬ সালে লাইগোর কিছু পরীক্ষায়ও উপপাদ্যটির পক্ষে সমর্থন মেলে।

কৃষ্ণগহ্বরের তাপগতিবিদ্যা ও লোমহীন উপপাদ্যের প্রতি আস্থা রেখে হকিং দৃঢ়ভাবে মনে করতেন, কোয়ান্টাম তথ্য বিলুপ্ত হতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ পদার্থবিদ এই বিশ্বাসে সমর্থন দিলেন না। তথ্য বিলুপ্তির ঘটনা সঠিক হলে যে নতুন করে লিখতে হয় কোয়ান্টাম মেকানিকসের মতো প্রতিষ্ঠিত ও সফল তত্ত্বের নিয়মগুলো!

এ থেকেই ১৯৯৭ সালে জন প্রেস্কিল বাজি ধরলেন হকিং ও থর্নের সঙ্গে। প্রেস্কিল বলেন, যেহেতু কৃষ্ণগহ্বর থেকে আসা (হকিং বিকিরণের মাধ্যমে) তথ্য এর আগে প্রবেশ করা তথ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই সাধারণ আপেক্ষিকতাকেই সংশোধন করতে হবে। ঠিক হলো বিজয়ী পক্ষকে তাঁর ইচ্ছামতো একটি বিশ্বকোষ দিতে হবে, সেখান থেকে নিজের ইচ্ছামতো তথ্য আহরণ করা যাবে।

২০০৪ সালে হকিং হাল ছেড়ে দিলেন। স্বীকার করে নিলেন পরাজয়। প্রেস্কিল নেন একটি বেসবল বিশ্বকোষ: টোটাল বেসবল, দ্য আলটিমেট বেসবল এনসাইক্লোপেডিয়া। কৃষ্ণগহ্বর থেকে তথ্য পাওয়া যাবে ঠিকই। কিন্তু এলোমেলো সেই তথ্যকে ছাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে হকিং রসিকতা করে বলেন, ‘আমি ওকে একটি বেসবল বিশ্বকোষ দিয়েছি, কিন্তু সম্ভবত শুধু ছাইগুলো দিলেই পারতাম!’ কিপ থর্ন অবশ্য হার স্বীকার করেননি এখনো। তবে হকিং হার স্বীকার করলেও ইনফরশেন প্যারাডক্সের সত্যিকার সমাধান আজও হয়নি।

কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে তাঁর এত কাজ। কিন্তু সবই তো বৃথা যাবে, যদি কৃষ্ণগহ্বর নামে কোনো কিছুর অস্তিত্বই না থাকে। বাস্তবে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব আছে কি না, সেটা তখনো বিতর্কের বিষয়। ১৯৬৪ সালে আবিষ্কৃত হয় প্রথম সম্ভাব্য কৃষ্ণগহ্বর সিগনাস এক্স-১।

১৯৭৫ সালের কথা। ৭০-এর দশকে তখন হকিংয়ের কৃষ্ণগহ্বর গবেষণা তুঙ্গে। দশক শুরুর কিছু আগেই বিখ্যাত পদার্থবিদ রজার পেনরোজের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশ করেছেন সিঙ্গুলারিটি বা পরমবিন্দু উপপাদ্য। মহাকর্ষ কখন কৃষ্ণগহ্বর বা এ রকম কোনো সিঙ্গুলারিটির জন্ম দিতে পারে, সে সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে এ উপপাদ্যে। ১৯৭০ সালে তাঁরা যৌথভাবে দেখান, মহাবিশ্ব মেনে চলছে সাধারণ আপেক্ষিকতার নিয়ম। একই বছর হকিং কৃষ্ণগহ্বরের তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র প্রণয়ন করেন। এটা থেকে সে সময় জানা গিয়েছিল, কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের (যে সীমানা থেকে কোনো কিছু বের হতে পারে না) চেয়ে কখনো ছোট হতে পারে না।

তার কিছুদিন পর তিনি জেমস বার্ডিন ও ব্র্যান্ডন কার্টারের সঙ্গে মিলিতভাবে কৃষ্ণগহ্বর গতিবিদ্যার চার সূত্র উপস্থাপন করেন। ৭০-এর দশকের শুরুতে হকিং, কার্টার, ইসরায়েল ও রবিনসনদের কাজের মাধ্যমেই লোমহীন উপপাদ্য জোরালো ভিত্তি পায়। ’৭৪ সালেই তো প্রকাশ করলেন কৃষ্ণগহ্বরের হকিং বিকিরণ। এটা প্রথমে বিজ্ঞানী মহলে একটু বিতর্কিত হলেও পরে একে একটি তাত্পর্যপূর্ণ অবদান হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। মূলত এর সূত্র ধরেই ১৯৭৪ সালে তিনি অন্যতম কম বয়সী বিজ্ঞানী হিসেবে রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন।

কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে তাঁর এত কাজ। কিন্তু সবই তো বৃথা যাবে, যদি কৃষ্ণগহ্বর নামে কোনো কিছুর অস্তিত্বই না থাকে। বাস্তবে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব আছে কি না, সেটা তখনো বিতর্কের বিষয়। ১৯৬৪ সালে আবিষ্কৃত হয় প্রথম সম্ভাব্য কৃষ্ণগহ্বর সিগনাস এক্স-১। আবিষ্কৃত হলেও স্বীকৃতি তখনই পায়নি বস্তুটি। আসলেই সেটি কৃষ্ণগহ্বর কি না, সেটা নিয়ে ১৯৭৫ সালে বাজি ধরলেন হকিং ও কিপ থর্ন। হকিংয়ের মতে, সেটি কৃষ্ণগহ্বর নয়। কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে এত সাধনার পরও তাঁর উল্টো পক্ষে অবস্থান নেওয়ার পেছনের কারণটাও দারুণ মজার। বাজিতে যদি তিনি হেরে যান, তাহলেই তাঁর বড় লাভ। কারণ, কৃষ্ণগহ্বর বাস্তবে থাকা মানে তাঁর এত দিনের কাজ সার্থক। আর যদি কৃষ্ণগহ্বর না-ও থাকে, তবু অন্তত সান্ত্বনা পুরস্কার তো থাকল। বাজিতে যে জিতেছেন তিনি!

আজও সিগনাস-এক্স-১ জ্যোতির্বিদদের গবেষণার অন্যতম প্রধান বস্তু। ভর সূর্যের ১৪ দশমিক ৮ গুণ। সূর্য থেকে ৬ হাজার ৭০ আলোকবর্ষ দূরে আছে আমাদের গ্যালাক্সিরই এই কৃষ্ণগহ্বর। ১৯৯০ সালে এর কৃষ্ণগহ্বর পবার পক্ষে দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই বছরই হকিং হার মেনে নেন। বাজির শর্ত অনুসারে থর্নকে চার বছরের জন্য পেন্টহাউস ম্যাগাজিনের গ্রাহক বানিয়ে দেন হকিং।

হিগস কণা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই বাজিতে হারার হ্যাটট্রিক হয়ে যায় হকিংয়ের। হকিং বলেছিলেন, কখনোই হিগস কণার দেখা পাওয়া যাবে না। বাজির ১০০ ডলার কেইনকে দিয়ে দেন হকিং।

আরেকটি বাজির প্রতিপক্ষ গর্ডন কেইন। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। বাজির বিষয় ঈশ্বর কণা নামে পরিচিত হিগস বোসন কণা। কণা পদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে ১৯৬০-এর দশকে এমন একটি কণা থাকতে পারে বলে অনুমান করা হয়। মৌলিক কণাদের ভরের উত্স সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয় কণাটি। ১৯৬৪ সালে পিটার হিগস কণাটির কার্যক্রম সম্পর্কে তত্ত্ব প্রদান করেন। এটি ছিল স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সর্বশেষ অপ্রমাণিত বক্তব্য। পদার্থবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় সমস্যায় পরিণত হয় বিষয়টি। অবশেষে ২০১২ সালের ৪ জুলাই এর দেখা মেলে। ইউরোপীয় নিউক্লিয়ার গবেষণা সংস্থা সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে শনাক্ত হয় একটি কণা, যা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অনুমিত হিগস কণার সঙ্গে মিলে যায়। এরই সূত্র ধরে পিটার হিগস পরের বছর ফ্রাঁসোয়া অ্যাংলার্টের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারও পান।

হিগস কণা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই বাজিতে হারার হ্যাটট্রিক হয়ে যায় হকিংয়ের। হকিং বলেছিলেন, কখনোই হিগস কণার দেখা পাওয়া যাবে না। বাজির ১০০ ডলার কেইনকে দিয়ে দেন হকিং।

তবে হকিংয়ের মতে, তিনি একটি বাজিতে জিতেছেন। বাজির প্রতিপক্ষ নিল টারোকের মতে, মহাবিশ্বের একটির পর একটি বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ হয়ে চলেছে। ২০১৪ সালে হাভার্ড স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিকসের একটি দল মহাকর্ষ তরঙ্গ আবিষ্কারের একটি ঘোষণা দেয়। এর পরপরই হকিং বলেন, তিনি বাজিতে জয়লাভ করেছেন। ’১৪ সালের আবিষ্কার অবশ্য অকাট্য ছিল না। পরের বছর সে কাজটি করে লাইগো। হকিংয়ের মতে, মহাকর্ষ তরঙ্গের আবিষ্কারের মাধ্যমে তাঁর মতের জয় হয়েছে। তবে টারোক সেটা মেনে নেননি।

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যানবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: ফিজিকস ওয়ার্ল্ড ডট