অজানা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন

বাহিত ভদ্রলোকের নাম বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। নামটা চেনা চেনা লাগতেই পারে। কেননা, তাঁর নামের আগে বিজ্ঞানী উপাধিটি বসানো হয়। তিনি বিজ্ঞানী। আবিষ্কারকও বটে। বিসিএস পরীক্ষায় প্রশ্নটা যদি এমন আসে, কে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, তবে উত্তরটা দিতে কষ্ট হবে। তিনি আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। তিনি লেখক, চিত্রশিল্পী, রাজনীতিবিদ, সংগীতজ্ঞ, রাষ্ট্রপ্রধান, কৌতুকবিদ, গণ-আন্দোলনকারী, কূটনীতিক। উইকিপিডিয়া ফ্রিতে তথ্য দিয়ে সাহায্য করল বলে কলার উঁচিয়ে বলতে পারলাম, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন কী ছিলেন না! সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার অসাধারণ সাধনার পথিকৃৎ তিনি।

বিসিএস পরীক্ষায় বরং প্রশ্নটা এমন হলে সুবিধা। বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছিলেন কে? উত্তরটা অবশ্যই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। ধনাত্মক আর ঋণাত্মক, অর্থাৎ পজিটিভ চার্জযুক্ত বিদ্যুৎ এবং নেগেটিভ চার্জযুক্ত বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। আকাশে চমকানো বিদ্যুৎ রেশমি কাপড়ের তৈরি ঘুড়ির রেশমি সুতোয় ধাতব চাবি বেঁধে দিয়ে টেনে আনলেন হাতের মুঠোয়। আজ তা আমাদের ঘরে ঘরে। এ-ই শেষ নয়। তিনি বজ্রনিরোধক দণ্ড, বাইফোকাল লেন্স, অডোমিটার, বিশেষ চুলা (ফ্রাঙ্কলিনের চুলা) আর বিশেষ হারমোনিকা (ফ্রাঙ্কলিনের হারমোনিকা) আবিষ্কার করেছিলেন, যা এত বছর পরও ব্যবহার করছে মানুষ। বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি সার্থক। ইতিহাস তাঁর সার্থকতা স্বীকার করে নিয়েছে।

তবে সব ফেলে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ভদ্রলোককে বিবাহিত বলার কারণটা কী? শিরোনাম দেখেও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না, বিয়েবিষয়ক ঝামেলায় পড়েছিলেন বেচারা। সত্যিই পড়েছিলেন।

এখন থেকে ৩১১ বছর আগেকার মানুষ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ১৭৩০ সালে বিয়ে করেছিলেন ডেবোরাহ রিডকে। কিন্তু প্রায় দুই দশক ধরে ডেবোরাহ ম্যাডাম আর মিস্টার বেঞ্জামিন পরস্পরের মুখ দেখেননি। কোথায় ঝামেলা ছিল দুজনের, তা নিয়ে অন্তত ২০০ বছর ধরে মানুষের মাথা থেকে কত যে ঘাম ঝরেছে! নতুন একটি তত্ত্ব হাজির হয়েছে, যাতে বলা হচ্ছে এই দম্পতির ছেলের স্বাস্থ্য ছিল তাদের সুখী দাম্পত্য জীবনের অন্তরায়। স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনের সেপ্টেম্বর ২০১৭ সংখ্যায় ইতিহাসবিদ স্টিফেন কস এই তত্ত্ব দিয়েছেন। তিনি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন আর ডেবোরাহ রিডের হাঁড়ি-নাড়ির খোঁজ নিয়ে বলেছেন, লোকে যা ভাবত, তা সত্য নয়। লোকে ভাবত, স্ত্রীর কাছ থেকে লম্বা সময় ধরে দূরে থাকতেন কাজপাগল বেঞ্জামিন। এই জন্যই মন-কষাকষি চলত দুজনের মধ্যে। তবে ফ্রাঙ্কলিনের আত্মজীবনী, কিছু চিঠি আর পেনসিলভানিয়া গেজেট পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় পড়ে স্টিফেন কস বলছেন, এই দম্পতির ছেলেটার স্মলপক্স বা বসন্ত রোগ হয়েছিল বলেই লেগেছিল ঝামেলা।

ব্যাপারটা আরও খোলাসা হওয়া দরকার। করছিও তা-ই।

ফ্রাঙ্কলিন বসন্ত রোগের টিকা সম্বন্ধে প্রথম জেনেছিলেন ১৭২১ সালে। বোস্টনে তখন এই রোগ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের দিনের টিকার মতো ছিল না তখনকার সেই টিকা। দেওয়ার কায়দাও ছিল আলাদা। চিকিত্সক প্রথমে বসন্ত রোগে আক্রান্ত শরীরে ওঠা ফুসকুড়ি থেকে তরল টেনে নিয়ে সুস্থ মানুষের বাহুতে সামান্য মাংস কেটে তাতে ঢুকিয়ে দিতেন। বসন্ত আক্রান্ত বোস্টনে তখন পেনসিলভানিয়া গেজেট রিপোর্ট করেছিল যে কয়েক শ মানুষ স্মলপক্স ভাইরাস ঠেকাতে টিকা নিয়েছিল, তাদের ভেতর থেকে চারজন মারা গেছে।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন জানতেন বসন্ত রোগের টিকার কথা। তবে মারা যাওয়ার খবর দেখে ভয় পেয়েছিলেন বলেই হয়তো ওই রোগে আক্রান্ত ফ্রাঙ্কিকে টিকা দেননি। ফ্রাঙ্কি আর সারাহ নামে দুটি সন্তান ছিল তাঁদের। ১৭৩১ সালে মারা যায় ফ্রাঙ্কি। ফ্রাঙ্কলিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন তাঁর কষ্টের কথা। সারা জীবন তিনি অপরাধবোধে ভুগেছেন, কেন ফ্রাঙ্কিকে টিকা দেননি ভেবে।

স্টিফেন কস ফ্রাঙ্কলিন নাকি টিকা দেবেন কি দেবেন না, এ নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলেন। আর ডেবোরাহ টিকা দেওয়ার বিপক্ষেই মত দেন। ফলে ছেলেটাকে টিকা দেওয়ার ব্যাপারে জোরালো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তিনি। কেন নিজেই দায়িত্ব নিয়ে ফ্রাঙ্কিকে টিকা দেওয়ালেন না, এই আক্ষেপ নিয়েই ১৭৫৯ সালে লিখেছিলেন, ‘যদি অভিভাবকদের কেউ একজন বা নিকটাত্মীয়দের কেউ বিরোধিতা করে [টিকা দেওয়ার ব্যাপারে], তবে অন্যজন সবার স্বাধীন মত ছাড়া শিশুকে টিকা দেবে কি না, তা বেছে নিতে পারে না, ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও পারা যায় না, অবিরাম দোষারোপই কেবল চলতে থাকে।’

ডেবোরাহ আর ফ্রাঙ্কলিনের বিরহকাল আমৃত্যু কাটেনি। একসময় ফ্রাঙ্কলিন ডেবোরাহকে চাইলেও ডেবোরাহ ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে থাকতে চাননি। অনেক বছর পর অসুস্থ হয়ে পড়লে ডেবোরাহ বারবার চিঠি লিখে স্বামীকে কাছে চেয়েছেন। তখন ফ্রাঙ্কলিন আসেননি। তারপর আবার ফ্রাঙ্কলিন ডেবোরাহকে চিঠি লিখতে শুরু করেন, কিন্তু সে চিঠির জবাব পান না, তিনি নিজেও সশরীরে হাজির হয়ে জানতে চাননি, ‘কেন চিঠির জবাব দিলে না, প্রিয়া?’

১৭৭৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর সব দীর্ঘশ্বাস বুকে রেখে চিরতরে হারিয়ে গেলেন ডেবোরাহ রিড। এর ১৬ বছর পর মৃত্যুবরণ করলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। স্ত্রীর কবরের পাশেই কবর হলো তাঁর।

আহা! অনন্তে দেখা হয়েছিল কি দুজনের? কথা হয়েছিল কি? কে জানে!

লেখক: সম্পাদক, মাসিক নবারুণ