আমাদের বাবা জামাল নজরুল ইসলাম

বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম তত্কালীন ব্রিটিশ ভারতের ঝিনাইদহে, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে। কেমব্রিজের বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে তিনি ফলিত গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৮২ সালে তিনি ডিএসসি। কর্মজীবনে তিনি ক্যালটেক, ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, লন্ডনের কিংস কলেজ এবং সিটি ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে এসে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক পদে আসীন ছিলেন। বাবাকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর দুই কন্যা সাদাফ সায সিদ্দিকী এবং নারগিস নায ইসলাম

জামাল নজরুল ইসলামঅলংকরণ: মাসুক হেলাল

চমৎকার এ পৃথিবী সম্পর্কে জানার অদম্য কৌতূহল ছিল আমাদের বাবার। তাঁর এই জ্ঞানচর্চা শুধু বিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ ছিল না; ধর্ম, অর্থনীতি, দর্শন থেকে শুরু করে সংগীত, সাহিত্য, শিল্পকলা, এমনকি ইতিহাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর দখল ছিল অসামান্য। এসব ব্যাপারে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনায় তিনি ছিলেন মধ্যমণি।

আমরা যখন বেড়ে উঠছিলাম, চারপাশের জগৎ সম্পর্কে বিজ্ঞানের মাধ্যমে আমাদের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছিলেন তিনি। কঠিন বিষয়কে খুব সহজভাবে বোঝাতে পারতেন। নতুন নতুন আবিষ্কারকে শুধু রোমাঞ্চকর হিসেবে উপস্থাপন করাই নয়, একই সঙ্গে তাকে কী করে আয়ত্ত করা যায়, তাতে জোর দেওয়াই ছিল তাঁর মূল্য লক্ষ্য। ছোটবেলায় তাঁর কাছ থেকে মহাবিশ্বের আলোচনা শুনেছি। শেষের দিকে আলোচনা করতেন তাঁর দীর্ঘদিনের জটিল গাণিতিক সমস্যাগুলো নিয়ে। এগুলো নিয়ে বছরের পর বছর পরিশ্রম করেছেন তিনি।

বাবা বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ ও তার অপার সম্ভাবনায় এবং বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজনীয়তায়, যার মাধ্যমে একটি জাতি এগিয়ে যেতে পারে। তাঁর মতে, পরিবর্তন আনতে হলে দীর্ঘ সময় ধরে বিরতিহীন ও একনিষ্ঠ সাধনার কোনো বিকল্প নেই।

নিচের প্রথম সারিতে স্টিফেন হকিং (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) এবং দ্বিতীয় সারিতে জামাল নজরুল ইসমাল (ডান থেকে দ্বিতীয়)
ছবি : সংগৃহীত
তাঁর বলিষ্ঠ নৈতিকতার কারণে শেষের বছরগুলোয় তিনি আশপাশের অবস্থা দেখে খুব কষ্ট পেতেন। যেখানেই যেকোনো রকম অবিচার দেখতেন, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। এতে পরিচিতজনেরা বিব্রত হলেও তিনি পিছপা হতেন না

চট্টগ্রামকে বিশেষভাবে ভালোবাসতেন তিনি। বিদেশ থেকে এসে তিনি চট্টগ্রামেই থাকার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আশির দশকে তাঁর ফিরে আসার পর বিভিন্ন উদ্যোগ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে চট্টগ্রাম যে নতুন মাত্রা পেয়েছিল, তাকে তিনি সব সময় উৎসাহ দিতেন। এমনকি এর অংশও হতে চাইতেন। তিনি সমাজের সব ধরনের মানুষের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেতেন। তাদের সঙ্গে সানন্দে কথা বলতেন। তিনি নিজের মতো করে একটি ন্যায়নিষ্ঠ সমাজের জন্য কাজ করতেন। সে সমাজে সব সম্প্রদায় ও বিশ্বাসের মানুষ সহনশীলতা ও সহাবস্থানের সঙ্গে নির্ভয়ে বাস করতে পারবে। সেখানে থাকবে সুশিক্ষার সুযোগ, যা তৈরি হবে আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে।

তাঁর বলিষ্ঠ নৈতিকতার কারণে শেষের বছরগুলোয় তিনি আশপাশের অবস্থা দেখে খুব কষ্ট পেতেন। যেখানেই যেকোনো রকম অবিচার দেখতেন, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। এতে পরিচিতজনেরা বিব্রত হলেও তিনি পিছপা হতেন না। সাম্প্রদায়িকতা, ছাত্ররাজনীতির সহিংসতা, দুর্নীতি, সামাজিক অসমতা, ক্ষমতার জোরে সমাজস্বীকৃত ভারসাম্যহীনতা, ক্ষমতা ও সম্পদের অপব্যবহার, যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিকীকরণ, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে তিনি বরাবরই প্রতিবাদী ছিলেন।

অমর্ত্য সেন, আলী খাঁন, জামাল নজরুল ইসমাল ও আজগর কাদের (বাঁ থেকে)
ছবি : সংগৃহীত

একটি দৃষ্টান্তমূলক জীবনযাপন করতেন তিনি। আত্মীয়, বন্ধু, সদ্য পরিচিত থেকে শুরু করে সুবিধাবঞ্চিত সব মানুষের জন্য তিনি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি যেভাবে পারতেন, যতটা পারতেন, তাদের পাশে দাঁড়াতেন, সাহায্য করতেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে গুরুত্ব ও আগ্রহ নিয়ে আলাপ করতেন তিনি।

ছাত্রদের জন্যে তাঁর দরজা সব সময় ছিল খোলা। কারণ, তাঁরা ছিলেন তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন ছাত্রের মধ্যেও তিনি বিজ্ঞান ও জ্ঞান অন্বেষণের আগ্রহ তৈরি করতে পারলে নিজেকে সফল মনে করতেন। তাঁর এই মনোভাব সবার জন্যই প্রযোজ্য ছিল।

জীবনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড আশাবাদী। তাঁকে সহজে হতাশ হতে দেখা যেত না। পারিবারিক বোধ তাঁর মধ্যে ছিল প্রখর। তাই তিনি আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। প্রয়োজনে তাঁদের পাশে থাকতেন। ছেলেবেলা থেকে দেখেছি, তিনি সব সময় হাসিখুশি ছিলেন এবং বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, আমাদের সবার মধ্যেই সম্ভাবনা আছে এবং আমাদের আত্মোন্নয়নে ক্রমাগত কাজ করতে হবে, যা মানুষ ও সামাজিক কল্যাণে সুফল বয়ে আনবে।

বিজ্ঞানী আব্দুস সালামের সঙ্গে জালাম নজরুল ইসলাম
ছবি : সংগৃহীত

তাঁর জীবন ছিল সহজ-সরল ও জাঁকজমকহীন। মানুষ, মানবিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে তিনি সব সময় মানুষের মধ্যে ভালোটাই দেখতে পেতেন এবং সেটাকেই ফুটিয়ে তুলতে চাইতেন।

বাবার কাজের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি, দেশের কাজে লাগা এবং দেশকে ভালোবাসার মানে কী। সব ধরনের মানুষের সঙ্গে মেশা, প্রকৃতি, সংগীত, সাহিত্য ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে উপভোগ করা এবং চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞানীদের এক নতুন প্রজন্ম তৈরি ও অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য বহু বছর কাজ করে যাওয়ার এই শিক্ষাও তাঁর থেকেই পাওয়া।

সবশেষে বলতে চাই, বাবা হিসেবে তিনি ছিলেন দারুণ। তিনি আমাদের পর্যাপ্ত সময় দিতেন, পাশে থাকতেন, অনুপ্রাণিত করতেন, বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন, ঠাট্টা-মশকরা করতেন, আস্থা রাখতেন। চারপাশের পৃথিবীকে তাঁর যে জানার আগ্রহ ছিল, তা তিনি আমাদের মধ্যেও রেখে গেছেন; দিয়ে গেছেন সাহস ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস। সেই সঙ্গে দিয়ে গেছেন জীবন পরিচালনার দিকনির্দেশনা।

লেখকদ্বয়: অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের কন্যা