পাখির নাম বাদামি কসাই

বাড়ির পাশের ছোট মাঠটিতে রোজই দেখা যায় পাখিটিকে। ঝোপঝাড়ের মাথায়, জিকলগাছের ডালে ও মাঠের মধ্যে পোঁতা কাঠির মাথায় চুপচাপ বসে থাকে পাখিটি। মাঝেমধ্যে বড্ড চেঁচামেচি করে। বিশ্রী কণ্ঠ। ছেলেটি রোজই তার ছাগলের পাল নিয়ে চরাতে যায় ওই মাঠে। পাখিটির প্রতি তার কৌতূহল বাড়ে। কাছে গেলে উড়ে গিয়ে অন্য কোথাও বসে। নজর থাকে ওটার মাটির দিকে। উঁচু জায়গায় বসে ওটা সার্চলাইটের মতো চোখ ঘোরায় চারদিকে, পোকামাকড় দেখলেই সরলরেখায় উড়ে গিয়ে মাটিতে নামে। শিকার পাকড়াও করে একই রেখা ধরে ফিরে আসে সেখানটায়, যেখানটা থেকে সে উড়াল দিয়েছিল। পাখিটা বিন্না ঘাসবনের আশপাশে থাকে, থাকে ঘাসবন ও কাশবনের ধারেকাছে। বেশি থাকে খোলা জায়গায়।

ছেলেটির মাথায় দুষ্টুমির বুদ্ধি আসে। একদিন সে পুঁটিমাছ ধরা ছিপ-বড়শি নিয়ে মাঠে যায়। ছিপের গোড়া পোঁতে মাটিতে। ছোট্ট বড়শিতে গাঁথে একটি ঘাসফড়িং। ছিপের আগা থেকে ঝুলছে সুতো, করছে নড়াচড়া ফড়িংটা। সরে আসে ছেলেটা। একটু বাদেই পাখিটা দ্রুত সরলরেখায় উড়ে এসে মুখ দিয়ে ধরে শিকার। অ্যাবাউট টার্ন করে ফেরার পথে বড়শিতে যায় আটকে। পরমুহূর্তেই আতঙ্কিত পাখিটি মাঠ ফাটিয়ে বেজায় চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। পালাতে চায় ডানা ঝাপটে। ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে পাখিটিকে ধরে যেই না গেছে ঠোঁট থেকে বড়শিটা ছাড়াতে, সঙ্গে সঙ্গে পাখিটা ছেলেটির হাত ধরে দুই ঠোঁটের সাঁড়াশিতে চেপে। সে কী প্রচণ্ড শক্তি। ওপরের ঠোঁটটি তো নিম্নমুখী বক্র। হুকের মতো। ওই হুক ঢুকে যায় ছেলেটির আঙুলের চামড়া ফুটো করে। প্রচণ্ড ব্যথায় চোখে শর্ষে ফুল দেখে সে। হাতের মুঠি আলগা করল বটে, তবুও কামড় ছাড়ল না পাখিটা। কলকল করে রক্ত ঝরছে। বাঁ হাতে বালক টানছে পাখিটিকে। তবুও ছাড়ে না সে। ঝটকা দিয়ে হাত টান দেয় বালক। এবার পাখিটি চামড়া-মাংসসমেত তুলে নেয়। বড়শিও গিয়েছিল খুলে টানাটানিতে, চেঁচাতে চেঁচাতে উড়ে পালিয়ে যায় পাখিটি।

পাখিটি চড়ুইয়ের চেয়ে অল্পই বড়। তুলনামূলকভাবে লেজটা লম্বা। পাখিটার মাথার তালু-ঘাড়-পিঠ ও লেজের উপরিভাগটা তেলতেলে গাঢ় বাদামি। লালচে বাদামি বুক-পেট, গলা তুলোট সাদা, চোখের ওপর দিয়ে ঘাড় পর্যন্ত যেন চওড়া করে কাজলটানা। সেই কাজলের উপরিভাগ দিয়ে সাদা একটি রেখা টানা। এটাকে ভ্রু-ও বলা চলে। গাঢ় ধূসর পা ও ঠোঁট। বন-বাগানের বাইরে, ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকা ও খোলা জায়গায় থাকে এরা। রাজধানী ঢাকা শহরে ও শহরতলিতেও দেখা মেলে পাখিটির। পাখিটি যে এলাকায় থাকে বা বিচরণ করে, ওই এলাকাকে সে ‘বাবার তালুক’ মনে করে। পোকামাকড়খেকো অন্য পাখিরা তো বটেই, অন্য কোনো পাখি এলেও বিশ্রী-কর্কশ ডাক ছেড়ে ধাওয়া করে। কারণে-অকারণে প্রচণ্ড চেঁচামেচি করে, গোলমাল পাকায়, মনে হয় ডাকাত পড়েছে এলাকায়। মাঠের পাখিরা এদের ডাক ফলো করে। প্রহরী হিসেবে মানে। পাখি ছোট, কিন্তু সাহসটা বড়। খুবই চতুর, সাবধানী ও লড়াকু পাখি। স্বার্থপরও খুব।

সন্ধ্যায় এরা রাত কাটানোর জন্য যে গাছে আশ্রয় নেয়, সে গাছে যাতে অন্য কোনো পাখি আশ্রয় না নেয়, সে জন্য ওটা অন্ধকার গাঢ় না হওয়া পর্যন্ত একটানা সতর্কসংকেত, তথা সাইরেন বাজিয়ে চলে। খবরদার! এই গাছে আমি আছি। অন্য কেউ এলে খবর আছে! কণ্ঠস্বরও বটে এদের! ধাতব ‘ট্যাক্ ট্যাক্ ট্যাক্‌ ট্যাকর’, ‘চিরর্ চিরর্ চেট চেট’ করে ডাকে। তার চারণক্ষেত্র এলাকায় অন্য পোকাখেকো পাখি এলে চেঁচাতে চেঁচাতে তাড়া করে।

পাখিটির নাম ‘বাদামি কসাই’। এরা আমাদের শীতের পরিযায়ী পাখি। শীতের অনেক আগেই বাংলাদেশে চলে আসে। সারা দেশেই দেখা যায় পাখিটিকে। মূল খাদ্য পোকামাকড়, কেঁচো, গুবরে পোকা, টিকটিকি, গিরগিটি। সুযোগ পেলে পাখিদের পিচ্চি ছানাও খায়। ঘাসফড়িং এদের অতীব প্রিয় খাদ্য। শিকার বেশি হলে এরা তা খেজুরকাঁটা, বাবলা ও বরই কাঁটায় গেঁথে রাখে। টিকটিকি-গিরগিটি গাঁথলে মনে হয়, কসাইয়ের দোকানে মাংস ঝুলছে। তাই বুঝি নাম ‘কসাই পাখি’!

বাদামি কসাইয়ের ইংরেজি নাম Brown Shrike. বৈজ্ঞানিক নাম Lanius cristatus. দৈর্ঘ্য ১৯ সেমি।