অমৃতের সন্ধানে

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি শিশুতোষ গল্পে আছে—এক গ্রামে এক কবিরাজ এমন এক ধন্বন্তরি আবিষ্কার করেন, যা খেলে মানুষ আর মরে না। ওই গ্রামে সবাই কবিরাজের ওষুধ খেয়ে শত শত বছর ধরে বেঁচে আছে। স্বয়ং করিবাজ মশাই টিকে আছেন ৩০০ বছর ধরে। তো, কেউ না মরলে যমের যে কোনো কাজ থাকে না। বেকার দশা। যম তাই লোকলস্কর, লাঠিসোঁটা নিয়ে মাঝেমধ্যেই কবিরাজ মশাইয়ের বাড়িতে হানা দেন। দেনদরবার, দর-কষাকষি, অনুনয়-বিনয় চলতে থাকে।

বাংলাদেশেও আমরা যমের সঙ্গে এ রকম দর-কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছি দীর্ঘকাল ধরে। দুয়ারের বাইরে অপেক্ষায় বসিয়ে রেখেছি আমরা মৃত্যুদূতকে। সেই অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশের লোকের গড় আয়ু এখন ৭১ বছরের কিছু বেশি। কয়েক দশক আগেও এটা ষাটের ঘরে ছিল।

গড় আয়ু কথাটার মধ্যে একটু জটিলতা আছে বটে। গড় আয়ু বাড়া মানেই আমরা ধরে নিতে পারি না যে দেশে বহুবর্ষজীবী লোকের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দেশে গড় আয়ু বাড়ার প্রধান কারণ, আমরা শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে পেরেছি। তবে এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে চিকিত্সাবিজ্ঞান আর জরাবিজ্ঞানের উন্নতির সুবাদে এখন দীর্ঘায়ু লোকের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। ষাট-পঁয়ষট্টিতে কেউ মরে গেলে এখন সেটাকেও অকালমৃত্যু গণ্য করা হয়। আগে এমনটা ছিল না। আর পুরো বিশ্বটা যে ধীরে ধীরে বুড়োদের রাজ্যে প্রবেশ করছে, সেটা নিয়ে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার কথা তো প্রকাশ্যেই শোনা যায়।

গত মাসে একটা খবর নিয়ে চিকিত্সাবিজ্ঞানে খুব তোলপাড় উঠেছিল। ইন্দোনেশিয়ায় সোদিমেদিয়ো নামে এক বুড়ো মারা গেছেন ১৪৬ বছর বয়সে। তিনি ছিলেন এ যাবত্কালের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী মানুষ। ভেবে দেখুন, সোদিমেদিয়ো যখন জন্মগ্রহণ করেন, রবীন্দ্রনাথ তখন ১০ বছরের শিশু। ইংরেজরা তখন সদর্পে ভারত শাসন করছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর রুশ বিপ্লবের তখনো সম্ভাবনাই তৈরি হয়নি।

তবে বিজ্ঞানীরা সোদিমেদিয়োর কথাটা বিশ্বাস করতে রাজি হচ্ছেন না। তাঁরা বলছেন, হতে পারে লোকটা বহুবর্ষজীবী, কিন্তু যতটা দাবি করছেন, ততটা না। হিসাবে কোথাও একটা গড়বড় আছে। সোদিমেদিয়োর জন্মেরও বছর ত্রিশেক পরে ইন্দোনেশিয়ায় লোকজনের জন্মের আনুষ্ঠানিক রেকর্ডপত্র রাখা শুরু হয়। ফলে লোকটির বয়সের কথা মুখে মুখেই চলে আসছে। হতে পারে এটা একটা চালু মিথ।

কিন্তু একটা লোকের আয়ু ১৪৬ বছর হলে সমস্যাটা কোথায়? এটা মেনে নিতে বিজ্ঞানীদের এত অনীহা কিসের?

অনীহার কারণ, মাত্র বছরখানেক আগেই একদল বিজ্ঞানী ঘোষণা দিয়েছেন, মানুষের দীর্ঘজীবিতার একটা ঊর্ধ্বসীমা আছে। আর সেটা হলো ১১৫ বছর। এর বেশি বেঁচে থাকা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। মানুষের দেহতাত্ত্বিক গড়নের কারণেই সেটা সম্ভব নয়। এখন সোদিমেদিয়ো এসে সেই ছক এলোমেলো করে দিতে চাইলে তো হবে না।

নিউইয়র্কের আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিনের পরিচালিত এক গবেষণার সহলেখক জ্যান ভাইগ বলেন, চিকিত্সাবিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ তার আয়ু যতই বাড়িয়ে নিক না কেন, দেখে-শুনে মনে হচ্ছে আমরা সেটার ঊর্ধ্বসীমায় পৌঁছে গেছি।

নেচার-এ গত বছর প্রকাশিত এই গবেষণা নিবন্ধে ৪১টি দেশের ডেটাবেইস ঘেঁটে দেখানো হয়েছে, গত শতাব্দীতে শিশুদের জন্মের সময় বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুণে বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি এবং কয়েকটি টিকার বিস্তারের কারণে। আবার দেখা যাচ্ছে, মানুষের ৭০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও ১৯০০ সালের পর থেকে ক্রমাগত বেড়েছে। এমনকি ৭০ পেরিয়েও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার হারও বেড়েছে অনেকটা। কিন্তু ৯০ বা ১০০-এর কাছাকাছি গেলে গ্রাফটা হুট করে পড়ে যায়। বিশেষ করে ১০০-এর বেশি বর্ষজীবীর সংখ্যা বাড়ানোয় কোনো ভূমিকাই রাখতে পারে না চিকিত্সাবিজ্ঞানের উন্নতি। ওষুধের কেরামতি ওখানে শেষ।

যেসব দেশে চিকিত্সাসেবার সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে, সেখানেও ১৯৮০-এর পরে এখন পর্যন্ত শতায়ু ব্যক্তির সংখ্যায় কোনো হেরফের ঘটেনি। এই সংখ্যা যেন নিজের চালে চলে।

দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি শতায়ু মানুষের দেশ হিসেবে পরিচিত জাপান, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। ভাইগের টিম এই চার দেশের ডেটাবেইস ঘেঁটে দেখেছেন। দেখা গেছে, ১৯৭০ থেকে ১৯৯০-এর শুরুর কয়েকটি বছর পর্যন্ত বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর সময়ের বয়স গড়ে ০.১৫ হারে বেড়েছে। তবে ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে সেটা একটা জায়গায় স্থির হয়ে আছে। এরপর দেখা যাচ্ছে, ১১৫ বছরের সীমারেখা কেউ আর পার হতে পারছে না।

গবেষকেরা বলছেন, এটাই সেই ঊর্ধ্বসীমা। এর ওপরে আর ওঠা যাবে না। এর মূল কারণ, মানুষের ডিএনএর গঠন কাঠামো। মানে, মারফতি ভাষায় বলতে গেলে আমাদের দেহঘড়িটা ওইভাবেই দম দেওয়া।

আমস্টারডামের ভিইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেন হোলস্টেগ গবেষণা করেন শতায়ু লোকদের নিয়ে। হল্যান্ডের এক শতায়ু মহিলাকে তিনি দীর্ঘদিন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। ওই মহিলা ১১৫ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। হোলস্টেগ বলেন, মানুষের সামনে মরণের একটা দেয়াল যেন তুলে দেওয়া আছে। কোনো ওষুধপথ্যই এই দেয়াল টপকাতে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না। বয়সকালে আপনি হূদেরাগের হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন। কিন্তু জরার সার্বিক ক্ষয়প্রক্রিয়া আপনি ঠেকাতে পারবেন না। একে একে সবকিছু ধসে পড়তে থাকবে।

এখন কথা হলো, যেটাকে জরার অমোঘ প্রক্রিয়া বলা হচ্ছে, সবাই স্বীকার করছেন, সেটার গোড়ায় আছে আমাদের জিনতাত্ত্বিক গড়ন বা ডিএনএর গঠন। এখানেই কিছু আশার আলো উঁকি দিতে দেখছেন কেউ কেউ। আর এই অগ্রগতিগুলো ঘটছে মানুষের মঙ্গল গ্রহে পাড়ি দেওয়া-সংক্রান্ত গবেষণার পথ ধরে। কেননা দূরের পথ পাড়ি দিতে গেলে দীর্ঘজীবী না হয়ে উপায় নেই।

গত মাসেই ইউনিভার্সিটি অব নর্থ সাউথের একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, তাঁরা এমন এক ওষুধ আবিষ্কারের কাছাকাছি চলে এসেছেন, যা মানুষের বয়স বাড়ার প্রক্রিয়া থামিয়ে দিতে এমনকি উল্টোপথেও পরিচালিত করতে পারে। বয়স বাড়ার কারণে ডিএনএর যেসব ক্ষয় বা পরিবর্তন দেখা যায়, এই ওষুধ সেগুলো উল্টোমুখী করে তুলতে পারবে।

এদিকে জরারোধী ওষুধ নিয়ে গবেষণাকারী একদল অত্যন্ত আশাবাদী আমেরিকান বিজ্ঞানী গত বছরের শেষ দিক ঘোষণা করেছিলেন, সহস্র বর্ষজীবীর প্রথম খেতাব জুটবে যে লোকটির কপালে, তিনি সম্ভবত আমাদের মধ্যেই ঘোরাঘুরি করছেন। এক হাজার বছর! কল্পনা করা যায়! কত যুদ্ধ, কত মানচিত্র বদল, কত মন্বন্তর পেরিয়ে যাবে এক জীবনে।

কথা হলো, মানুষ গত ১০০ বছরে তার গড় আয়ু দ্বিগুণ করে নিয়েছে। প্রজাতি হিসেবে মানুষ নাকি এ মুহূর্তে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী স্তন্যপায়ী প্রাণী। হাতির গড় আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর।

জরাবিজ্ঞানীরা বলছেন, আয়ু দীর্ঘায়িত করে খুব যে লাভ হচ্ছে, তা নয়। এতে জরাগ্রস্ত লোকের সংখ্যাই কেবল বাড়িয়ে চলেছি আমরা। রোগে ভুগে অকালমৃত্যুর আশঙ্কা যতই কমছে, ততই বাড়ছে হাসপাতালে দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক চিকিত্সাপদ্ধতির ভেতর দিয়ে মৃত্যুর প্রবণতা। গত মাসেই দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকার এক প্রচ্ছদ নিবন্ধ জানাচ্ছে, ধনী দেশগুলোয় বেশির ভাগ লোক এখন সুদীর্ঘ রোগভোগের পর মৃত্যুবরণ করে। দুই-তৃতীয়াংশ লোকের মৃত্যু ঘটছে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। ৬৫ বছর বয়স পার করে যাঁরা মারা যান, তাঁদের অধিকাংশই মারা যান ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট নামক এক বান্ধববর্জিত, কৃত্রিম পরিবেশের মধ্যে, যন্ত্রপাতি আর নলের এক জটপাকানো বিছানায়, চেতনা আর অচৈতন্যের এক অস্থির দোলাচলে খাবি খেতে খেতে। নিজের শান্ত গৃহকোণে পরিজনের হাত চেপে ধরে ঘুমের অতলে তলিয়ে যাওয়ার মৃত্যু যেন আমরা আর ফিরে পাব না কোনো দিন।

মনে হতে পারে, মৃত্যুকে বিলম্বিত করাই বুঝি গোটা চিকিত্সাবিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য। এটা একটা ভুল ধারণা। মানুষের যেটুকু আয়ু, সেটুকু সুস্থ, নীরোগ কাটানোর ব্যবস্থা করাই হলো আসল কথা। ভাইগ বলছেন, আমাদের সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত সেইখানে।

শীর্ষেন্দুর সেই গল্পে ফিরে যাই। ওখানে একটা মজার ঘটনা ঘটে। এক লোক কবিরাজের ধন্বন্তরি খেয়ে অমর হয়ে যায় বটে, কিন্তু তার ওষুধের ছিপি খোলা থাকার কারণে পিঁপড়াসহ কীটপতঙ্গও অমরত্ব বরণ করে। ফলে গ্রামজুড়ে তাদের সে কী উত্পাত! তা ছাড়া দেহের ভেতরে যেসব জীবাণু ছিল, আমাশয়, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি সব বিরক্তিকর রোগের জীবাণু—ধন্বন্তরি ওষুধ তো গেছে তাদেরও পেটে। ওতে জীবাণুরাও অমর হয়ে যায়। ফলে এক অনন্ত আয়ুর পাশাপাশি পাওয়া যায় এক অনন্ত আমাশয়গ্রস্ত জীবন।

লেখক: সাংবাদিক

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত