‘জ্ঞান আর অভিজ্ঞতায় আমরাও সেরাদের দলে’

‘জ্ঞান আর অভিজ্ঞতায় আমরাও সেরাদের দলে’ - ড. কামরুল হাসান, জ্যেষ্ঠ বায়োসেন্সর বিজ্ঞানী, অ্যাপোলো ডিএক্স, যুক্তরাষ্ট্র

Zia Islam
কামরুল হাসানখুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীবপ্রযুক্তি ও জিনতত্ত্ব প্রকৌশলে স্নাতক। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান সুইডেনে। সেদেশের লান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে সেখানেই অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করেন তিনি। এরপর চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণার জন্য উটাহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। সেখানেই তিনি কাজ করেছেন গাছের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া নির্ধারণকারী বায়োসেন্সর নিয়ে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপোলো ডিএক্স গবেষণাগারে জ্যেষ্ঠ বায়োসেন্সর বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন। সম্প্রতি স্বল্পসময়ের এক ছুটিতে অনেকদিন পর দেশে এসেছিলেন কামরুল হাসান। সেসময় বিজ্ঞানচিন্তার আমন্ত্রণে ম্যাগাজিনটির কার্যালয়ে হাজির হয়েছিলেন প্রবাসী এই বিজ্ঞানী। দেশে বিজ্ঞান গবেষণা আর আগামী দিনে জীবপ্রযুক্তিতে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার ও সহসম্পাদক আবদুল গাফফার। সঙ্গে ছিলেন আলিমুজ্জামান
বিজ্ঞানচিন্তা টিমের সঙ্গে কামরুল হাসান
Zia Islam

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: আপনি বর্তমানে কী নিয়ে গবেষণা করছেন?

কামরুল হাসান: বর্তমানে বিভিন্ন জৈব উপাদান, যেমন এনজাইম, প্রোটিন, ব্যাকটেরিয়া ও তাদের মাধ্যমে তৈরি বিভিন্ন বায়োসেন্সর নিয়ে কাজ করছি। জৈব উপাদানগুলোর সঙ্গে অজৈব উপাদানের (বিদ্যুৎ বাহক, অনেকটা ব্যাটারির ভেতরে থাকা রডের মতো) মাধ্যমে নতুন ধরনের সেন্সর উদ্ভাবনের চেষ্টা করছি। জৈব–অজৈব উপাদানগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন নিয়েও আমি কাজ করি। আসলে বায়োসেন্সর উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এই জৈব আর অজৈব যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। কারণ, অনেক সময়ই দেখা যায়, জৈব উপাদানগুলো অজৈব ইলেকট্রোডের সঙ্গে কোনো রকম ইলেকট্রন আদান–প্রদান করতে পারে না।

ইলেকট্রোডের কথা মাথায় রেখে জৈব উপাদানে পরিবর্তন আনা হয়। বিশেষ এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যারিং। এ জন্য জৈব উপাদানগুলোর মধ্যে কিছু বিশেষ ধরনের প্রোটিন থাকে। যেগুলো নিজেরাই অজৈব ইলেকট্রোডের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। এখানে আমার কাজ হলো, যেসব জৈব উপাদান ইতিমধ্যে অজৈব ইলেকট্রোডের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারে, সেগুলো যেন আরও ভালোভাবে কাজ করে, সে চেষ্টা করা। আর যেগুলো পারে না, সেগুলোকে সংযোগের উপযোগী করে তোলা। এ জন্য অনেক সময় অজৈব ইলেকট্রোডে বিশেষ পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়। খরচের দিক থেকে সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে কার্বন ইলেকট্রোডই এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে আকর্ষণীয়।

নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় একটি যন্ত্র হলো গ্লুকোজমিটার। ডায়াবেটিসের রোগীরা তাঁদের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ জানতে ব্যবহার করেন এটা। সামান্য দু–এক ফোঁটা রক্ত থেকে আমরা দেহে গ্লুকোজের মাত্রা জানতে পারি। এ যন্ত্রে রক্তের গ্লুকোজ অক্সিডেনকারী এনজাইমের সঙ্গে গ্লুকোজমিটারের ইলেকট্রোডের সঙ্গে ইলেকট্রনিক সংযোগ ঘটানো হয়। এই এনজাইমকে বলা হয় গ্লুকোজ অক্সিডেস। এই জৈব-অজৈব সম্পর্ক যদি সঠিক নিয়মে তৈরি করা সম্ভব না হয়, তাহলে কিন্তু ঠিক বুঝতে পারব না আমাদের শরীরে কী পরিমাণ গ্লুকোজ আছে।

মাইক্রোবিয়াল জ্বালানি কোষের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরি করতেও কিন্তু জৈবিক কোষের সঙ্গে ইলেকট্রোডের উপযুক্ত ইলেকট্রনিক সংযোগ ঘটানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাইক্রোবিয়াল জ্বালানি কোষ হলো একটি তড়িৎ কোষ। এর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার বিপাকপ্রক্রিয়ার ইলেকট্রনপ্রবাহ সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। আগামী দিনগুলো সারা বিশ্বকেই আসলে জৈব উপাদান থেকে শক্তি উৎপাদনের কথা চিন্তা করতে হবে।

আমাদের জন্য সৌরশক্তি নতুন এক সম্ভাবনা। বর্তমানে সিলিকন কোষ ব্যবহার করা হয় সূর্যালোক থেকে শক্তি সংগ্রহ করে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করার জন্য। আমরা বাজারে যেসব সিলিকন কোষ দেখতে পাই, তার দাম প্রচুর। পৃথিবীতে সিলিকন ধাতু অপ্রতুল। সিলিকনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। একটা নির্ধারিত সময় পরে এই সিলিকন কোষগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। তা ছাড়া সিলিকন কোষের ক্ষেত্রে আমরা যে শক্তিমাত্রার কথা শুনি, সেটা আসলে গবেষণাগারে পাওয়া হিসাব। বাজারে যেসব সিলিকন ব্যাটারি পাওয়া যায়, সেগুলোর শক্তি সরবরাহের ক্ষমতা কিন্তু আরও কম। তাই সিলিকন কোষের বিকল্প হিসেবে বিজ্ঞানীরা এখন জৈব জ্বালানি কোষের কথা ভাবছেন। আমি ও আমার দল কাজ করছি এই পুরো সৌরশক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়াতে জৈব উপাদান, যেমন বিভিন্ন রকম সালোকসংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল ইত্যাদি ব্যবহার উপযোগী করে তোলা। ধরা যাক, বাসার অব্যবহৃত পানির ট্যাংকে কিছু পানি রেখে সেখানে এসব জৈব উপাদান ছেড়ে দিলেন। পরে ওই ট্যাংকে অ্যানোড আর ক্যাথোড দণ্ড বসিয়ে বৈদ্যুতিক সার্কিট করে দিন। দেখা যাবে, ওই জৈব উপাদানগুলো সূর্যালোক ব্যবহার করে আপনার বাসার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎশক্তি তৈরি করবে। এখন হয়তো ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে এই প্রযুক্তির কথা, কিন্তু সেই দিন বেশি দূরে নয়। ব্যাকটেরিয়াগুলোর সালোকসংশ্লেষণের ফলে অভ্যন্তরীণ ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম থেকে সামান্য ইলেকট্রন ব্যবহার করে এই বিদ্যুৎশক্তি সৃষ্টি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়াগুলো সূর্যের আলো ব্যবহার করে দিনে শক্তি সঞ্চয় করবে আর রাতে সেই শক্তি ব্যবহার করে নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি উৎপাদন করবে। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাকটেরিয়াগুলো ২৪ ঘণ্টাই কার্যক্ষম থাকে। ফলে এই ব্যাকটেরিয়াল কোষ থেকে নিরবিচ্ছিন্ন শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। পৃথিবীতে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য দায়ী কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া সম্ভব এই জৈব জ্বালানি কোষের মাধ্যমে। বিষয়টা ভাবতেই আমি শিহরিত হয়ে যাই।

আমাদের গবেষণায় এখন পর্যন্ত আমরা নানা রকম জৈব উপাদান (যেমন ক্লোরোপ্লাস্ট, থাইলাকয়েড এবং বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া) নিয়ে এই পরীক্ষা করেছি। কিছু প্রজেক্ট বেশ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এ কাজের উপযোগী একটি সেরা ব্যাকটেরিয়া হলো রডেব্যাকটর ক্যাপসুলেটাস (rhodobacter capsulatus)। এর বিপাক প্রক্রিয়া খুব বিচিত্র। এর শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া নানামুখী। তাই মৌলিক বিষয়গুলো জানার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের চারপাশে খুঁজলে এ ধরনের আরও অনেক ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যাবে। সাগরের ব্যাকটেরিয়াগুলো তো নিয়মিত সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে। আমাদের গবেষণাগারে ইতিমধ্যে এগুলো থেকে শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এসব জৈব জ্বালানি কোষের মাধ্যমে আমরা ছোট আকারের বাতি কিংবা মাঝারি আকারের ফ্যান চালাতে সক্ষম হয়েছি। অ্যাকুরিয়ামে থাকা শৈবাল যদি সূর্যের আলো পায়, তাহলে সে–ও কিন্তু শক্তি উৎপাদন করতে পারবে। যদিও তুলনামূলকভাবে সিলিকন কোষের তুলনায় এ ধরনের জৈব কোষের কার্যক্ষমতা বেশ কম। সাধারণত জৈবকোষ থেকে সর্বোচ্চ কয়েক মাস জ্বালানি সরবরাহ করা যায়। তারপরে জৈব উপাদানগুলো ধীরে ধীরে মরে যায়। তবে আমরা আশাবাদী, ভবিষ্যতে এই জৈব কোষগুলোকে আর দীর্ঘ সময়ের জন্য কার্যক্ষম করা সম্ভব। ফলে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদনও করা সম্ভব হবে।

বিজ্ঞানচিন্তার কার্যালয়ে কামরুল হাসান
Zia Islam

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: আগামী দিনের প্রযুক্তিপণ্যগুলোতে বায়োসেন্সরের ব্যবহারের সম্ভাবনা কতটুকু? ভবিষ্যতে বায়োসেন্সরের অবদান কেমন হবে?

কামরুল হাসান: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বায়োসেন্সরযুক্ত বিভিন্ন যন্ত্র। ছোট্ট গ্লুকোজমিটার থেকে শুরু করে গোটা ডায়াগনস্টিক সেবাই কিন্তু ধীরে ধীরে এ রকম সব বায়োসেন্সরযুক্ত যন্ত্রে ঢুকে যাচ্ছে। সেগুলো থেকে আমাদের শরীরের পুষ্টির চাহিদা, রক্তে ভিটামিন, লবণ, গ্লুকোজ, ডায়াবেটিসসহ যেকোনো জীবাণুর অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব। এখন আমাদের জন্য বড় কাজ হলো জটিল রোগের জন্যও এমন বায়োসেন্সর তৈরি করা, যেন মানুষ সহজেই ঘরে বসে তার দেহের যাবতীয় রোগ সম্পর্কে জানতে পারে এবং তার জন্য চিকিৎসা নিতে পারে।

মানুষ ছাড়াও আসলে অন্যান্য প্রাণীর পরিচর্যার ক্ষেত্রেও কিন্তু বায়োসেন্সর ব্যবহার করা যায়। ধরুন, আমাদের দেশে কৃষি খাতে ব্যবহারের উপযুক্ত বিভিন্ন বায়োসেন্সর বানানো যেতে পারে। এমন হতে পারে যে বায়োসেন্সরের মাধ্যমে গবাদিপশুর রোগবালাই সম্পর্কে জানা যাবে। তখন সেগুলোর ঠিকমতো যত্ন নেওয়া সহজ হবে।

প্রতিদিন যেসব খাবার আমরা নিয়মিত খাই, সেটার পুষ্টিমান নিয়ে কিন্তু সব সময় প্রশ্ন থেকেই যায়। খাবারে ভেজাল আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। মানুষ সেসব খাবার নিয়মিত খাচ্ছে আর শরীরে বাসা বাঁধছে নানাবিধ জটিল রোগ। এমন বায়োসেন্সর বানানো যেতে পারে, যেটা হয়তো খাবারে স্পর্শ করালেই জানা যাবে সেটার পুষ্টিমান কিংবা খাবারে ভেজাল কিছু মেশানো হয়েছে কি না। মাছে, সবজিতে মেশানো ফরমালিন শনাক্ত করা যাবে ওই সেন্সর দিয়ে। একজন স্বাস্থ্যসচেতন ক্রেতা স্বভাবতই এ ধরনের সেন্সর ব্যবহারে আগ্রহী হবেন।

এ ছাড়া বায়োসেন্সরের অ্যাডভান্স লেভেল নিয়েও কাজ হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন মানুষের দেহের ভেতরেই যদি মাইক্রোচিপ স্থাপন করা যায়, তা দেহের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলে দেবে। অনেক ক্ষেত্রে, এসব সেন্সর মানুষের রক্তের উপাদানগুলো কাজে লাগিয়ে নিজেদের জন্য শক্তি উৎপাদন করতে পারে। ফলে আপনাকে আলাদাভাবে বায়োসেন্সর বহন করা বা এগুলোর জন্য ব্যাটারি ব্যবহার করার প্রয়োজন হচ্ছে না।

এখন এই ধরনের বায়োসেন্সর নিয়ে খুবই অ্যাডভান্স পর্যায়ে কাজ হচ্ছে। গুগল লাইফ সায়েন্স, সম্প্রতি চোখের রেটিনায় এক বিশেষ বায়োসেন্সর স্থাপন করেছে সফলভাবে। আমাদের চোখের অশ্রু থেকে এটি দেহের নানা রকম তথ্য স্মার্টফোনে সরবরাহ করতে পারে। আগামী দিনগুলোতে হয়তো আমাদের দেহের আরও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতেও এভাবে বায়োসেন্সর ব্যবহার করার সুযোগ হবে।

আমার এক সহকর্মী কাজ করছেন গাছ থেকে শক্তি উৎপাদনের। গাছ সারা দিন যে পরিমাণ শক্তি সূর্যের আলো থেকে গ্রহণ করে, তার পুরোটা কিন্তু সে ব্যবহার করে না। সেটার একটা বড় অংশ গাছ তাপীয় মাধ্যমে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে তিনি চেষ্টা করছেন সেই শক্তি সংগ্রহ করে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা। এটা করতে গিয়ে তিনি খেয়াল করেছেন, বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল বা গাছ আসলে আলাদা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শক্তি গ্রহণ করে। এমন কোনো হাইব্রিড গাছ তৈরি করা যায় কি না, যেটা একটা বিশাল পরিসরে সূর্যের আলো থেকে শক্তি তৈরি করতে পারবে, সেটা নিয়েও ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। এর ফলে সূর্যের আলো আমরা বেশি করে কাজে লাগাতে সক্ষম হব। ব্যাকটেরিয়ার কোষ থেকে শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বড় ধরনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে পুরো বিশ্বকেই আসলে প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে হবে টেকসই শক্তির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য। জৈব উপাদানগুলোকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনগুলোতে আমরা পৃথিবীর মোট শক্তি উৎপাদনের একটা বড় অংশ উৎপাদন করতে পারব বলে আশা করি।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: গবেষণার কাজে আপনার উদ্ভাবিত উপকরণগুলো সম্পর্কে বলুন। আগামী দিনের গবেষণায় সেগুলোর ব্যবহার ও বাংলাদেশে তার প্রয়োজনীয়তা কী?

কামরুল হাসান: শক্তির উৎপাদন বরাবরই আমাদের দেশের জন্য খুব বড় সমস্যা ছিল। আগামী দিনগুলোতে দেশে যদি এ ধরনের বায়োলজিক্যাল পাওয়ার স্টেশন গড়ে তোলা সম্ভব হয়, তাহলে আমরা নিজেরাই প্রকৃতি থেকে শক্তি উৎপাদন করতে পারব। আমাদের নিজেদের শক্তির চাহিদা পূরণের জন্য তখন প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর কিংবা জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তির ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না।

কয়েক বছর হলো আমরা সমুদ্র বিজয় করেছি। সমুদ্রের এই বিশাল এলাকা পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা যদি কোনো বায়োসেন্সর স্থাপন করতে চাই, যা ওই নির্ধারিত এলাকা পর্যবেক্ষণ করবে। এ ধরনের বায়োসেন্সর স্থাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শক্তির নিয়মিত সরবরাহ। সিলিকনের সৌরকোষ দিয়ে এসব বায়োসেন্সরে শক্তির সরবরাহ করা হলে নির্ধারিত সময় পরপর তা হালনাগাদ করতে হয়, এটা বেশ ব্যয়বহুল। কিন্তু যদি এ কাজে ব্যাকটেরিয়াল ফুয়েল কোষ ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেই সমস্যা থাকবে না। সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে থাকা বিশেষ ব্যাকটেরিয়াগুলো সূর্যের আলো কাজে লাগিয়ে অনায়াসে নিরবচ্ছিন্নভাবে শক্তি সরবরাহ করতে পারবে। এ ধরনের শক্তি সরবরাহ কিন্তু নদীকেন্দ্রিক যেকোনো পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থায় ব্যবহার করা সম্ভব।

এ ছাড়া আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে শস্য উৎপাদন করা হয়। এসব শস্যের চাষের ক্ষেত্রে ফসলের স্বাস্থ্য, সেগুলোর গুণগত মান এবং তা উৎপাদনে প্রকৃতির প্রভাব কতটা, তা বের করার জন্য নানা রকম বায়োসেন্সর তৈরি করা সম্ভব।

এ ধরনের প্রযুক্তিগুলো আমাদের দেশে আসার জন্য দুই ধরনের পন্থা রয়েছে। প্রথমত, হতে পারে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরাই এ ধরনের উদ্ভাবনী গবেষণাকাজে অংশ নেবেন। তাঁদের উৎপাদিত পণ্যই আমরা ব্যবহার করতে পারব; নয়তো অন্যান্য প্রযুক্তির মতোই বাইরের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত পণ্য আমরা কিনে এনে ব্যবহার করব। আমার মনে হয়, এখন আসলে সময় এসেছে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণায় অংশ নেওয়া। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা কিন্তু সারা বিশ্বের বিভিন্ন বড় গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার দিকে দিয়ে আমরাও সেরাদের দলে।

আমাদের দেশের প্রচলিত ধারণামতে, বিজ্ঞান গবেষণার জন্য কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। বিষয়টা কিন্তু মোটেও সে রকম কিছু নয়। ইচ্ছা আছে আমি একসময় দেশে ফিরে একটা বায়োলজিক্যাল সেন্সর এক্সিলেন্স সেন্টার তৈরি করব। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এ ধরনের গবেষণা আসলে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারবে।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: গবেষণার ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য ছাড়া আর কী কী বিষয়ে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে আছে বলে আপনার মনে হয়?

কামরুল হাসান: আমি মনে করি, বাংলাদেশের জন্য আর্থিক সমস্যাটাও আসলে বড় কোনো বিষয় নয়। আমাদের এখানে আসলে গবেষণার চর্চাটাই গড়ে ওঠেনি। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের গবেষণা না হলেও প্রাথমিক ধাপের কাজ কিন্তু আমাদের দেশে করাই যায়। পানির পিএইচ মাত্রা কত, সেটা জানার জন্য কিন্তু অনেক বড় কোনো যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। আমি যখন প্রথম দেশের বাইরে যাই, তখন পিএইচ মিটার ধরলে আমার হাত কাঁপত। কারণ, আমাদের দেশের হাতে–কলমে বিজ্ঞান গবেষণার সুযোগ অনেক কম।

আমাদের দেশে যতটুকু গবেষণার সুযোগ আছে, সেটা পুরোপুরি ব্যবহার করা হয় না। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি তখন দেখতাম, সারা বছর গবেষণাগারে তালা দেওয়া থাকত। ধুলা জমে যেত সব যন্ত্রে। পরীক্ষার সময় পিয়ন গিয়ে দরজা খুলে দিত। আবার পরীক্ষা শেষে তালা মেরে বন্ধ করে দেওয়া হতো। আমাদের এই ছোট গবেষণাগারগুলোর তালা খুলে দিতে হবে। সেগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেন হাতে-কলমে মৌলিক বিজ্ঞানের পরীক্ষাগুলো শিখতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে আমাদের মধ্যে যে শঙ্কা, তা অচিরেই দূর করা সম্ভব। সরকারি পর্যায় থেকে আমাদের বিনা মূল্যে যখন বই, খাতা, কলম—গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই দেওয়া হয়, তখন আসলে গবেষণার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীরা যেন বিজ্ঞান গবেষণায় নিজে থেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠে, সেই ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। বিজ্ঞানচিন্তাকে আমি সাধুবাদ জানাই এই মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য। আমাদের দেশের মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে, তাহলে চাঁদে আর কোনো ব্যক্তির ছবি দেখার সুযোগ থাকবে না। বিজ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। বিজ্ঞান ছাড়া মুক্তি মিলবে না। আমরা আর কত বিজ্ঞান গবেষণার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকব? এখনই সময় গুরুত্বসহকারে বিজ্ঞানচর্চা শুরু করার।

আমি বিদেশে বিভিন্ন পাবলিকেশনের সঙ্গে কাজ করি। গত ১১ বছরে আমি বিশ্বের নানা দেশের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীর গবেষণা তত্ত্বাবধানের কাজ করেছি। এখন পর্যন্ত বিশের অধিক প্রবন্ধ বিশ্বের নামীদামি বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশ করেছি, সেসব প্রবন্ধের তথ্য চার শতাধিক বার অন্যান্য প্রবন্ধে উদ্ধৃত করা হয়েছে। কিন্তু এটা ভাবতে খুবই খারাপ লাগে যে, আমি কখনো আমার দেশের কোনো গবেষকের প্রবন্ধ (in Electrochemistry) পাইনি। আমরা যাঁরা বাইরে থাকি, তাঁরা কিন্তু সব সময় দেশের মানুষের কথা ভাবি। দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের যেকোনোভাবে সাহায্য করার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা আগ্রহী থাকেন। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের যত বাধাই থাকুক না কেন, সেটা টপকে আমাদের সফল হতেই হবে।

প্রশ্ন :

বিজ্ঞানচিন্তা: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

কামরুল হাসান: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।

*সাক্ষাৎকারটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত ।