ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী করা কি সম্ভব?

নানা ধরনের ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, টর্নেডো বা সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভবিষ্যদ্বাণী আমরা অনেকটা-ই করতে পারি। তাহলে, বড় বড় ভূমিকম্পগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী কেন করা যায় না?

আজ (৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার) সকালের পত্রিকা যাঁরা পড়েছেন বা খবর দেখেছেন, তাঁরা জানেন ভয়ংকর এক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে তুরস্ক ও সিরিয়ার মানুষ। তুরস্কের সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে এ ভূমিকম্প হয়েছে। অনেকেই তখন ছিলেন গভীর ঘুমে। এই ভূমিকম্প যে হবে, তা আগে থেকে অনুমান করতে পারেননি কেউই। এ ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ধসে পড়েছে হাজারো ঘরবাড়ি, মারা গেছেন অনেক মানুষ। সংখ্যাটি বর্তমানে পেরিয়ে গেছে ৪ হাজারের ঘর। আরও হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু এটি শুধুই সংখ্যা নয়, এরা প্রত্যেকে একেকজন মানুষ। এতগুলো মানুষের অকালমৃত্যু মর্মান্তিক।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের বড়-সড় ভয়ংকর ভূকম্পন আগেও হয়েছে। সেগুলোও আগে থেকে অনুমান করা যায়নি। ২০০৯ সালে ইতালিতে সরকারি দুই বিজ্ঞানীর নামে খুনের মামলাও হয়েছে ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী করতে ব্যর্থ হওয়ায়। সে ঘটনায় ইতালিতে প্রায় ৩০০ মানুষ মারা গিয়েছিলেন। এ ধরনের ভূমিকম্প বারবার হয়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে মানুষের ঘরবাড়ি, অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে, হয়েছে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভেতে কাজ করেন ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের ওয়েবসাইটে লেখা, ‘ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে বা আর কোনো প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা কখনো এ ধরনের ভয়ংকর ভূমিকম্পের সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেননি। আমরা জানি না কীভাবে এই ভবিষ্যদ্বাণী করতে হয়। নিকট ভবিষ্যতে জানা যাবে, এমনটা মনেও হয় না।’

বিজ্ঞানীরা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, টর্নেডো বা সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভবিষ্যদ্বাণী অনেকটা-ই করতে পারেন। অনেকটা-ই মানে, সম্পূর্ণ নিখুঁত না হলেও কাছাকাছি। তাহলে, বড় বড় ভূমিকম্পগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী কেন করা যায় না? সে বিষয়টা একটু জেনে নেওয়া যাক। তার আগে চলুন, সংক্ষেপে, সহজভাবে জেনে নিই, ভূমিকম্প আসলে কী ও কেন হয়।

তুরস্কে ভূমিকম্পের কারণে শহরগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে

দুই

ভূমিকম্প নিয়ে বর্তমান যে তত্ত্ব, তা প্লেট টেকটোনিকস বা মহাদেশীয় পাতের কথা বলে। এ তত্ত্ব মতে, পৃথিবীর বাইরের দিকটা পাথরের পাত দিয়ে তৈরি। (পাঠকরা যেন গুলিয়ে না ফেলেন, তাই বলে রাখি, আমরা থাকি পৃথিবীর ওপরে; ভেতরে না।) এরকম বড় পাত আছে নয়টি। এ ছাড়াও ছোট ছোট কিছু পাত আছে। এই পাতগুলো নিয়মিতহারে নড়াচড়া করে। এ পাতগুলোর নিচের পাথরের স্তরটি তুলনামূলক ঘাতসহ (Malleable)। অর্থাৎ, ওই স্তরটির ওপর দিয়ে এই পাতগুলো অনায়াসে নড়াচড়া করতে পারে। ঘাতসহ এই স্তরটির নিচের স্তরকে বলে ম্যান্টল—পৃথিবীর গলিত কেন্দ্রের দিকের একটি স্তর এটি। মূল বিষয়টা হলো, মহাদেশীয় এ পাতগুলোর সীমানাকে বলে ফল্ট লাইন। এই সীমানা অংশগুলো মোটেও সমান বা মসৃণ নয়, আঁকাবাঁকা। মূলত ভূমিকম্পগুলো এখানেই বেশি ঘটে।

প্লেট টেকটোনিকস বা মহাদেশীয় পাতগুলো নড়াচড়ার সময় একটি আরেকটির সঙ্গে বাড়ি খায়। বাড়ি খাওয়ার সময় একটি পাতের আঁকাবাঁকা সীমানায় অন্য পাতের কোনো অংশ আটকে যেতে পারে। কিন্তু পাতটির যে অংশটা আটকে নেই, সেটা তো নড়াচড়া করে ভিন্ন কোনো দিকে যেতে চাচ্ছে। জড়তা ও গতিশীলতার চিরায়ত এই দ্বন্ধ। এ দ্বন্ধে জিতে যায় গতি। পাতটির গতিশীল অংশ যথেষ্ট শক্তিতে আটকে থাকা অংশটাকে টান দেয়। ফলে ওই অংশটা মুক্ত হয় বটে, কিন্তু এ সময় প্রচণ্ড শক্তির তীব্র স্রোত ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর অভ্যন্তরে। এই শক্তি নাড়িয়ে দেয় সব, ভূপৃষ্ঠও নড়ে ওঠে এর ফলে প্রচণ্ডভাবে। হ্যাঁ, এটাই ভূমিকম্প।

অতিসরলীকরণ করে বললেও বিষয়টা মোটামুটি এমনই। ছবিটা বোধ হয় কল্পনা করতে পারছেন। অবশ্যম্ভাবী একটা প্রশ্ন চলে আসে। বিজ্ঞানীরা যদি জানেন-ই ভূমিকম্প কীভাবে হয়, তাহলে কখন হবে, তা আন্দাজ করতে পারেন না কেন? এবারে সে কথাই বলব।

ভূমিকম্পের উৎপত্তি পৃথিবীর অনেকটা গভীরে। সেখান থেকে প্রচণ্ড শক্তি এসে পৌঁছে পৃষ্ঠতলে। হতে পারে, ভূমিকম্পের উৎপত্তির আগে কিছু নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটে। কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে আমরা সেগুলো শনাক্ত করতে পারি না।

তিন

ভূমিকম্প সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য জানা প্রয়োজন ৪টি জিনিস। এক, ভূমিকম্পের তারিখ। দুই, সময়। তিন, স্থান। আর চার, ভূমিকম্পের অনুমিত মাত্রা। কথা হলো, এই চারটা জিনিস বিজ্ঞানীরা বুঝবেন কীভাবে? একটা উদাহরণ দিই।

বৃষ্টি হবে, এটা বোঝার উপায় কী? আকাশে মেঘ জমতে হবে প্রথমে। সেক্ষেত্রে বৃষ্টির সম্ভাবনা বোঝা যায়। মেঘের নিচের স্তর থেকে মূলত বৃষ্টি হয়। এই স্তরটা ভারী হয়ে উঠছে কি না, ওপরের দিকের উষ্ণ ও হালকা বায়ু আর নিচের দিকের শীতল ও ভারী বায়ুর বিনিময় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় খেয়াল করেন আবহাওয়াবিজ্ঞানীরা। এ থেকে তাঁরা অনুমান করেন, বৃষ্টি কোথায়, কখন, কতটা হবে।

তারমানে, ভূমিকম্পের সঙ্গেও এরকম কিছু বিষয়ের সংযোগ বের করতে হবে ভূতত্ত্ববিদদের। দেখতে হবে, একটা ভূমিকম্পের আগে আগে ঠিক কোন ঘটনাগুলো ঘটে। আর লাগবে মহাদেশীয় পাতগুলোর সঞ্চারণ বা নড়াচড়া অনুমানের মতো সূক্ষ্ম গাণিতিক মডেল। এই মডেল ব্যবহার করে অনুমান করতে হবে, পাতগুলো কখন, কতটা নড়বে ও কোনদিকে যাবে; এ সময় কী কী হতে পারে এসব।

বিজ্ঞানীরা সেই চেষ্টা করেছেন। সফল হননি। তাঁরা বেশ কিছু প্রাকৃতিক ঘটনার সঙ্গে ভূমিকম্পের সংযোগ বের করার চেষ্টা করেছেন। যেমন ভূমিকম্পের আগে আগে অনেক সময় আশপাশের জলাধারগুলোতে রেডনের পরিমাণ বেড়ে যায়। পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। পরিবর্তন দেখা যায় তড়িৎচৌম্বকীয় ক্রিয়ায়। বিভিন্ন প্রাণীর আচরণে নানারকম অসঙ্গতিও চোখে পড়ে। কিন্তু অনেকভাবে চেষ্টা করেও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পারেননি, এরকম কিছু হলেই ভূমিকম্প হবে। আবার অনেক সময় ভূমিকম্প হলেও এসব ঘটতে দেখা যায় না। অর্থাৎ, ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ তাঁদের হাতে নেই।

ভূমিকম্পের উৎপত্তি পৃথিবীর অনেকটা গভীরে। সেখান থেকে প্রচণ্ড শক্তি এসে পৌঁছে পৃষ্ঠতলে। হতে পারে, ভূমিকম্পের উৎপত্তির আগে কিছু নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটে। কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে আমরা সেগুলো শনাক্ত করতে পারি না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, কী যে শনাক্ত করতে হবে বা কোন চিহ্নটা খোঁজা প্রয়োজন, তা-ই জানেন না বিজ্ঞানীরা। তাঁদের হাতে এ বিষয়ক কোনো সূত্রও নেই।

তুরস্কে ভূমিকম্পে দালানকোঠা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে

বিজ্ঞানীরা তাই আপাতত কাছাকাছি একটি কাজ করেন। তাঁরা কিছু নির্দিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফল্ট লাইনের গাণিতিক মডেল তৈরি করে, সেগুলোর আচরণ থেকে বোঝার চেষ্টা করেন, ভূমিকম্প হতে পারে কি না। তবে এই কাজটিও অনেক জটিল। প্রচণ্ড চাপ ও তাপমাত্রায় পাথর কীভাবে কাজ করে, শুধু সেটা বের করলেই হয় না। পৃথিবীর যত গভীরে যাব, তাপমাত্রা ও চাপ তত বাড়বে। এই প্রচণ্ড তাপমাত্রা, চাপ, এদের পরিবর্তনশীলতা ও পাথর এবং খনিজদের এ পরিস্থিতিতে আচরণ—সব আবার গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে বানিয়ে দেখা বা খুঁটিনাটি সব উপাত্ত ব্যবহার করে মডেল বানিয়ে সিমুলেশন তৈরি করা খুব সহজ কাজ নয়। এ জন্য বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের সান আন্দ্রেয়াজ ফল্ট অঞ্চলে গর্ত খুঁড়ে, উপাত্ত সংগ্রহ করেও দেখেছেন। কিন্তু এগুলোর জন্য অনেক শ্রম যেমন দিতে হয়, তেমনি কাজগুলোও অনেক ব্যয়বহুল। আর সবশেষে যুতসই ফলাফলও পাওয়া যায় না। সবমিলে, বিষয়টা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরেকটি বিষয় হলো, বিজ্ঞানীদের সাধারণ ধারণা, মৃদু ভূমিকম্প ও প্রচণ্ড ভূমিকম্পগুলো একইভাবে শুরু হয়। ভাবনাটি যৌক্তিক। ফলে, সমস্যা হলো, কোনো প্রাথমিক চিহ্ন খুঁজে পেলেও সেটা বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত করছে, নাকি মৃদু ভূমিকম্প—সেটা অনুমান করা মুশকিল।

নিকট ভবিষ্যতে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। ভূমিকম্প তাই এখনো হেঁয়ালি। সেজন্য ভূমিকম্প থেকে বাঁচার যে সাধারণ সতর্কতা আছে, সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখাই আমাদের আপাত অবলম্বন।

ভূমিকম্প হলে ভারী দেয়াল বা পিলার ঘেঁষে আশ্রয় নিতে হবে। আশপাশে টেবিল বা খাট থাকলে, নিচে জায়গা থাকলে ঢুকে পড়তে হবে। মাথা আশপাশে বালিশ থাকলে বালিশ দিয়ে, নাহয় হাত দিয়ে ঢেকে নিতে হবে। ছোটাছুটি করে সিঁড়ি দিয়ে নামা অর্থহীন, কারণ, ভূমিকম্প দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অল্প সময়ের মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অনেকেই আহত হন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ভূমিকম্পের সময় লিফটে ওঠা যাবে না।

ভূমিকম্পের সময় সুস্থিরভাবে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এসব সাধারণ সতর্কতা মেনে চলা জরুরি। মাথা গরম করা যাবে না। সুস্থির চিন্তা ও সাধারণ সতর্কতা জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে, এটা মনে রাখতে হবে।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান, প্রথম আলো, সিএনএন