দিমিত্রি মেন্দেলিভ: বিজ্ঞানী ও মানুষ

তবোলস্ক রাশিয়ার ছোট্ট একটা শহরের নাম। তেল ও গ্যাসের জন্য বিখ্যাত তুমেন্সক প্রদেশে অবস্থিত। ১৫৮৭ সালে এই শহর প্রতিষ্ঠা করা হয় সাইবেরিয়া জয়ের জন্য, যদিও শহরের স্ট্যাটাস সে পায় আরও তিন বছর পর, ১৫৯০ সালে। এটাই সাইবেরিয়ার প্রথম শহর। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তবোলস্কই ছিল সাইবেরিয়ার প্রধান রাজনৈতিক, ধর্মীয়, শাসনতান্ত্রিক ও সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর। ১৭০৮ সাল থেকে এটা ছিল উরাল পর্বতশ্রেণি থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল সাইবেরিয়ার কেন্দ্রস্থল। তবে উনিশ শতকে তবোলস্ককে পাশ কাটিয়ে নতুন রাস্তাঘাট ও বাণিজ্যপথ গড়ে ওঠার কারণে সে তার আগের গৌরব ও গুরুত্ব হারাতে শুরু করে।

তবোলস্ক যখন তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে একটা সাধারণ শহরে পরিণত হতে চলেছে, তখন ইভান পাভলোভিচ মেন্দেলিভ ও মারিয়া দমিত্রিয়েভনা মেন্দেলিভের কোল আলো করে জন্ম নেন দমিত্রি বা দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিভ। তাঁর জন্ম ১৮৩৪ সালের ২৭ জানুয়ারি বা নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৮ ফেব্রুয়ারি। পিতা ইভান পাভলোভিচ মেন্দেলিভ ছিলেন তখন তবোলস্ক জিমনেসিয়াম এবং তবোলস্ক এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর। দিমিত্রি ছিলেন পরিবারের সপ্তদশ (মতান্তরে চতুর্দশ) ও কনিষ্ঠ সন্তান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭ সন্তানের ৮ জনেরই মৃত্যু ঘটে শিশুকালে।

১৮৩৪ সালে দিমিত্রির জন্মের কিছুদিন পর বাবা ইভান পাভলোভিচ অন্ধ হয়ে গেলেন। ১৮৪৭ সালে ইভান যখন মারা যান, দিমিত্রির বয়স যখন মাত্র ১৩। ফলে বিশাল সংসারের দায়িত্ব পড়ে মা মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার হাতে। মারিয়া তখন একটি ছোট্ট কাচের কারখানা চালাতেন। দারিদ্র্যের কাছে হার না মেনে সব কটি ছেলেমেয়েকে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। ছোট ছেলে দিমিত্রিকে তবোলস্ক জিমনেসিয়ামে ভর্তি করান। কিন্তু দিমিত্রির সব বিষয় পড়তে ভালো লাগত না। তবে পদার্থবিদ্যা আর গণিতের প্রতি তাঁর ছিল অদম্য আগ্রহ।

১৯৫০ সালে মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা মারা যান। দিমিত্রির বয়স তখন মাত্র ১৬। মাকে খুব ভালোবাসতেন মেন্দেলিভ। মাকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘মা আমাদের প্রতিপালন করেছেন ভালোবাসা দিয়ে, শেষ শক্তি আর অর্থ ব্যয় করে আমাদের সাইবেরিয়া থেকে বের করে এনেছেন শুধু বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য। মৃত্যুর আগে বলেছেন, আমরা যেন আত্মতুষ্টিতে না ভুগি, যেন পরিশ্রমী হই, কথায় নয় যেন, কাজে বৈজ্ঞানিক সত্য সন্ধান করি। কেননা, তিনি জানতেন, আমাদের আরও অনেক অনেক জানতে হবে, বিজ্ঞানের পথে, ভালোবাসা দিয়ে, কিন্তু দৃঢ়ভাবে কুসংস্কার ও ভুলগুলো নির্মূল করেই শুধু সত্যিকারের জ্ঞান লাভ সম্ভব। সত্যের সুরক্ষা, স্বাধীন বিকাশ, সর্বজনীন মঙ্গল আর মানসিক প্রশান্তি—এটাই হবে গবেষণার প্রধান অর্জন।’ মায়ের এই শেষ ইচ্ছাকে দিমিত্রি ইভানোভিচ পবিত্র বলে বিবেচনা করতেন।

নিজের প্রতিভা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ মেন্দেলিভ পান পিস্টে পিটার্সবার্গের প্রধান পেডাগগিক্যাল ইনস্টিটিউটে। ছাত্রজীবনে মেন্দেলিভের গবেষণার বিষয় ছিল রাসায়নিক বিশ্লেষণ, অরথাইট ও পাইরেক্সিনের গঠন বিশ্লেষণ। পরে তিনি কখনোই রাসায়নিক বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করেননি। যদিও এটাকে মনে করতেন, বিভিন্ন গবেষণার ফল পরিমার্জনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি। তিনি মনে করতেন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতোই মিনেরলজির সূত্রও সেই তিন বিভাগের অন্তর্গত। যা বস্তুর আকার, গঠন বা বিষয়বস্তু ও গুণাবলি নির্ধারণ করে। বস্তুর আকার ক্রিস্টালগ্রাফির সূত্র মেনে চলে, আর তার গুণাবলি ও গঠন পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের সূত্র মেনে চলে।

ইনস্টিটিউট শেষ করে মেন্দেলিভ প্রথমে সিম্ফেরাপোলে, তারপর ওদেসায় শিক্ষকতা করেন। ১৮৫৬ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে আসেন এবং রসায়নে মাস্টার্স থিসিস ডিফেন্ড করেন। ২৩ বছর বয়সে তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন পিটার্সবার্গ ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে প্রথমে তাত্ত্বিক ও পরে অর্গানিক জৈব রসায়ন পড়াতেন।

১৮৫৯ সালে মেন্দেলিভ দুই বছরের জন্য হাইডেলবার্গে যান। সেখানে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং নিজের তৈরি ল্যাবরেটরিতে ক্যাপিলিয়ারিটি (কৈশিকতা) এবং তরলের পৃষ্ঠতলের ওপর গবেষণা করেন। হাইডেলবার্গের গবেষণার শেষের দিকে মেন্দেলিভ লেখেন, ‘আমার গবেষণার মূল বিষয় হলো ভৌত রসায়ন। এমনকি নিউটন বিশ্বাস করতেন যে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কারণ হলো বলবিদ্যার অনুরূপ আন্ত-আণবিক আকর্ষণ শক্তি। রাসায়নিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন আবিষ্কার রসায়নকে পদার্থবিদ্যা ও বলবিদ্যা থেকে আলাদা করে নতুন এক বিজ্ঞানে পরিণত করেছে। কিন্তু একদিন সেই সময় আসবে, যখন রাসায়নিক সম্পর্ক বলবিদ্যা বা যান্ত্রিক ঘটনা বলে বিবেচিত হবে। আমার গবেষণা সেই দিনকে এগিয়ে নিয়ে আসবে।’

১৮৬১ সালে মেন্দেলিভ সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং জৈব রসায়নে শিক্ষকতা শুরু করেন। তখন বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখেন জৈব রসায়নের। জৈব রসায়নে তিনি ছিলেন রাশিয়ার প্রথম তাত্ত্বিকদের একজন। এরপরও জৈব রসায়ন নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করেননি মেন্দেলিভ। ১৮৬৩ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ পদার্থবিদ্যা ও গণিত ফ্যাকাল্টি তাঁকে টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়। কিন্তু টেকনোলজির ওপর মাস্টার ডিগ্রি না থাকায় তাঁর নিয়োগ বাস্তবায়িত হয় ১৮৬৫ সালে। তিনি অবশ্য ১৮৬৪ সালে পিটার্সবার্গ টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হন।

১৮৬৫ সালে তিনি পানির সঙ্গে অ্যালকোহলের যোগ সম্পর্কে (About alcohol compounds with water) নামে ডিএসসি থিসিস ডিফেন্ড করেন। ১৮৬৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অজৈব রসায়ন বিভাগের দায়িত্ব পান। এই পদে তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর অধিষ্ঠিত ছিলেন।

ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে নিজেকেই বই লিখতে হয় মেন্দেলিভের। তিনি যখন রাসায়নিক মৌলগুলোর আলোচনা পর্যায়ক্রমে সাজাতে চাইলেন, দেখলেন কাজটা সহজ নয়। তিনি প্রথমে যোজনী অনুসারে সেটা করার সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু পরে বিভিন্ন মৌল সাদৃশ্য ও পারমাণবিক ভরের ওপর ভিত্তি করে সেটা সাজানোর চেষ্টা করেন। এই তালিকাই পরে মেন্দেলিভের পিরিয়ডিক টেবিল বা পর্যায় সারণি নামে বিখ্যাত হয়।

কিছু কিছু মৌলের মধ্যে যে সাদৃশ্য রয়েছে, সেটা অনেকেরই জানা ছিল। ১৮৫৭ সালে সুইডিশ রসায়নবিদ লেন্সেন এ বিষয়ে লেখেন। মেন্ডেভের লাইব্রেরিতে ১৮৪৩ সালে প্রকাশিত জার্মান রসায়নবিদ গেমলেনের একটা টেবিলও ছিল। ১৮৫৭ সালে ইংরেজ রসায়নবিদ অডলিং তাঁর ভার্সন প্রকাশ করেন। কিন্তু কোনো টেবিলই সে সময় পর্যন্ত জানা সব মৌলকে একটিমাত্র টেবিল বা সারণিতে সফলভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম ছিল না। যদিও বিভিন্ন গ্রুপ ও বিভিন্ন ফ্যামিলির উপস্থিতি ছিল প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু এই সব গ্রুপ ও ফ্যামিলির আন্তসম্পর্ক ছিল অজানা।

মেন্দেলিভ পারমাণবিক ভর উচ্চ পর্যায়ক্রমে প্রতিটি কেমিক্যাল মৌলগুলো সাজিয়ে সেই সম্পর্ক আবিষ্কার প্রতিষ্ঠিত সফলভাবে। এ জন্য তাঁকে প্রচণ্ড মানসিক পরিশ্রম করতে হয়। তিনি প্রতিটি এলিমেন্টের পারমাণবিক ভর ও মূল গুণাবলি আলাদা আলাদা কার্ডে লিখতে শুরু করেন এবং সেই কার্ডগুলো বিভিন্ন কম্বিনেশনে সাজান। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, তখন পর্যন্ত অনেক মৌল আবিষ্কৃত হয়নি, আর সেগুলোর পারমাণবিক ভর তখন পর্যন্ত খুব নিখুঁতভাবে বের করা যায়নি। প্রায় ১৫ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর মেন্দেলিভ যখন আশা ছেড়ে দেন, তখনই সমস্যার সমাধান আসে। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘সারা রাত না ঘুমিয়ে, সমাধানের আশা ছেড়ে এক সুন্দর সকালে আমি যখন কেবিনেটের সোফায় ঘুমিয়ে পড়ি, সেই ঘুমের ভেতর, স্বপ্নে আমি সেই সারণি দেখতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে কাগজের টুকরায় স্বপ্নে দেখা সেই সারণি টুকে রাখি।’ এ থেকে দেখা যায়, ‘মেন্দেলিভের পর্যায় সারণি স্বপ্নে পাওয়া’, মেন্দেলিভ নিজেই এই কিংবদন্তি তৈরি করেন বিজ্ঞানের সেই অন্ধ ভক্তদের জন্য, যাঁরা অন্তর্দৃষ্টি ব্যাপারটা যে কী, সেটা ঠিক বুঝতে পারেন না।

নিজে যেহেতু রসায়নবিদ, তাই মেন্দেলিভ মৌলকে রাসায়নিক গুণাবলিকে তাঁর সিস্টেমের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং রাসায়নিকভাবে সাদৃশ্য মৌলগুলো একের পর এক সাজাতে থাকেন। কিন্তু এতে কোনো ফল আসে না। তখন তিনি ইচ্ছেমতো কিছু কিছু মৌলের পারমাণবিক ভর বদলান (যেমন ৬০-এর পরিবর্তে তিনি ইউরেনিয়ামের ভর লেখেন ২৪০), কোবাল্ট ও নিকেল, টেলুরিয়াম ও আয়োডিন পুনর্বিন্যাস করেন এবং তখন পর্যন্ত অজ্ঞাত মৌলদের জন্য তিনটি ঘর ফাঁকা রাখেন। এভাবে তিনি তাঁর সারণির প্রথম ভার্সন প্রকাশ করেন ১৮৬৯ সালে। তাঁর আবিষ্কৃত সূত্র বলে, ‘রাসায়নিক এলিমেন্টের বৈশিষ্ট্য তাদের পারমাণবিক ওজনের ওপর নির্ভরশীল।’

মেন্দেলিভের আবিষ্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একেবারে আলাদা বলে মনে হওয়া মৌলগুলোর সব গোষ্ঠীকে একত্র করতে পেরেছিল। এই পর্যায়ক্রমিক টেবিলের অপ্রত্যাশিত ব্যর্থতা তিনি বেশ সফলভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, অনেক রাসায়নিক মৌল এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই টেবিলে তিনি বেশ কিছু ঘর ফাঁকা রেখেছিলেন। কিন্তু প্রস্তাবিত মৌলের পারমাণবিক ভর ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের পূর্বাভাস তিনি দিয়েছিলেন। তিনি একই সঙ্গে কিছু মৌলের পারমাণবিক ভর সংশোধন করেন। পরবর্তী বিভিন্ন গবেষণার ফল তাঁর তত্ত্বের নির্ভুলতা প্রমাণ করে।

প্রথম কয়েক বছর মেন্দেলিভ তাঁর সারণিতে বিভিন্ন পরিবর্তন আনেন। ১৮৬৯ সালে তিনি হ্যালোজেন ও ক্ষারীয় ধাতুকে টেবিলের কেন্দ্র থেকে প্রান্তে নিয়ে আসেন। পরের বছরগুলোতে তিনি ১১টি মৌলের পারমাণবিক ভর সংশোধন করেন এবং ২০টির স্থান পরিবর্তন করেন। ১৮৭১ সালে তিনি ‘রাসায়নিক মৌলের পর্যায়ক্রমিক সূত্র’ নামে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যাতে মেন্দেলিভের টেবিল বলতে গেলে আধুনিক রূপ পায়। তাঁর এই নিবন্ধ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে তখনকার সব বিখ্যাত রসায়নবিদদের কাছে পাঠানো হয়, কিন্তু কেউই এই আবিষ্কারের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি। ১৮৭৫ সালে লেককডে বুয়াবদ্রান (F. Lekokde Buabodran) গ্যালিয়াম আবিষ্কার করেন, যার বৈশিষ্ট্য মেন্দেলিভের করা পূর্বাভাসের সঙ্গে মিলে যায়। তখন থেকেই এই সারণির প্রতি রসায়নবিদদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন শুরু হয়। ১৮৭৯ সালে স্ক্যান্ডিয়াম আর ১৮৮৬ সালে জার্মেনিয়াম আবিষ্কৃত হয়। এদের বৈশিষ্ট্য মেন্দেলিভের বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। এটা ছিল মেন্দেলিভের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আরেক রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার ফ্রিডমান সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের এক গাণিতিক মডেল তৈরি করেন ১৯২২ সালে। যেহেতু তখন বিশ্বাস করা হতো যে মহাবিশ্ব পরিবর্তনশীল নয়, আইনস্টাইন সেটাকে ভুল বলে পরিত্যাগ করেন। কিন্তু ১৯২৯ সালে হাবলের আবিষ্কারের পর মহাবিশ্ব যে সম্প্রসারিত হচ্ছে, সেটা প্রমাণিত হয়। বর্তমানে ফ্রিডমানের মহাবিশ্ব কসমোলজির সবচেয়ে পরিচিত, ব্যবহৃত ও গ্রহণযোগ্য মডেল।

জীবনের শেষ পর্যন্ত মেন্দেলিভ তাঁর পিরিয়ডিক তত্ত্বের বিকাশ ও উন্নতি অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৮৯০-এর দশকে তেজস্ক্রিয়তা এবং নিষ্ক্রিয় গ্যাসের আবিষ্কারে পর্যায় সারণি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়। ১৯০০ সালে হিলিয়াম, আর্গন ইত্যাদি নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো শূন্য গ্রুপ নামে এক নতুন গ্রুপে স্থাপন করার মধ্য দিয়ে সমস্যাটি সফলভাবে সমাধান করা হয়েছিল। পরবর্তী আবিষ্কারগুলো রেডিও অ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয় উপাদানের প্রাচুর্যকে পর্যায়ক্রমিক সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত করতে সাহায্য করেছে।

মেন্দেলিভ নিজে মনে করতেন, ফিজিক্যাল ব্যাখ্যার অনুপস্থিতি পিরিয়ডিক সূত্র এবং পিরিয়ডিক সিস্টেমের প্রধানতম ত্রুটি। কিন্তু যত দিন না পরমাণুর মডেল তৈরি হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত এটি অসম্ভব ছিল। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ‘পিরিয়ডিক সূত্রের ভবিষ্যৎ মোটেই হুমকির সম্মুখীন নয়, বরং ভবিষ্যতে এই সূত্র কাঠামোগতভাবে শুধু উন্নতই হবে।’

১৮৯০ সালে মেন্দেলিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন লঙ্ঘনের প্রতিবাদে সেন্ট পিটার্সবার্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান এবং নিজের সব শক্তি ব্যবহারিক গবেষণায় নিয়োজিত করেন। সেই ১৮৬০-এর দশকেই মেন্দেলিভ শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে শুরু করেন। তাই এই প্রতিভাকে কাজে লাগানোর জন্য সরকার তাঁকে প্রাথমিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর, বিশেষ করে কাস্টমস শুল্কের উন্নয়নের কাজে নিযুক্ত করে। মেন্দেলিভ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাশিয়ার কাস্টমস এবং শুল্ক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

১৮৯১ সালে নৌ মন্ত্রণালয় ধোঁয়াহীন বিস্ফোরক পাউডার উদ্ভাবনের দায়িত্ব মেন্দেলিভকে দেয়। ১৮৯২ সালে তিনি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কাজটি সম্পাদন করেন। ১৮৯৩ সালে সদ্য রূপান্তরিত মাপ ও ওজন চেম্বারের (chambers of weights and measures) প্রধান (ম্যানেজার) হিসেবে মেন্দেলিভকে নিযুক্ত করা হয়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেখানে তিনি মেট্রলজি (metrology) বা মাত্রাবিজ্ঞানের ওপর কাজের গবেষণাগুলোর সমন্বয় করেন। ১৮৯৯ সালে উরালের বিভিন্ন কারখানা ভ্রমণ করেন। সেখানকার শিল্পের ওপর একটি বিস্তৃত এবং অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ বই লেখেন। মাতৃভূমির সেবায় যে তিনটি প্রধান বিষয়ে মেন্দেলিভের কাজকর্ম বিস্তৃত ছিল, সেগুলো হলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, শিক্ষা ও অর্থনীতি।

এই ছিলেন দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিভ? লেভ আলেসান্দ্রভিচ চুগায়েভের ভাষায়, ‘মেন্দেলিভ একজন জিনিয়াস রসায়নবিদ, প্রথম শ্রেণির পদার্থবিদ; হাইড্রোডাইনামিকস, আবহাওয়া, ভূতত্ত্ব, রাসায়নিক প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখার ফলপ্রসূ গবেষক; রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি রাসায়নিক শিল্পের অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ; রাশিয়ান অর্থনীতির একজন বিশেষ চিন্তাবিদ।’ এ ছাড়া তিনি একজন মহান শিক্ষক। এই মহান বিজ্ঞানী মারা যান সেন্ট পিটার্সবার্গে ১৯০৭ সালের ২০ জানুয়ারি (নতুন পঞ্জিকা অনুযায়ী ২ ফেব্রুয়ারি)।

দিমিত্রি মেন্দেলিভ ছিলেন তাঁর সময়ের উল্লেখযোগ্য রসায়নবিদদের একজন। তাই তাঁর রসায়নে নোবেল পুরস্কার না পাওয়াটা অনেকের কাছেই রহস্য। কিন্তু একজন বিজ্ঞানী কখনোই কোনো পুরস্কারের (এমনকি নোবেল পুরস্কার) জন্য গবেষণা করেন না। বিজ্ঞানী সত্যের সন্ধানী। গবেষণার আনন্দই তাঁকে পথ চলতে সাহায্য করে। সত্যকে জানাই তাঁর জন্য আসল পুরস্কার।

তিনি হাতে গোনা বিজ্ঞানীদের একজন, যাঁর আবিষ্কার বা শিক্ষা বলতে গেলে অপরিবর্তনীয় রয়েছে। নিউটনের কথা ভাবুন। তাঁর অনেক আবিষ্কার আজ প্রশ্নের সম্মুখীন, অন্তত বস্তুর বেগ যখন আলোর বেগের সমতুল্য, তখন সেই তত্ত্ব কাজ করে না। তখন আমরা আইনস্টাইনের শরণাপন্ন হই। কসমোলজির সর্বশেষ আবিষ্কারগুলো আইনস্টাইনের সূত্রকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। সেদিক থেকে দেখলে মেন্দেলিভের পর্যায়ক্রমিক সারণি এখনো সাফল্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের সেবা করে যাচ্ছে। এখনো দুবনাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে নতুন নতুন কেমিক্যাল মৌলের সংশ্লেষণ হচ্ছে। ১০১ নম্বর রাসায়নিক মৌলটিকে তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে, যার নাম রাখা হয়েছে মেন্দেলিভিয়ান। অনেকের মতে, দিমিত্রি মেন্দেলিভ হলেন রসায়নের আইনস্টাইন।

দিমিত্রি মেন্দেলিভের মতো এমন বহুমুখী প্রতিভার এক বিশাল ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এত স্বল্প পরিসরে লেখা কঠিন। তারপরও যে দুটি কথা না বললেই নয়, তাঁর জীবনের লক্ষ্যই ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সত্যকে জানা এবং জন্মভূমি রাশিয়ার সার্বিক উন্নতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তিনি কখনোই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আপস করেননি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তিনি অধ্যাপকের পদ থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করতে পিছপা হননি। তিনি শুধু একজন বিশ্বমানের বিজ্ঞানীই নন, তিনি একজন সত্যিকারের মানুষও বটে। তাঁর জীবন থেকে তাই রসায়ন বা বিজ্ঞানের বাইরেও আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে।

লেখক: লিডিং রিসার্চ ফেলো, জয়েন্ট ইনস্টটিউট অব নিউক্লিয়ার রিসার্চ এবং সহযোগী

অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিকস, পিপল ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি অব রাশিয়া, মস্কো

সূত্র:

১. লেভ আলেক্সাদ্রোভিচ চুগায়েভ-দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিভজীবন এবং কর্ম। লেনিনগ্রাদ, কেমিকো-টেকনিক্যাল প্রকাশনী (১৯২৪) (রাশিয়ান)

২. সমসাময়িকদের স্মৃতিকথায় দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিভ। মস্কো, আতমিজদাত (১৯৭৩) (রাশিয়ান)

৩. দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিভ-জ্ঞানের সীমানা আগে থেকে দেখা অসম্ভব। মস্কো, সোভিয়েত রাশিয়া (১৯৯১) (রাশিয়ান)