প্ল্যাস্টিকের চাল এবং নকল ডিম নিয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইদানীং বেশ সরগরম। অনেকে ফেসবুক বা ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া এসব ভিডিও দেখে বলছেন, এত দিন বিশ্বাস না করলেও নিজের চোখে যা দেখলাম, তা অবিশ্বাস করি কেমন করে? নিতান্ত অপ্রচারের উদ্দেশ্যে তৈরি এসব চটকদার ভিডিও এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে সাধারণ মানুষ অনায়াসে তা বিশ্বাস করে।
অনেক দিন ধরেই নানা দেশে প্লাস্টিকের চাল বা নকল ডিমের গুজবটা ছড়ানো হচ্ছে। নকল ডিমের ‘প্রমাণ’ হিসেবে ইউটিউবের একটা ভিডিও দেখানো হয়, যাতে কোনো এক ফ্যাক্টরিতে এ রকম ডিম বানানোটা ধাপে ধাপে দেখানো হয়। ঘটনা কি তাহলে সত্যি?
নকল ডিম বানানো সম্ভব, মোম এবং এ–জাতীয় নানা দ্রব্য মিশিয়ে ডিমের মতো দেখতে কিছু অবশ্যই বানানো চলে। চীনে নানা উত্সবে এ রকম ডিমের ব্যবহার আছে বলে জানা যায়। আবার স্থানীয়ভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা চীনে এগুলো বিক্রি করার সময় ধরা পড়েছে, তা–ও ইন্টারনেটের কল্যাণে জানা গেছে। তাহলে কি বাংলাদেশে এসেছে চীনা নকল ডিম? এ রকম অনেক ভিডিও আছে। আসল ঘটনা হলো, ডিমের ভেতরে খোসার ঠিক নিচে একটি পাতলা মেমব্রেন বা আবরণ থাকে বটে। ডিম কড়া রোদে বেশি দিন থাকলে সেটা শুকিয়ে কাগজের মতো হতে পারে। তাই বলে তাকে প্লাস্টিক বা কাগজের ডিম মনে করাটা হাস্যকর।
একই ঘটনা প্লাস্টিকের চালের ক্ষেত্রেও চলে। ভিডিওতে দেখা যায়, একজন ভাত রান্না করার পরে ভাতের চেহারা দেখে বলছেন এটা নির্ঘাত প্লাস্টিকের চাল। ভাতের মাড় নাকি শুকিয়ে প্লাস্টিকের মতো হয়ে গেছে, আর ভাতটাকে বল বানিয়ে বাউন্স করানো যাচ্ছে। পোস্টদাতা কি কখনো ভাতের মাড় শুকানোর পরে কেমন হয় দেখেননি? চাল পুরোনো হলে পচতে পারে, আর সেই পচা চালের মাড় নানা অবস্থায় হাঁড়ির গরমে পড়ে প্লাস্টিকের মতো চেহারায় আসতে পারে।
প্লাস্টিকের না হলে কি ভাতের বল হতে পারে? ভাত মূলত কার্বহাইড্রেট, আর ভাতের স্থিতিস্থাপকতা অনেক সময়ে রাবারের মতো হয়। তাই ভাত বাউন্স করা সম্ভব, পদার্থবিজ্ঞানের সব নিয়ম মেনেই। তার জন্য প্লাস্টিক হওয়ার দরকার নেই।
আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের ভাত রান্না করার জন্য তা পানিতে ফোটাতে হয়, পানির স্ফুটনাঙ্ক ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাজারে যেসব প্লাস্টিক পাওয়া যায়, তাদের স্ফুটনাঙ্ক বিভিন্ন। যেমন পিভিসি প্লাস্টিক গলে ১৬০ ডিগ্রি থেকে ২১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। পানির স্ফুটনাঙ্ক ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রার ওপরে নেওয়া সম্ভব নয়। প্লাস্টিক কখনোই পানি দিয়ে ফোটানো সম্ভব হবে না। আবার প্লাস্টিক গলানো হলে সেটা তরলে রূপান্তরিত হয় অথবা তার আকার–আকৃতির পরিবর্তন হয়ে যায়। সেটি যদি প্লাস্টিক চালও হয়, তার আকার রান্নার পর ভাতের আকারে থাকার কথা নয়।
বাজারে এক কেজি চালের খুচরা দাম কত? প্রকারভেদে ৫০ টাকা থেকে ৮০ টাকা। আর এক কেজি প্লাস্টিকের দাম কত? ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, মোটামুটি নিম্নমানের এক কেজি প্লাস্টিকের দাম কোনো অবস্থাতেই ১৫০-২০০ টাকার কম নয়। আর সেই কাঁচামালকে দিয়ে চাল বানিয়ে সেই চাল যদি চীন থেকে বাংলাদেশে জাহাজে বা স্থলপথে আমদানি করা হয় এবং বেশ কয়েকজন মধ্যস্বত্বভোগীর হাত পেরিয়ে মুদির দোকানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কত হবে? তা কখনোই ২০০-৩০০ টাকা কেজির কম হওয়া সম্ভব নয়। সে অবস্থায় কীভাবে ক্রেতা সেটা ৫০ টাকা কেজিতে কিনতে পারবেন?
একই যুক্তি খাটে নকল ডিমের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের বাজারে একটা ডিমের দাম আট টাকার মতো। এখন ভেবে দেখুন, একটা নকল ডিম বানাতে যা লাগে (যেমন ডিমের শেল প্যারাফিন, জিপসাম গুঁড়া, ক্যালসিয়াম কার্বনেট এবং অন্যান্য উপকরণ) সেটা কয়েক হাজার মাইল দূর চীন থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি করার খরচসহ আট টাকার কমে কি দেওয়া সম্ভব? দোকানি আপনার কাছে আট টাকায় একটি ডিম বিক্রি করলে অবশ্যই লাভ রেখে বিক্রি করছে। কাজেই তার কেনা দাম আট টাকার অনেক কম। তাই হিসাবটা কি মেলে? দুনিয়ার সব ডিম ব্যবসায়ীরা কি অনেক টাকা লোকসান দিয়ে নকল ডিম বিক্রি করবেন, যেখানে আসল ডিম সস্তায় মুরগির কাছ থেকে পাওয়া যায়? অর্থনীতির হিসাব বলছে, সেটাও সম্ভব নয়।
কৃত্রিম ডিমের ক্ষেত্রে, ডিমের শেল প্যারাফিন, জিপসাম গুঁড়া, ক্যালসিয়াম কার্বনেট এবং অন্যান্য উপকরণ দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে। ডিমের সাদা অংশ তৈরি করা যেতে পারে ক্যালসিয়াম আলজেনাইট দিয়ে। সুতরাং এটা পরিষ্কার কৃত্রিম ডিম তৈরি করার জন্য অনেকগুলো রাসায়নিক প্রয়োজন এবং রাসায়নিকগুলোর সঠিক অনুপাতও জরুরি। বাজারে আমরা যে দামে ডিম পাই, এই দামের মধ্যে কখনোই কৃত্রিম বা নকল ডিম তৈরি সম্ভব নয়। পাশাপাশি খাবারের সময় ডিম ওমলেট বা সিদ্ধ করলে যে স্বাভাবিক আকার-আকৃতি হওয়ার কথা, প্লাস্টিকের ডিমে সেটা কখনোই হবে না। আগেই বলেছি, পানিতে প্লাস্টিক সিদ্ধ হয় না। প্রয়োজনে আপনিও পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সুতরাং প্লাস্টিকের চাল বা কৃত্রিম ডিম এসব গুজবে আমাদের কান না দেয়াই উত্তম।
কিছুদিন আগে, গাইবান্ধায় প্লাস্টিকের চাল পাওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে আসে। গাইবান্ধায় খাদ্য বিভাগ ও পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক জব্দ করা সে চাল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে এতে প্লাস্টিক–জাতীয় কোনো কিছু নেই। এ প্রসঙ্গে ব্রির শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী বলেছেন, এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত, সংগৃহীত চালের নমুনায় কোনো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব ছিল না।
লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট