ঘূর্ণিঝড়ের কারণ কী?

ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান সমুদ্রের পাশে। তাই সমুদ্র থেকে সৃষ্ট নানা দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয় বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকা সমতল। তাই এ ধরনের দুর্যোগে ক্ষতিও হয় বেশি। পাবর্ত্য-উঁচু ভূমির দেশ হলে জোরালোভাবে আঘাত করে এগোতে পারত না সমুদ্রের দুর্যোগগুলো। একে তো সমতল, তার উপর ঘনবসতি। বসতি বেশি ঘন হলে অল্প আঘাতেই আক্রান্ত হয় অনেক মানুষ এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়ে যায় অনেক। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশকে দুর্ভাগা দেশই বলতে হবে।

সমুদ্র থেকে জন্ম নেওয়া দুর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ঘূর্ণিঝড়। সমুদ্র ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম হতে পারে, তবে সেগুলো সমুদ্রেরগুলোর মতো শক্তিশালী হয় না। সমুদ্র একাই ঘূর্ণিঝড় তৈরি করে, ব্যাপারটা এমন নয়। সূর্যের প্রভাব, বায়ুমণ্ডলের প্রভাব, বায়ুর ঘনত্বের প্রভাব, তাপমাত্রার পার্থক্যের প্রভাব ইত্যাদি অনেক বিষয় জড়িত থাকে একটা ঘূর্ণিঝড়ের পেছনে।

পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান বিষুবীয় অঞ্চলে। গ্রীষ্মকালে বিষুবীয় অঞ্চলে সূর্যের তাপ খাড়াভাবে পড়ে। ফলে এই এলাকার বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তাপমাত্রা বাড়লে বায়ুর প্রসারণ হয় এবং কিছুটা হালকা হয়ে যায়। এরপর তুলনামূলক ভারী বায়ুকে নিচে রেখে হালকাগুলো উঠে যায় ওপরে। ফলে দেখা দেয় বায়ুর চাপের তারতম্য। এই তারতম্য পূরণ করতে ছুটে আসে দূরবর্তী অঞ্চলের বায়ু, যেখানে সূর্যের তাপ এখানকার মতো এত প্রবল নয়।

বিষুব রেখার অঞ্চল তো আর ছোট কোনো অঞ্চল নয়, অনেক বড়। এখানে বায়ুর চাপের তারতম্যও তাই অনেক বড়ই হবে। আর সেই চাপ পূরণ করতে আসা বায়ুর ধাক্কাও বড় হয়েই আসে। প্রবল বেগে বিস্তৃত এলাকা নিয়ে তৈরি হওয়া বায়ুর এই বিশেষ প্রবাহকেই আমরা বলি ঘূর্ণিঝড়।

পৃথিবী যদি তার নিজের অক্ষের ওপর স্থির থাকত, তাহলে বাতাসের এই প্রবাহ অনেকটা সরল পথেই আসত। কিন্তু পৃথিবী অক্ষীয়ভাবে ঘুরছে বলে বায়ুর চলাচল কিছুটা বেঁকে যায়। তার সাথে পদার্থবিজ্ঞানের ঘূর্ণন ও কৌণিক ভরবেগের কিছু নিয়মের প্রভাবে সেই বায়ুপ্রবাহে তৈরি হয় ঘূর্ণি। ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে আসে সামনের দিকে।

পুরো ঝড়টি চোঙ আকৃতির মতো হয়ে কাল্পনিক একটি অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘোরে। এই চোঙাকৃতির অংশটিই ঘূর্ণির মূল। প্রবল বেগে ছুটে আসা বায়ু ঘূর্ণির মূল অংশ তথা অক্ষের দিকে গিয়ে সংকুচিত হয়। বায়ুর সংকোচন হলে সেখানকার তাপমাত্রা বেড়ে যায়। ফলে বায়ু উঠে যায় ওপরে। এই শূন্যতা পূরণ ছুটে আসে আরও বায়ু। পর্যায়ক্রমে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। ফলে একটু একটু করে বাড়তে থাকে ঘূর্ণির শক্তি।

এই ঘূর্ণির ভেতরে যা-ই পড়ে, তা-ই লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। দশতলা বাড়ি মাটি থেকে উপড়ে আকাশে তুলে ফেলা যেন এই ঘূর্ণির শক্তির কাছে মামুলি ব্যাপার। একটি সাধারণ ঘূর্ণিঝড়ে যে পরিমাণ শক্তি থাকে, তা হাইড্রোজেন বোমার চেয়েও শক্তিশালী।

ঘূর্ণিঝড় হতে হলে যে সমুদ্রের উপস্থিতি থাকতে হবে ,এমন নয়। সমুদ্রের প্রভাব ছাড়াও পুরোপুরি ডাঙার মাঝে ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম হতে পারে। তবে এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের আকার ও শক্তি সমুদ্রেরগুলোর তুলনায় ছোট ও কম হয়। ডাঙায় জন্ম নেওয়া এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়কে বলে টর্নেডো। কয়েক বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ রকম একটি টর্নেডো হয়েছিল। এতেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সে এলাকায়। প্রচুর গাছপালা ঘড়বাড়ি ভেঙে নিয়ে যায়, অনেক মানুষ হতাহত হয়। স্থানীয় জেলখানার শক্তিশালী দেয়াল পর্যন্ত ভেঙে যায় এবং কয়েদখানা থেকে কিছু কয়েদি সুযোগ বুঝে পালিয়েও যায়!

আকারে ছোট বলে এবং খুব দ্রুত সংঘটিত হয় বলে ঘূর্ণিঝড়ের মতো টর্নেডোর পূর্বাভাষ দেওয়া সম্ভব হয় না। মানুষ অপ্রস্তুত থাকে বলে অল্পতেই অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।

ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপারটা যে পুরোপুরি নেতিবাচক, এমন কিন্তু নয়। ঘূর্ণিঝড় একটা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষার জন্যই এ ধরনের ঘটনা ঘটায়। ঘূর্ণিঝড় কিংবা এরই নামান্তর মৌসুমি বায়ু আমাদের জন্য খুবই দরকারি। বায়ুর চাপ ও তাপের এই আদান-প্রদান না থাকলে অত্যধিক গরমে কিংবা অত্যধিক শীতে মানুষের জীবন হয়ে যেত বসবাসের অনুপযোগী। তীব্র শীতে কিংবা তীব্র গরমে জীবন হয়ে যেত অতিষ্ঠ।

হাজার হাজার ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় প্রতিবছর। বেশির ভাগই সমুদ্রে উৎপন্ন হয়ে সমুদ্রেই শেষ হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে যেগুলো উপকূল পর্যন্ত চলে আসে, তখন সেটা আমাদের জন্য হয়ে দাঁড়ায় ক্ষতির কারণ।

হরেক রকম নাম

দেশভেদে এবং পরিস্থিতিভেদে একই জিনিসের ভিন্ন ভিন্ন নাম হয়। ঘূর্ণিঝড়ের বেলাতে তা-ই। টর্নেডো, সাইক্লোন, টাইফুন, হারিকেন, তুফান ইত্যাদি অনেক নামে এটি পরিচিত। কিন্তু ঘুরেফিরে এরা মূলত একই জিনিস। চীন সাগরে চীন ও জাপানের আশপাশে এটি টাইফুন নামে পরিচিত। আমেরিকার কাছাকাছি আটলান্টিক মহাসাগরের এলাকায় পরিচিত হারিকেন নামে। বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর এলাকায় এর পরিচয় সাইক্লোন নামে। বাংলার মানুষেরা অনেক সময় তুফান বলে ডাকে। বিশেষ একধরনের সাইক্লোনের নাম টর্নেডো। স্থলভাগে অল্প স্থানজুড়ে জন্ম নেওয়া প্রবল বেগের ঘূর্ণিকে বলে টর্নেডো।

আবহাওয়া সতর্কতায় বিউফোর্ট স্কেল

আবহাওয়ার খবরগুলোতে প্রায়ই ৬ নম্বর, ৭ নম্বর কিংবা ৮ নম্বর সতর্কতা সংকেতের কথা বলা হয়। কিন্তু এসব নম্বরের মানে কী? এগুলো দিয়ে কী বোঝানো হয়? এগুলো মূলত একটা স্কেলের বিভিন্ন অবস্থার অংশ। ঝড়ের তীব্রতার উপর ভিত্তি করে ১ নম্বর থেকে ১২ নম্বর পর্যন্ত মোট ১২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

আবহাওয়ার বিশেষ এই স্কেল তৈরি করেছিলেন ফ্রান্সিস বিউফোর্ট নামের নৌবাহিনীর একজন অ্যাডমিরাল। প্রায় দুই শ বছর আগে তিনি এই স্কেল তৈরি করেছিলেন। সে সময় আবহাওয়া পরিমাপের তেমন কোনো যন্ত্রপাতি ছিল না। তাঁর তৈরি করা পদ্ধতি অনুসারে কোনো যন্ত্র ছাড়াই আবহাওয়ার অবস্থা বোঝা যেত। তাঁর নামানুসারে এ স্কেলকে বলা হয় বিউফোর্ট স্কেল।

সমুদ্রে বাতাসের বেগ সম্বন্ধে ভালো ধারণা রাখতে হয় নাবিকদের। বাতাসের বেগের ওপর নৌচালনার অনেক কিছু নির্ভর করে। নৌ-বিদ্যার সুবিধার জন্য তিনি এটি তৈরি করেছিলেন। পরে একে সংশোধন করে ডাঙার বায়ুর বেগ মাপার উপযোগী করা হয়। আবহাওয়াবিদেরা এখনো এই স্কেল ব্যবহার করেন।

এই স্কেলের মাধ্যমে কোনো যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই উড়ন্ত ধোঁয়া, গাছের পাতা, ডাল অথবা ঝুলন্ত তার কিংবা কাগজের টুকরার অবস্থা দেখে বাতাসের বেগ নির্ণয় করা যায়। যেমন: গাছের পাতা যদি দোলে, তবে ঝড়ের বেগ ঘণ্টায় ৬-১২ কিলোমিটার। আর এটি ২ নম্বর সতর্কতা সংকেত। যদি গাছ থেকে কচি ডাল ভেঙে পড়ে, তবে সে ঝড়ের বেগ ঘণ্টায় ৬১-৭৪ কিলোমিটার। ৮ নম্বর সংকেত। যদি বড় গাছপালা উপড়ে যায়, তবে ১০ নম্বর সংকেত। গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৮-১০২ কিলোমিটার। ডানের পাতায় বিস্তারিত দেওয়া হয়েছে।