বায়ুদূষণ শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শুধু রাসায়নিক ক্ষতি করে না। এখন দেখা যাচ্ছে, এটি পরিবর্তন করে দিচ্ছে শরীরের স্বাভাবিক অণুজীবদের। হারিয়ে যাচ্ছে উপকারী অনেক ব্যাকটেরিয়া। বায়ুদূষণের কারণে শরীরে কী কী পরিবর্তন হচ্ছে? বৈশ্বিক উষ্ণতা ও বায়ুতে কার্বন বেড়ে যাওয়ায় পাকস্থলী ও ফুসফুস কী প্রতিক্রিয়া দেখায়? এর ফলে দীর্ঘময়াদি কী জটিলতা তৈরি হতে পারে? এ নিয়ে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন চট্টগ্রামের মো. হাবিবুল হাসান মজুমদার। তাঁরা দেখেছেন, নতুন ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন ফুসফুসে বেড়ে যাচ্ছে। তারপর সেখানেই অবস্থান করছে স্থায়ীভাবে। এটি ফুসফুসে অন্য বেশ কিছু সংক্রমণকে উস্কে দিচ্ছে| হাবিব ও তাঁর গবেষক দল পৃথিবীতে প্রথম দল হিসেবে একটি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফুসফুস ও পাকস্থলীতে সংক্রমণ ও প্রদাহ চিহ্নিত করেছে। এজন্য পাঁচটি শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাদের গবেষণাপত্র। কাজের অভিনবত্ব ও গুরুত্বের কারণে হাবিবুল হাসান অত্যন্ত মর্যাদা পূর্ণ দুটি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে—ভার্জিনিয়ার সেরা তরুণ গবেষক এবং সেরা ছাত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটিতে স্কুল অব ফার্মেসিতে গবেষণারত চট্টগ্রামের হাবিবুল হাসান। তাঁর বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের কাজির দেউড়িতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র তিনি। শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইনস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক এবং চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ থেকে সম্পন্ন করেন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা।
হাবিব গবেষণা করছেন শরীরের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব নিয়ে। বায়ুদূষণের অনেকগুলো উপাদান। এর মধ্যে কার্বন ব্ল্যাক ও ওজন গ্যাস অন্যতম। তাঁদের গবেষণার উদ্দেশ্য হলো এই কার্বন ব্ল্যাক এবং ওজন কীভাবে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বদলে দেয়, তা বের করা। সেই সঙ্গে শরীরে উপস্থিত অণুজীবের ওপর এদের প্রভাব পর্যবেক্ষণ।
হাবিব বলেন, ‘এই গবেষণার জন্য আমরা ইঁদুরকে মডেল হিসাবে নির্বাচন করেছি। যন্ত্রের মাধ্যমে বায়ুদূষণের উপাদানগুলো নিশ্বাসের সঙ্গে ইঁদুরের শরীরের ভেতরে প্রবেশ করাই। উপাদানগুলো কতটুকু প্রবেশ করবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা হয় যন্ত্রের মাধ্যমে। একজন মানুষ সারাদিন বাইরে কাজ করলে যতটুকু তার ফুসফুসে যাবে, এর ওপর নির্ভর করে এই পরিমাণটি নির্ধারণ করা হয়। তারপর, নির্দিষ্ট সময় পর ইঁদুরগুলোর ওপর বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। ইঁদুরের ফুসফুসে রোগ-প্রতিরোধী কোষগুলো দেখা হয়। দেখা হয় ইঁদুরের রক্তে রোগ-প্রতিরোধী কোষের পরিবর্তন। ফুসফুসের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। পর্যবেক্ষণ করা হয় ফুসফুস এবং ক্ষুদ্রান্ত্রে অণুজীবের পরিবর্তন। সবশেষে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে কীরকম পরিবর্তন হতে পারে, তাও দেখা হয়। এ গবেষণার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো, অণুজীব ব্যবহার করে বায়ুদূষণের কারণে মানবদেহে হওয়া বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ। আমরা দেখতে চাই, এটা কতটা করা সম্ভব। এ ছাড়া কীভাবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বায়ুদূষণের উপাদানগুলোর প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তার গাইডলাইনও প্রদানের চেষ্টা করব আমরা।’
এই গবেষণা বাংলাদেশেরও কাজে লাগতে পারে বলে মনে করেন হাবিব। বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। আমাদের দেশে বায়ুদূষণের প্রভাবে নানা ধরনের রোগ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কমছে মানুষের আয়ু। এ গবেষণার মাধ্যমে কীভাবে অণুজীবের সাহায্যে বায়ুদূষণের প্রভাব কমানো যায়, সেটা দেখা হবে। এসব উপকারী অণুজীব আমরা হয়তো দই বা এরকম কোনো খাবারের মধ্যে যোগ করে দিতে পারব। এই গবেষণা আরও অনেক কাজে লাগতে পারে। যেমন বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হতে পারে এ গবেষণা।
এর আগে হাবিব ‘শ্রেষ্ঠ ফার্মাসিউটিক্যাল ছাত্র ২০২৩’ নির্বাচিত হয়েছেন, মনোনীত হয়েছেন রবার্ট স্টিটজেল গবেষণা পুরস্কার ২০২২-এর জন্য।
আবুল কাসেম মজুমদার ও হেলেনা মজুমদারের সন্তান হাবিবুল হাসান। তাঁর স্বপ্ন বাংলাদেশকে ঘিরে। হাবিব বলেন, ‘বাংলাদেশ গবেষণায় আরও এগিয়ে যাবে, এ স্বপ্ন দেখি। বাংলাদেশের অনেক সম্ভবনা রয়েছে গবেষণায় এগিয়ে যাওয়ার। বাংলাদেশ তার গবেষকদের সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ তৈরি করে দেবে যেন বাইরে থেকে গবেষকরা দেশে গিয়ে কাজ করতে অনুপ্রাণিত হয়। যেন বাংলাদেশের নাম বিশ্বে উজ্জ্বল হয়।’
চট্টগ্রামকে ধারণ করেন হৃদয়ের গভীরে। চট্টগ্রামকে নিয়ে তাঁর কল্পনা অনেক। তাঁর ভাষায়, ‘আন্তর্জাতিক মানের একটি নগরী হিসাবে দেখতে চাই চট্টগ্রামকে। যেখানে গাছপালার সবুজ থাকবে, থাকবে আধুনিক নগরীর সব সুবিধা। যেখানে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণাগার হবে এবং দেশের বাইরে থেকে বড় বড় বিজ্ঞানী সেখানে কাজ করতে যাবেন। গড়ে উঠবে চমৎকার এক গবেষণা-পরিবেশ।