তলাবিহীন কুয়া এবং একজন শোয়ার্জশিল্ডের শেষ গবেষণা

১৯১৬ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গন। প্রায় দুই বছর তুমুল যুদ্ধ চলছে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে। একদিকে একজোট হয়ে লড়ছে রাশিয়ার জার সম্রাটের বাহিনী ও রোমানিয়া। অন্যদিকে জোট বেঁধেছে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য, বুলগেরিয়া, জার্মান সাম্রাজ্য ও অটোমান সাম্রাজ্য। এমনই যুদ্ধবিধ্বস্ত এক শীতের সকাল। সূর্য ওঠার আগেই শুরু হয়ে গেছে দুই পক্ষের লড়াই। চারদিকে মুহুর্মুহু গোলাগুলি আর গোলা বিস্ফোরণের শব্দ।

আচমকা ঘুম ভাঙল কার্ল শোয়ার্জশিল্ডের। চোখ খুলতেই জানালার পাতলা পর্দা ভেদ করে তিরের মতো ছুটে এল শীতের রোদ। তীক্ষ্ণ ফলার মতোই বিঁধতে লাগল তার দুই চোখে। ঝট করে চোখ আবারও বন্ধ করতে বাধ্য হলেন তিনি। ক্ষণিকের জন্য সবকিছু অন্ধকার। একদম ব্ল্যাকআউট। সেই অবস্থায় দেহে তীব্র ব্যথা টের পেতে লাগলেন আবারও। তারপর নিজেকে আবিষ্কার করলেন হাসপাতালের বিছানায়।

অনেক দিন হয়ে গেল এই যন্ত্রণায় ভুগছেন শোয়ার্জশিল্ড। সে কারণে ঘুমাতেও প্রচণ্ড কষ্ট হয়। কিন্তু ব্যথার কাছে হার মানতে রাজি নন তিনি। নিজেকেও কোনোরকম করুণা করতেও চান না। ব্যথা ভুলে থাকতে অন্য কিছুতে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবেন বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়। পাতার পর পাতা অঙ্ক কষে অদ্ভুত সব হিসাব-নিকাশ করেন। গত রাতেও অঙ্ক কষেছেন।

সে কথা মনে পড়তেই হিসাবের খাতাটার খোঁজে বিছানার পাশের ক্যাবিনেটের দিকে চকিতে তাকালেন। ক্ষণিকের জন্য ভেবে আতঙ্কিত হলেন, গত রাতে যে গাণিতিক হিসাব কষেছেন, সেটা কি কোনো স্বপ্ন ছিল! নাকি সত্যি! কিন্তু না, বৈজ্ঞানিক পেপারটা নির্ধারিত জায়গায় দেখা গেল। যাক, সবকিছু এখন সত্যি বলে মনে হচ্ছে। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন কার্ল শোয়ার্জশিল্ড।

গত রাতে শুধু কাগজ আর কলমে মহাবিশ্ব সম্পর্কে অসাধারণ একটা বিষয় উন্মোচন করেছেন তিনি। তাঁর হিসাবে দেখা গেছে, মহাকাশে এমন একধরনের বস্তু থাকা সম্ভব, যা একেবারে অবিশ্বাস্য। সে বস্তুর ভর হতে পারে দানবীয়। দুঃস্বপ্নের মতো এক বস্তু। ভাবনাটা বেশি দূর এগোল না। নার্স এসেছে সকালের ড্রেসিং করাতে।

শোয়ার্জশিল্ডের প্রতিদিনের সকালের রুটিনটা খুবই ক্লান্তিকর। সময়ও নষ্ট হয় ঢের বেশি। এ সময় ধবধবে সাদা ইউনিফর্মে ঢাকা নার্সরা তাঁর আইসোলেশন রুমে এসে ঢোকে। ধীরে ধীরে যত্ন নিয়ে তাঁর গায়ের দগদগে ঘা পরিষ্কার করতে শুরু করে তারা। বিশ্রী ঘা–টা ক্রমেই তার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। এরপর তাঁকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে বিছানার রক্তমাখা চাদরটা বদলে দেয় নার্সরা।

নার্সরা চলে যাওয়ার আগে ট্রেতে নরম রুটি ও গরম দুধ রেখে যায়। দুধে রুটি ভিজিয়ে চিবোতে থাকেন কার্ল শোয়ার্জশিল্ড। এখন একমাত্র এই খাবারই তিনি সহ্য করতে পারছেন। অন্য কোনো খাবার খেলেই ফোসকা জাতীয় সমস্যাটা আরও বেড়ে যায়। রুটি খেতে খেতে দূরাগত গুলির শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। একে একে মনে পড়তে লাগল, পূর্ব রণাঙ্গনের এই হাসপাতালে তিনি কীভাবে আর কেন এলেন।

১৯১৪ সালে ইউরোপে যুদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। ইতিহাসে সেটাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামে কুখ্যাত। শোয়ার্জশিল্ড এই যুদ্ধে না এলেও কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না। ৪০ বছর বয়সে এখানে আসতে বাধ্যও ছিলেন না তিনি। জার্মানির রাজধানীতে বার্লিন অবজারভেটরিতে বসে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করলেই পারতেন। জার্মান বিজ্ঞানে সম্মানজনক চাকরিগুলোর অন্যতম এ পদ। কিন্তু সবকিছুর মূলে ছিল জার্মানিতে ক্রমবর্ধমান অ্যান্টিসেমিটিজম।

জার্মানিতে ইহুদিবিদ্বেষ ক্রমেই বাড়ছিল। ১৮৭৩ সালের ৯ অক্টোবর জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে জন্ম কার্ল শোয়ার্জশিল্ডের—এক ইহুদি পরিবারে। তবে নিজের ইহুদি পরিচয় তিনি লোকজনকে জানাতে পছন্দ করতেন না। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগমুহূর্তে একটা উইল করেছেন তিনি। তাতেও কঠিন এক শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। সেখানে স্ত্রীকে কড়াভাবে বলেছেন, তিনি যে জাতে ইহুদি, সেটা তাঁর সন্তানদের বয়স ১৪ বা ১৫ বছরের আগপর্যন্ত যেন জানানো না হয়। সেক্যুলার জীবনযাপন করতেন তিনি। ইহুদিদের উপাসনালয় সিনাগগেও যেতেন না। তারপরও ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে কিছু বলার কথাও ভাবেননি কখনো। তাঁর ধারণা, ইহুদিবিদ্বেষের তীব্র স্রোত রুখতে হলে ইহুদিদের এমন কিছু করা উচিত, যাতে তারাও যে দেশপ্রেমী জার্মান, তাতে কারও কোনো সন্দেহ না থাকে। ঠিক এ কারণেই ১৯১৪ সালের গ্রীষ্মে ইউরোপজুড়ে একের পর এক অশুভ ঘটনা ঘটতে শুরু হওয়ার পর তার মনে হয়েছিল, এটাই নিজেকে দেশপ্রেমী প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ। তাই নিজের পিতৃভূমিকে রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন তিনি।

কাইজারের সেনাবাহিনীতে তিনি যোগ দেওয়ার পর থেকে ১৮ মাস পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে বেলজিয়ামের আবহাওয়া স্টেশন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন শোয়ার্জশিল্ড। ফ্রান্সে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গোলন্দাজ বাহিনীর গোলার গতিপথ হিসাব করেছেন। অবশেষে বদলি হয়েছেন ইস্টার্ন ফ্রন্ট বা পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে।

এখানে আসার কিছুদিন পর তাঁর মুখে হঠাৎ আলসার দেখা দেয়। শুরুতে ভেবেছিলেন, যুদ্ধের ময়দানে একটানা কাজের চাপে ক্লান্তির কারণে হয়তো এমনটি হচ্ছে। ১৯১৫ সালের শীতকালটা ছিল হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। নিজের পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকার কারণে মানসিক চাপেও ছিলেন তিনি। কিন্তু আলসারটা ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠতে লাগল। পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়ল। সারা গায়েও দেখা দিল রক্তভরা গোটা গোটা ফোসকা। সঙ্গে দেহের অধিকাংশ জায়গায় তীব্র ব্যথা। সেসব জায়গায় ঘা দেখা দিতেও খুব বেশি দেরি হলো না। ফোসকাগুলোও অনেকটা ঢেউয়ের মতো আসে-যায়। এই বাড়ে তো এই কমে। কখন বাড়বে বা কমবে, তা আগাম বলারও উপায় নেই।

বাধ্য হয়ে যুদ্ধের ময়দানে হাসপাতালে ভর্তি হন শোয়ার্জশিল্ড। চিকিৎসকেরা শুরুতে বেশ ধাঁধায় পড়লেন। কিছুদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বোঝা গেল, তাঁর রোগটার নাম পেমফিগাস ভালগারিস। ত্বকের অদ্ভুত ধরনের একটা রোগ। বেশ বিরলও বটে। এ অসুখে আক্রান্তদের নিজেদের দেহ নিজের ত্বককে আক্রমণ করে বসে। কিন্তু এর কারণ কেউ জানে না। ইহুদিদের মধ্যে রোগটা বেশ দেখা যায়। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা আশকেনাজিস গোত্রের ইহুদিদের মধ্যে। হাসপাতাল থেকে তাঁকে বলা হলো, তাদের কাছে এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তারপর থেকেই অজানা ভবিষ্যতের প্রহর গুনছেন তিনি। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে সবকিছু জানার কৌতূহল ছিল শোয়ার্জশিল্ডের। তাই ব্যথায় কাতর না হয়ে বিজ্ঞানের পেছনে সময় কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন শোয়ার্জশিল্ড।

চিকিৎসকেরা সম্ভবত তাঁকে খরচের খাতায় ফেলেছেন। তিনিও বুঝতে পারছিলেন, তাঁর অবস্থাটা সম্ভবত বেঁচে থাকার পক্ষে হুমকি। কারণ, দেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ হলো ত্বক বা চামড়া। ত্বকের ভেতর দিয়েই আমাদের দেহ থেকে ঘাম বেরিয়ে আসে। ঘামের কারণেই দেহের অতিরিক্ত তাপ বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়। তাই ত্বক না থাকলে এই প্রক্রিয়াটা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার বাইরের ক্ষতিকর রোগজীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয় ত্বক। কিন্তু গোটা গায়ে দগদগে ঘা হলে সব ধরনের জীবাণুর আক্রমণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।

এ রকম দুর্বিষহ অবস্থায় রণাঙ্গনে শুয়ে শুয়ে কদিন ধরে বৈজ্ঞানিক একটা প্রবন্ধ দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন তিনি। অবশেষে গত রাতেই সেটা লেখা শেষ হয়েছে। এবার গাণিতিক হিসাবগুলো আরেকবার পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন। তাঁর হিসাবে কি কোনো ভুল হয়েছে? ফলাফলটা কি সঠিক?

এই যুদ্ধক্ষেত্রে এসব নিয়ে আলোচনা করার মতোও আশপাশে কেউ নেই। কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি যা ভাবছেন, তাকে বলা যায় ‘ভাবনার অদ্ভুত সাগরে নিঃসঙ্গ অভিযান’। অনেকটা নিউটনের মতো। এই গণনায় তিনি নিউটনের বহুল আলোচিত মহাকর্ষ সূত্র ব্যবহার করেননি। তার বদলে ব্যবহার করেছেন একবারে টাটকা আর নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব। মাত্র কদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে সেটা। তত্ত্বটির প্রতিভাবান স্রষ্টার কথা বাদ দিলে সম্ভবত তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই তত্ত্ব ব্যবহার করে কোনো গণনা করলেন। সম্ভবত তিনিই তত্ত্বটা গভীরভাবে বুঝতে পেরেছেন এবং এতে সবচেয়ে দক্ষও বটে। মহাকর্ষের নতুন সে তত্ত্বের স্রষ্টা আলবার্ট আইনস্টাইন।

২.

হাতে গোনা কয়েক দিন শোয়ার্জশিল্ডের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আইনস্টাইনের। তখন দুজনের মধ্যে দু-একটা বাক্য বিনিময় হয়েছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। অবশ্য এর পেছনে কিছু কারণও ছিল। একে তো শোয়ার্জশিল্ডের কর্মক্ষেত্র বার্লিন অবজারভেটরির অবস্থান পটসড্যামে। বার্লিন শহরের বাইরেই বলা যায় জায়গাটাকে। অন্যদিকে আইনস্টাইনের অফিস কাইজার উইলহেম ইনস্টিটিউট ফর ফিজিকস, যেটা শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে। তাই দুজনের দেখা–সাক্ষাৎ হতো কদাচিৎ। তবে আইনস্টাইনের গবেষণা সম্পর্কে ঠিকই খোঁজখবর রাখতেন শোয়ার্জশিল্ড। একটা মহাকর্ষের তত্ত্বের পেছনে আইনস্টাইন যেভাবে প্রায় এক দশক ধরে ছুটেছেন, সে কথা তাঁর ভালোই জানা ছিল। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের সঙ্গে মহাকর্ষকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে এত দীর্ঘ সময় খেটেছেন আইনস্টাইন।

আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব নানা দিক দিয়ে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। দুটিকে সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়। এই বিশেষ তত্ত্বে আলোর গতিকে সর্বোচ্চ বলে ধরে নেন আইনস্টাইন। আলোর গতিই মহাবিশ্বের গতিসীমা। অন্যদিকে নিউটন ধরে নিয়েছিলেন, সূর্যের মতো কোনো বস্তুর মহাকর্ষ মহাবিশ্বের সব সময় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা যাবে। মানে, মহাকর্ষও অসীম বেগে ছড়িয়ে পড়ে। নিউটনের তত্ত্ব বলে, সৌরজগৎ থেকে সূর্যটা টুপ করে উধাও হয়ে গেলে তার প্রভাব আমরা সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারব। কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্ব বলে সেটা অসম্ভব। আবার আইনস্টাইন মনে করেন, সব ধরনের শক্তি হলো মহাকর্ষের উৎস। কারণ, সব শক্তিরই একটা কার্যকর ভর রয়েছে। কিন্তু নিউটনের ধারণা ছিল, মহাকর্ষের উৎস শুধু ভর।

আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব চূড়ান্তভাবে প্রণয়নের আগেই আইনস্টাইন বুঝতে পারেন যে স্থান-কালের বক্রতার কারণে দূর নক্ষত্রের আলো সূর্যের পাশ দিয়ে পৃথিবীতে আসার সময় তার গতিপথ বেঁকে যায়। আইনস্টাইন তার তত্ত্বের সমীকরণ ব্যবহার করে এমন এক ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, যা যাচাই করে দেখা সম্ভব। কতটুকু বেঁকে যাবে, তাও অংক কষে বের করলেন। কিন্তু দিনের বেলায় তো নক্ষত্র থেকে আসা কোন আলো সূর্যের পাশে কতটুকু বেঁকে যায় তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। একমাত্র উপায়, সূর্যগ্রহণের সময় নক্ষত্রগুলোর আলো পরিমাপ করে দেখা। হিসেব করে দেখা গেল, আসন্ন সূর্যগ্রহণ ২৪ আগস্ট, ১৯১৪। দেখা যাবে রাশিয়ার ক্রিমিয়া থেকে।

এটা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ১৯১৪ সালে প্রমাণের চেষ্টা করেন শোয়ার্জশিল্ডের সহকর্মী আরউইন ফ্রেনডিচ। সেজন্য দুজন সঙ্গীসহ ক্রিমিয়া যান তিনি। ততদিনে ইউরোপে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। সেই যুদ্ধে জার্মান আর ক্রিমিয়া পরস্পরের প্রতিপক্ষ। এই তিন বিজ্ঞানী তখন শত্রুপক্ষের লোক। কাজেই তারা আটক হলেন রুশ সেনাবাহিনির হাতে। তাদের স্থান হল শ্রীঘরে। মাসখানেক জেল খাটার পর সেপ্টেম্বরের শেষে দুদেশের যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের সময় তারা ছাড়া পান।

দীর্ঘদিন খাটাখাটুনির পর অবশেষে ১৯১৫ সালের শেষ দিকে সঠিক সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব খুঁজে পান আইনস্টাইন। সে বছরের নভেম্বরে জার্মানির প্রুশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসে মহাকর্ষের নতুন এই তত্ত্বের চারটি পেপার উপস্থাপন করেন তিনি। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের একটা নতুন আর অপ্রত্যাশিত কিছু চিত্র পাওয়া যেতে লাগল।

নিউটনের সূত্রমতে, সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে মহাকর্ষ বল এমন থাকে, যেন অদৃশ্য কোনো দড়ি দিয়ে এই বস্তু দুটিকে বেঁধে রাখা হয়েছে। ফলে সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে চিরকালের জন্য বাঁধা পড়ে পৃথিবী। কিন্তু আইনস্টাইন নতুন তত্ত্বে বললেন, নিউটনের এই ধারণা ভুল। তিনি প্রমাণ করলেন, সূর্যের মতো ভারী বস্তু আসলে তার চারপাশের স্থান-কাল বাঁকিয়ে দিয়ে উপত্যকার মতো তৈরি করে। আর উপত্যকার ঢালুতে গড়িয়ে চলতে বাধ্য হয় পৃথিবী। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের সারমর্ম হলো: বস্তু স্থান-কালকে বলে কীভাবে বাঁকতে হবে আর বক্র স্থান-কাল বস্তুকে বলে কীভাবে চলতে হবে।

আইনস্টাইনের তত্ত্বমতে, বক্র স্থান-কালই হলো মহাকর্ষ। আবার স্থান-কাল চারমাত্রিক। কিন্তু আবার ত্রিমাত্রিক জীব হওয়ার কারণে স্থান-কালের এই উপত্যকাকে আমরা বুঝতে পারি না। সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর মতো বস্তুর গতি ব্যাখ্যা করতে আমাদের তাই এতকাল মহাকর্ষের মতো একটা বল উদ্ভাবন করতে হয়েছে।

বার্লিনে বিজ্ঞানী সমাজের কাছে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা তত্ত্ব–সম্পর্কিত পেপারগুলো উপস্থাপন করে ১৯১৫ সালের নভেম্বরে। এর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে পূর্ব রণাঙ্গনে শোয়ার্জশিল্ডের কাছে তাঁর কপিগুলো পৌঁছে গেল। পেপারগুলো পড়ে সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি। এর সৌন্দর্য ও দুঃসাহসিকতা উপলব্ধি করে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গেলেন। কিন্তু এর চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, এই পেপারগুলো তাঁকে যেন মুক্তি দিল যুদ্ধক্ষেত্রের হাহাকার আর বীভৎসতা থেকে। সারি সারি মৃতদেহ, ধ্বংসস্তূপ আর গুলি-গোলার শব্দ থেকে তাঁকে বহুদূরের কোনো শান্তির জায়গায় নিয়ে গেল। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য গোলার গতিপথ হিসাব-নিকাশের ফাঁকে ফাঁকে তিনি অবসর পেতেন খুব সামান্যই। সেটুকু সময়েই এই তত্ত্বের পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে বসতেন।

আইনস্টাইন তত্ত্বটা ব্যবহার করেন, সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধের ধন্ধে ফেলে দেওয়া গতিপথ ব্যাখ্যায়। সৌরজগতে বুধের মতো গ্রহগুলো শুধু সূর্যের মহাকর্ষ দিয়েই নয়, অন্য গ্রহগুলো দিয়েও প্রভাবিত হয়। মহাকাশে এর উপবৃত্তাকার কক্ষপথ ক্রমান্বয়ে বদলে যাওয়া বা অয়নচলনের কারণ আসলে এই গ্রহগুলো। এই প্রভাব আমলে নেওয়ার পর বুধের কক্ষপথ বেশ ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়।

আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন, বুধ গ্রহ সৌরজগতের সবচেয়ে ভারী বস্তু বা সূর্যের কাছাকাছি। এর মানে, গ্রহটির কক্ষপথ হবে যেকোনো গ্রহের চেয়ে সবচেয়ে বেশি বক্র স্থান-কালে। ফলে মহাকাশে তার গতিপথটাও প্রভাবিত হবে। আইনস্টাইন তাঁর এই তত্ত্ব ব্যবহার করে অঙ্ক কষে বুধের গতিপথ অনুমান করলেন। এরপর জ্যোতির্বিদদের মাধ্যমে মিলিয়ে দেখলেন, এই অনুমান প্রায় পুরোপুরি মিলে গেছে। সেটা ছিল তত্ত্বটার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা। কারণ, তত্ত্বটা বুধ গ্রহের খাপছাড়া গতি নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল।

তবে নিউটনের সূত্রের গাণিতিক হিসাব যতটা সহজ-সরল, আইনস্টাইনের সমীকরণগুলো তেমন নয়। আইনস্টাইনের গাণিতিক হিসাবকে সেই বিচারে খাপছাড়া ও অমার্জিত মনে হয়। মূল সমস্যাটা হলো, তার আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের কলকবজা বেশ জটিল। এ তত্ত্বের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল বক্র স্থান-কালের গণিত। সেই বিশেষ গণিত গড়ে তুলেছিলেন উনিশ শতকের কয়েকজন বিজ্ঞানী। তাঁদের মধ্যে গণিতবিদ কার্ল ফ্রেডরিক গাউস এবং বার্নার্ড রিম্যানের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বে মাত্র একটা সমীকরণই মহাকর্ষ ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্বে সমীকরণ ছিল মোট ১০টি। তাই দেখা গেল, কোনো বস্তুর চারপাশের স্থান-কালের আকার নির্ণয় করা খুব কঠিন। এটা নির্ণয় করাকে তাত্ত্বিকভাবে বলা হয়, আইনস্টাইনের মহাকর্ষ ক্ষেত্র সমীকরণের সমাধান বা সলিউশন। একসময় খোদ আইনস্টাইন নিজেও একে কঠিন বলে বিশ্বাস করতেন। তাই সূর্যের চারপাশের বক্র স্থান-কালে বুধের গতিপথের ব্যাখ্যায় আসন্নতার আশ্রয় নেন তিনি।

রিম্যানের বক্র স্থানের জ্যামিতির কথা আগেই জানতেন শোয়ার্জশিল্ড। যুদ্ধক্ষেত্রে কানফাটা গুলির আওয়াজের মধ্যে মাঝে মাঝে ভাবতেন, আইনস্টাইনের চেয়েও তিনি ওই সমীকরণগুলোর জন্য ভালো সমাধান বের করতে পারবেন কি না। আইনস্টাইনের সমীকরণ ব্যবহার করে সূর্যের মতো কোনো স্থানীয় ভরের চারপাশের স্থান-কালের সঠিক ফর্মুলা কি খুঁজে পাওয়া যাবে? ফল যা–ই আসুক, একবার চেষ্টা করে দেখার কথা ভাবলেন শোয়ার্জশিল্ড।

সে জন্য মৌলিক কিছু অনুমান সম্বল করে কাজে নামলেন তিনি। প্রথমত, সূর্য বা যেকোনো নক্ষত্র সুষমভাবে গোলীয়। দ্বিতীয়ত, তাদের চারপাশের স্থান-কাল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় না। তৃতীয়ত, স্থান-কালের বক্রতা দিকের ওপর নির্ভর করে না, বরং শুধু সূর্য থেকে ব্যাসার্ধীয় দূরত্বের (‘radial’ distance) ওপর নির্ভর করে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই অন্তর্জ্ঞানের মাধ্যমে আইনস্টাইনের সমীকরণগুলো ব্যাপকভাবে সরলীকরণ করতে সক্ষম হন শোয়ার্জশিল্ড। এভাবে দশটি সমীকরণ থেকে মাত্র একটাতে নামিয়ে আনা গেল। এরপর কিছু গাণিতিক ভেলকিবাজি প্রয়োগ করে দেখতে পান যে ওই একটিমাত্র সমীকরণের অনন্য একটা সমাধান রয়েছে।

এভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলেন শোয়ার্জশিল্ড। সূর্যের চারপাশের বক্র স্থান-কালে কোনো আসন্নতা নয়, বরং একটা নিখুঁত বর্ণনা খুঁজে পান। সেটাই ছিল আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বের প্রথম নিখুঁত কোনো সমাধান। এই সমাধান আবিষ্কারের মাধ্যমেই পদার্থবিজ্ঞানে তার অমরত্বপ্রাপ্তির জন্য যথেষ্ট ছিল।

এই নিখুঁত সমাধান ব্যবহার করে শোয়ার্জশিল্ড বেশ দ্রুত বুধ–সংক্রান্ত আইনস্টাইনের দাবি নিশ্চিত করলেন। তিনি দেখালেন, বুধের অয়নচলন এই সমাধানের মাধ্যমে বেশ ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। এই গাণিতিক হিসাব কাগজে লিখে ফেললেন তিনি। ১৯১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর একটা চিঠিসহ সেই গণনাটা পাঠিয়ে দিলেন আইনস্টাইনকে। চিঠির শেষে লিখলেন, ‘দেখতেই পাচ্ছেন, যুদ্ধটা আমার জন্য বেশ ফলদায়ক হয়েছে। তাই প্রচণ্ড গোলাগুলি সত্ত্বেও সবকিছু থেকে দূরে সরে আপনার ধারণার রাজ্যে পা ফেলার সুযোগ পাচ্ছি।’

কিন্তু শোয়ার্জশিল্ড তখন বুঝতে পারেননি তাঁর মুখে হঠাৎ জেগে ওঠা ফোসকাগুলো কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এই রোগের কারণেই শেষ পর্যন্ত জার্মান সেনাবাহিনীতে একসময় অযোগ্য হয়ে ওঠেন তিনি। আশ্রয় পান যুদ্ধক্ষেত্রের একটা হাসপাতালে।

৩.

রাজধানী বার্লিন, জার্মানি। পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গন থেকে হঠাৎ একটা চিঠি পেয়ে অবাক হলেন আইনস্টাইন। অবশ্য চিঠির প্রেরকের সম্পর্কে আগেই শুনেছিলেন। ঘটনাটা অসাধারণ মনে হয়েছিল তাঁর কাছে। তিনি জানতেন, বার্লিন মানমন্দিরের এই পরিচালক বয়স ৪০ বছর হওয়া সত্ত্বেও কাইজারের সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু শোয়ার্জশিল্ড তাঁকে কী লিখতে পারেন? কেনই–বা চিঠি লিখেছেন তাঁকে?

খাম ছিঁড়ে ভেতরে নিজের তত্ত্বের গাণিতিক হিসাব দেখে আরেক দফা অবাক হলেন আইনস্টাইন। পাতাভর্তি বীজগণিতের জটিল গণনা দ্রুতবেগে পড়তে শুরু করলেন। এক মাস‌ও হয়নি প্রুশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসে সাধারণ আপেক্ষিকতা তথা নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। সেখানে এই চিঠি প্রমাণ করে যে মাত্র কদিনেই শোয়ার্জশিল্ড তত্ত্বটিতে শুধু দক্ষ হয়ে ওঠেননি, একে নতুন একটা রাজ্যে নিয়ে গেছেন। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রথম সঠিক সমাধান করেছেন ওই লোকটাই। অথচ কাজটাকে নিজের কাছে ভীষণ কঠিন ও অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই মুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ আইনস্টাইন।

শোয়ার্জশিল্ডকে শিগগিরই একটা চিঠির জবাব লিখতে বসলেন। আইনস্টাইন লিখলেন, ‘পরম আগ্রহ নিয়ে আমি আপনার লেখা পেপারটা পড়েছি। ধারণাই করতে পারিনি, এত সরল উপায়ে এই সমস্যার সমাধান কেউ কখনো করতে পারবে। এ বিষয়ে আপনার গাণিতিক প্রয়োগ আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’

পরের বৃহস্পতিবার প্রুশিয়ান একাডেমিতে শোয়ার্জশিল্ডের কাজটা উপস্থাপন করার প্রতিশ্রুতি দিলেন আইনস্টাইন। সাধারণত কথার বরখেলাপ করতেন না তিনি। ১৯১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি শোয়ার্জশিল্ডের পেপারের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করলেন।

তখনো পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে হাসপাতালে শুয়ে দুরারোগ্য অসুখে অনিশ্চিত দিন কাটাচ্ছেন শোয়ার্জশিল্ড। আইনস্টাইনকে প্রথম যে পেপারটা পাঠিয়েছেন, সেটাকে বলা যায় প্রথম অংশ। এ বিষয়ে কাজ আসলে তখনো অনেকটা বাকি। প্রথম পেপারে তত্ত্বটা ব্যবহার করে তিনি একটা আদর্শ নক্ষত্র বা গোলীয় ভরসংক্রান্ত গণনা করেন। তাতে ওই নক্ষত্রের চারপাশের বক্র স্থান-কালের সঠিক ব্যাখ্যা পান। কিন্তু নক্ষত্রটার ভেতরে কী ঘটছে? সেটা জানা তখনো বাকি ছিল। হাসপাতালে শুয়ে নিদারুণ কষ্ট সয়ে সে গণনা করছিলেন তিনি।

বিষয়টা নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরেই ভাবছিলেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, এ–সংক্রান্ত গণনা নিয়ে যখন ব্যস্ত থাকেন, তখন তাঁর দেহের ব্যথা কোথায় যেন উবে যায়। বাস্তবতা থেকে হারিয়ে কোনো এক স্বপ্নলোকে বুঁদ হয়ে যান। রুটিনমাফিক নার্সরা এসে ডাকেন, ‘প্রফেসর শোয়ার্জশিল্ড! আপনাকে ড্রেসিং করতে হবে...বিছানার চাদর বদলাতে হবে...আপনার একটু হাঁটা দরকার...।’ আবারও বাস্তবের যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরেন বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জশিল্ড। যে যুদ্ধ একই সঙ্গে তাঁর মাতৃভূমি রক্ষার এবং নিজ দেহের দুরারোগ্য অসুখের সঙ্গেও।

একসময় চমকপ্রদ সমাধান হাজির হলো তাঁর হিসাবে। সেখানে এমন একটা বিষয় খুঁজে পেলেন, যা এককথায় অবিশ্বাস্য। মহাকাশের কোনো বস্তু যদি একটা নির্দিষ্ট ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধে সংকুচিত করে ফেলা সম্ভব হয়, তাহলে স্থান-কাল এত বেশি বেঁকে যাবে যে সেটা আর নিছক উপত্যকার চেহারায় থাকে না। তার বদলে সেটা হয়ে যায় মহাকাশের তলাবিহীন কুয়ার মতো। এই কুয়ার মধ্যে কিছু পড়লে তা আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এমনকি কোনো আলোও সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ওই নক্ষত্র তখন চিরকালের জন্য গোটা মহাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেটা মহাকাশের ভেতর একটা গর্তের মতো আবির্ভূত হয়। ওই অদ্ভুত বস্তুর কোনো নাম দেননি শোয়ার্জশিল্ড। তবে এককালে বিশ্বের প্রায় কারও এই বস্তুর নাম জানতে বাকি থাকবে না। এককালে বস্তুটির নাম দেওয়া হবে ব্ল্যাকহোল। বাংলায় বলা হবে কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণবিবর। গোটা বিশ্বে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী—সবার মধ্যে ফেলে দেবে মহাকাশের অদ্ভুতুড়ে বস্তুটি।

এই ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধটা অবিশ্বাস্য রকমভাবে ছোট। স্থান-কালের সমাধান শোয়ার্জশিল্ড যেমনটা দেখিয়েছিলেন ঠিক তেমন। একদিন এই ব্যাসার্ধকে ডাকা হবে এর আবিষ্কারের নামে। শোয়ার্জশিল্ড রেডিয়াস বা শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ। যেমন সূর্যকে যদি শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধে সংকুচিত করা হয়, তাহলে তা ৩ কিলোমিটারে দাঁড়াবে। আর পৃথিবীর আকৃতি হবে মাত্র ‌১ সেন্টিমিটার। সূর্য বা পৃথিবীকে যদি কখনো এই আকৃতিতে সংকুচিত করে ফেলা হয়, তাহলে চোখের নিমেষে তারা চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাবে।

সূর্য এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ১০ লাখ কিলোমিটারের বেশি। কাজেই তাকে শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধে সংকুচিত করা হলে তার ভেতরের পদার্থগুলো চরম ঘনত্বে এসে দাঁড়াবে। নিজের কষা হিসাব দেখে শোয়ার্জশিল্ড শুরুতে ভাবলেন, এটা খেপাটে ব্যাপার এবং হয়তো শুধু নিছক গাণিতিক পরিণতি। তবে বাস্তবে তার সম্ভাবনা একেবারেও উড়িয়েও দেননি। কারণ, তিনিই এককালে লিখেছিলেন, ‘ইতিহাস বলে, গাণিতিক সমাধান প্রায়ই প্রকৃতিকে বুঝতে পারে, যেন গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে আগে থেকেই নির্ধারিত কোনো একধরনের হারমোনি রয়েছে।’ সে কারণেই তিনি ভাবলেন, মহাকাশের এই দানবের অস্তিত্ব হয়তো থাকতেও পারে।

নিজের সদ্য লেখা দ্বিতীয় পেপারটা ভাঁজ করে খামে ভরলেন শোয়ার্জশিল্ড। সেটা সিল করে আর্দালিকে দিয়ে ডাকঘরে পাঠালেন।

৪.

কয়েক দিন পরে শোয়ার্জশিল্ডের দ্বিতীয় পেপারটি এসে পৌঁছাল আইনস্টাইনের হাতে। এবারের গণনা দেখেও আগের মতোই বিস্মিত হলেন তিনি। ব্ল্যাকহোলের মতো একটা বস্তুর অস্তিত্ব দেখে ভীষণ চমকে উঠলেন তিনি, কিন্তু বস্তুটির অস্তিত্ব কিছুতেই মানতে পারলেন না।

তবু ১৯১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রুশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসে শোয়ার্জশিল্ডের দ্বিতীয় পেপারটা উপস্থাপন করলেন আইনস্টাইন। মহাকাশের অদ্ভুতুড়ে একটা বস্তুর সম্ভাবনা সম্পর্কে সেই প্রথমবার জানতে পারল বিজ্ঞানী সমাজ।

ওদিকে শোয়ার্জশিল্ডের শারীরিক অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকল। একসময় তাঁকে রণাঙ্গন থেকে ফিরিয়ে আনা হলো বার্লিনে। কিন্তু তাতে খুব বেশি লাভ হলো না। ১৯১৬ সালের ১১ মে মাত্র ৪২ বছর বয়সে মারা গেলেন কার্ল শোয়ার্জশিল্ড। তবে মৃত্যু হলো না তাঁর আবিষ্কৃত একটা জিনিসের। সেটা হলো তাঁর নির্ণয় করা কৃষ্ণগহ্বরের জন্য আইনস্টাইনের সমীকরণের সমাধান।

এভাবেই বিজ্ঞানজগতে সেবার জায়গা করে নিল মহাকাশের তলাবিহীন কুয়া বা কৃষ্ণগহ্বর। তবে শেষ পর্যন্ত এই রহস্যময় বস্তুর প্রত্যক্ষ প্রমাণের জন্য বিজ্ঞানীদের পাড়ি দিতে হলো আরও দীর্ঘ পথ। সে আরেক গল্প।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা