আলো আমার আলো

বিকিরণ বা রেডিয়েশনের কথা শুনলেই অনেকে আঁতকে উঠেন। কিন্তু বিকিরণ মানেই যে সবসময় ক্ষতিকর কিছু নয়, তা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। এই যেমন ধরুন, এই মুহূর্তে আপনার দেহ থেকে বিকিরণ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সত্যি বলতে কী, সবসময় মানে রাত-দিন ২৪ ঘন্টা বিকিরণ নিঃসরণ করে চলেছেন আপনি। আর সে বিকিরণের ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাংক সাধারণত ২৪ হাজার গিগাহার্জ। এই লেখাটার বাদবাকি অংশ পড়লে উত্তেজনায় আপনার কম্পাংক আরও খানিকটা বেড়েও যেতে পারে।

যা বলছিলাম, আপনিসহ প্রতিটি মানুষ আর জীবজন্তু সবসময় আলো নিঃসরণ করছে। আলোও তো আসলে এক ধরনের বিকিরণ। তবে আপনার দেহ ঠিকরে বের হওয়া ওই আলো আমাদের পরিচিত দৃশ্যমান আলো নয়। মানে খালি চোখে দেখা যায় না সেটা। আসলে গোটা মহাবিশ্বই আলোর মহাসমুদ্রে ডুবে আছে, কিন্তু তার অধিকাংশ আলোই আমরা দেখতে পাই না। সেগুলো দেখার জন্য লাগে বিশেষ বিশেষ যন্ত্র। রেডিও টেলিস্কোপ, মাইক্রোওয়েভ টেলিস্কোপ এরকম কিছু যন্ত্র। খালিচোখে আলোক বর্ণালীর লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, আসমানি, নীল আর বেগুনি রঙের আলো আমাদের কাছে ধরা পড়ে। বাকি সবটুকুই আমাদের চোখে অদৃশ্য। আমরা যখন মহাবিশ্বের আলো নিয়ে কথা বলি, তখন কোয়ান্টাম লেভেলে আলোকে ফোটন হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু ফোটন আসলে কী?

বুৎপত্তিগত দিক দিয়ে বললে ফোটন শব্দটা এসেছে গ্রিক শব্দ ফোটো (Photo) থেকে। আলোকে শক্তির প্যাকেট হিসেবে বর্ণনা করতে সাধারণত ফোটন শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ১৯০৫ সালে ফোটোইলেকট্রিক ইফেক্ট বা আলোকতড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোয়ান্টাম ধারণা ব্যবহার করেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। সেটি করতে গিয়ে আলোকে গুচ্ছ গুচ্ছ শক্তির প্যাকেট বা কণা হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। আরও অনেক পরে আলোর এই প্যাকেটের নামকরণ করা হয় ফোটন। তবে আইনস্টাইনের ফোটন শক্তি বহনের জন্য কোন খাম বা ব্যাগ নয়। বরং আলো নিজেই ফোটন, যার নিদিষ্ট শক্তি থাকে। একটা ফোটন হল আলোর একটা শক্তি স্তর। তার আকারও নির্দিষ্ট। কোন ফোটন এই আকারের চেয়ে ছোট হতে পারে না। আলোর এই কণার অস্তিত্ব কোয়ান্টামের ক্ষুদ্র জগতে।

প্রায় দুই শতাব্দী আগে নিউটনও আলোকে কণা ধরে অনেক পরিঘটনার ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু কিছু ঘটনা নিউটনের আলোক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারেনি। তার কিছুদিন পর আলোকে তরঙ্গ ধরে নিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করতে থাকেন বিজ্ঞানীরা। আইনস্টাইনের আগ পর্যন্ত আলোকে শুধু এক ধরনের তরঙ্গ বলে মনে করা হত। কিন্তু পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেল, আলোর ক্ষেত্রে দুটো কথাই সত্যি। অর্থাৎ আলো একইসঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ। কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভাষায় এর মানে হল, ফোটনের দ্বৈত অস্তিত্ব আছে। অর্থাৎ তারা একই সাথে কণা এবং তরঙ্গ। তবে তার চরিত্র আসলে কণা, নাকি তরঙ্গ তা নির্ভর করে পর্যবেক্ষকের ওপর। অর্থাৎ যখন ফোটনকে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তখন সেটা নিদিষ্ট কোন চরিত্রে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। সেটা হয় কণা, নয়ত তরঙ্গ রূপের যেকোন একটাতে। তার আগ পর্যন্ত ফোটনকে একই সাথে কণা এবং তরঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এটাই কোয়ান্টাম দ্বৈততা বা ডুয়ালিটি।

একটা বিড়ালের উদাহরণ দিয়ে ১৯২০-এর দশকে কোয়ান্টাম দ্বৈততা ব্যাখা করার চেষ্টা করেছিলেন পদার্থবিদ আরউইন শ্রোডিঙ্গার। সেটা এখন শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের প্যারাডক্স নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। সংক্ষেপে বললে বিষয়টা এরকম: একটা বাক্সের ভেতর একটা বিড়াল একই সাথে জীবিত বা মৃত থাকতে পারে। কিন্তু বিড়ালটা আসলে কী অবস্থায় আছে, সেটা বাক্সটা খোলার আগ পর্যন্ত কোনভাবেই বলা সম্ভব নয়। সোজা কথায়, পর্যবেক্ষণের আগে বিড়ালটা জীবিত নাকি মৃত তা বলা যাবে না। তাই কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভাষ্যমতে, বিড়ালটা বাক্সের ভেতর দুটো অবস্থাতেই থাকতে পারে, অর্থাৎ মাঝামাঝি কোন একটা অবস্থায়। বোঝা গেল জিনিসটা? তাহলে আরেকটা উদাহরণ দিই। একটা কয়েন শূন্যে ছুড়ে দিলে একই সাথে তার এপিঠ ও ওপিঠ (মানে হেড ও টেল) থাকতে পারে। কিন্তু কয়েনটা মাটিতে পড়লেই তার দুটোর যেকোন একটা পিঠ, হয় হেড বা টেইল নির্ধারিত হয়। আলোর ফোটনের ক্ষেত্রেও একই কথা। এটাই কোয়ান্টাম দ্বৈততা।

ফোটন মাপার বেশ কয়েকটি পদ্ধতি আছে। বেশি শক্তিশালী ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সাধারণত অ্যামস্ট্রং এককে মাপা হয়। ক্লোরিন, সালফার বা ফসফরাস পরমাণুর ব্যাসার্ধ, বা পরমাণুর কেন্দ্র থেকে তার ইলেকট্রন পর্যন্ত দূরত্ব হল এক অ্যামস্ট্রং। এছাড়া মিটার ও হার্জ এককেও ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাপা হয়। এই দুটি একক সাধারণত যেকোন তরঙ্গ পরিমাপে ব্যবহার করা হয়। খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, রেডিও টিউন করা হয় হার্জ এককে। কাজেই ৯১.২ এফএম মানে ৯১.২ মেগাহার্জ। আসলে রেডিও তরঙ্গও এক ধরনের আলো। তবে এই ফোটন আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না।

হার্জ বা অন্য একক আমাদের জানায়, একটা তরঙ্গের সাইকেল এক সেকেন্ডের কতটা। সেই সংখ্যাটা আমাদের অনেকের কাছেই অকল্পনীয়। অন্যদিকে মিটার একক ব্যবহার করে ফোটনদের মধ্যে পার্থক্য তুলনামূলক সহজেই বোঝা যায়।

ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ব্যাপ্তি অতিক্ষুদ্র (বা এক মিটারের এক ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ) থেকে অনেক বড় (বা কয়েক মিটার) হতে পারে। আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার প্রায় সবকিছুই এই ব্যপ্তির মধ্যে রয়েছে। যেমন গরম অনুভব করা, ফোন রিসিভ করা, মাইক্রোওয়েভ এবং কোন কিছু দেখার অনুভূতি সবই রয়েছে এখানে। এটাই পুরো বর্ণালী বা স্পেকট্রাম।

স্পেকট্রাম বা বর্ণালীর বিভিন্ন অংশের নাম আমাদের সবার কাছেই মোটামুটি পরিচিত। ফোটনের বর্ণালীর উচ্চ শক্তি থেকে নিম্ন শক্তির তালিকা করলে প্রথমে পাওয়া যাবে গামা রশ্মি। এরপর পর্যায়ক্রমে এক্স-রে, অতিবেগুনি রশ্মি, দৃশ্যমান আলো (বা রঙধনুর সাত রঙের আলো), ইনফ্রারেড বা অবলোহিত, মাইক্রোওয়েভ এবং রেডিও ওয়েভ বা বেতার তরঙ্গ।

মজার ব্যাপার হলো, এসব ফোটনের শক্তি স্তরের মধ্যে বিপুল পার্থক্য থাকলেও সবগুলো তরঙ্গদৈর্ঘ্যই একই বেগে চলাচল করে। সেটাই আলোর বেগ। এটাই ফোটনকে মহাবিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী করে তুলেছে। আপেক্ষিক তত্ত্ব মতে, মহাবিশ্বের আলোর চেয়ে বেশির বেগের কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। এটাই সর্বোচ্চ গতিসীমা। শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ সেকেন্ডে ৩০০,০০০ কিলোমিটার বা ৩×১০৮ মিটার/সেকেন্ড। শব্দের বেগের চেয়ে আলোর এই বেগ ৯ লাখ গুণ।

নিউটোনিয়াম পদার্থবিজ্ঞান আনুযায়ী, বেশি শক্তি মানে বেশি গতিবেগ। কিন্তু ফোটনের ক্ষেত্রে বা আরও ভালোভাবে বললে কোয়ান্টামের জগতে তা খাটে না। আগেই বলেছি আমরা এখন কোয়ান্টাম জগতে আছি। এখানে সবকিছু নিউটোনিয়াম জগত থেকে একেবারেই আলাদা।

আগেই বলেছি, ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও শক্তি স্তর থাকা সত্ত্বেও সব আলো বা সব ফোটন একই বেগে চলাচল করে। কিন্তু কীভাবে? প্রত্যেকটা ফোটনকে আমরা যদি বিভিন্ন আকৃতির জন্তু বা প্রাণী হিসেবে কল্পনা করি, তাহলে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিভিন্ন শক্তি থাকলেও তারা একই বেগে কীভাবে চলাচল করে, তা বোঝা সহজ হবে।

প্রথমেই ধরা যাক, সবচেয়ে বেশি শক্তির ফোটন গামা রশ্মির কথা। বর্ণালীতে এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্যই সবচেয়ে ছোট। বোঝার সুবিধার জন্য এই ফোটনকে ছোট পায়ের ছোট আকৃতির কোন প্রাণী ধরে নেওয়া যাক। সেটা হতে পারে খরগোশ। ছোট পায়ের কারণে বড় পায়ের কোন সঙ্গীর পাশাপাশি যেতে হলে খরগোশটাকে দ্রুত পা চালাতে হবে। কাজেই তার জন্য তাদের শক্তিরও দরকার হবে অনেক বেশি।

এবার বর্ণালীর অন্যপ্রান্তের রেডিও তরঙ্গের কথা ধরা যাক। তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য দীর্ঘ এবং শক্তিও কম। একে ধরা যাক ঘোড়া, যার পা অনেক লম্বা (লম্বা বা বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্য)। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে আমরা বুঝতে পারি, অলসভাবে হালকা চালে হেঁটেই খরগোশের চেয়েও অনেক বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে একটা ঘোড়া। আর সেজন্য তাদের শক্তিও লাগে তুলনামূলক অনেক কম। এভাবে বর্ণালীর প্রতিটি অংশের ফোটনকে বিভিন্ন আকৃতির জীবজন্তুর সাথে তুলনা করে বিষয়টা সহজেই বোঝা সম্ভব। এভাবে দেখা যাবে যে, প্রাণীদের পায়ের আকৃতি বিভিন্নরকম হলেও তারা এক জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় একই সময়ে পাড়ি দিতে পারবে। মানে তারা একই বেগে একই দূরত্বে যেতে পারবে একই সময়ে। তবে সেজন্য তাদের কারও কারও শক্তির প্রয়োজন হচ্ছে বেশি, কারও-বা কম। যেমন একই দূরত্ব পাড়ি দিতে ছোট পায়ের জন্তুদের (ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্য) বেশি শক্তি লাগবে, আর বড় পায়ে জন্তুদের (বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যে) লাগবে কম শক্তি।

এখানে একটা তথ্য জানিয়ে রাখি, গামা রশ্মির ফোটনের শক্তি দৃশ্যমান আলোর চেয়ে ৩০০ বিলিয়ন গুণ বেশি শক্তিশালী। বোঝাই যাচ্ছে, একই দূরত্ব পাড়ি দিতে দৃশ্যমান আলোর চেয়ে গামা রশ্মির ফোটনদের অনেক অনেক বেশি শক্তি লাগে। তবে মনে রাখতে হবে, এতক্ষণ জীবজন্তু নিয়ে যেসব তুলনা দেওয়া হল সেটা স্রেফ বোঝার সুবিধার জন্য, একে আক্ষরিকভাবে নেওয়া ঠিক হবে না।

এখন লেখাটার শুরুর কথায় ফেরা যাক। তাহলে মানবদেহ থেকে কী বিকিরিত হয়? উত্তরটা হল ইনফ্রারেড ফোটন বা অবলোহিত আলো। বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে এই আলোতে অন্ধাকারেও মানুষ বা অন্য জীবজন্তু সনাক্ত করা যায়। এই আলোকে আমরা খালিচোখে দেখতে না পেলেও দেহের তাপমাত্রা হিসেবে অনুভব করতে পারি। কাজেই বলা যায়, অবলোহিত আলো হল। এমন এক আলো, যাকে আমরা অনুভব করতে পারি। কথাটা শুনে অনেকের চোখ কপালে উঠে যেতে পারে, কিংবা উত্তেজনায় খানিকটা বেশি অবলোহিত আলোও বিকিরণ করে বসতে পারে। কিন্তু এটাই সত্যি। তিন সত্যি।

সূত্র: কসমস ম্যাগাজিন, উইকিপিডিয়া