নতুন কাঠের গাড়ি!

কাঠের বহুল ব্যবহার প্রতিনিয়তই আমাদের চোখে পড়ে। বাড়িঘর নির্মাণ থেকে শুরু করে ঘরের আসবাব, প্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্রাংশ কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। কাঠের পাশাপাশি ইট, বালু, সিমেন্ট, রডসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থের ব্যবহারও হচ্ছে। কাঠের কদর তবু কমেনি। প্রকৃতিতে সহজলভ্যতার জন্য কাঠের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এর চাহিদাও বেশি।

যন্ত্র প্রকৌশল ব্যবহার করে তৈরি করা অন্য সব পদার্থের শক্তি ও দৃঢ়তা বেশি হলেও এদের ওজনও বেশি হয়ে যায়। যেমন বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থ ও এদের সংকর। বেশি ওজন নিয়ন্ত্রণ করা শ্রমসাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। আবার বিভিন্ন ধরনের বায়োমেট্রিক কম্পোজিট তৈরির প্রক্রিয়া বেশ জটিল এবং প্লাস্টিক-জাতীয় বিভিন্ন পলিমারের ব্যবহার পরিবেশবান্ধবও নয়। সেই তুলনায় কাঠ সহজলভ্য, দামও বেশ কম। তবে শক্তি ও দৃঢ়তা অন্যান্য ধাতব বা কম্পোজিটের মতো নয়, বরং অনেক কম। কাঠ ব্যবহারের অন্য একটি সমস্যা হলো, আর্দ্র পরিবেশ থেকে বা পানির সংস্পর্শে এসে বেশি পরিমাণে পানি শোষণ করে এর আকারের পরিবর্তন করে ফেলে, তাই এর দ্বারা তৈরি করা যন্ত্রের গুণাগুণ অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। কাঠকে আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার জন্য এর শক্তি ও দৃঢ়তা কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সে বিষয়ে অনেক দিন ধরেই গবেষণা চলে আসছে। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের যন্ত্রবিশেষজ্ঞ লি টেং ও তাঁর দল এ বছরের শুরুতেই নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে কাঠের শক্তি প্রাকৃতিক কাঠের চেয়ে দশ গুণ বাড়াতে সমর্থ হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে নেচার সাময়িকীতে এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।

প্রাকৃতিক কাঠ মূলত অনেকগুলো সমান্তরাল লম্বাটে টিউব আকৃতির কোষের সমন্বয়ে গঠিত। সেলুলোজ (গ্লুকোজের পলিস্যাকারাইড) সমৃদ্ধ কোষপ্রাচীর এই কাঠকে দৃঢ়তা দেয়। এ ছাড়া কোষপ্রাচীরে রয়েছে লিগনিন নামে একধরনের বায়োপলিমার, যা কোষকে স্থিতিশীল করে এবং বাইরের কোনো প্যারাসাইট বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে কোষকে সুরক্ষা দেয়। আর হেমিসেলুলোজ, সেলুলোজ-ফাইব্রিলগুলোকে কোষপ্রাচীরের সঙ্গে বেঁধে রাখতে সাহায্য করে। লির দল কাঠের গঠনপ্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে তাদের কর্মযজ্ঞ শুরু করে। যেহেতু সেলুলোজই কাঠের দৃঢ়তার কারণ, তাই কোনোভাবে এর অন্য উপাদান সরিয়ে ফেলে কাঠকে সংকুচিত করে এর শক্তি বৃদ্ধি সম্ভব। এরই লক্ষ্যে সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত বিভিন্ন ধরনের কাঠকে (যেমন ওকগাছের কাঠ) সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ও সোডিয়াম সালফাইটের দ্রবণে নিয়ে সাত ঘণ্টা ধরে ফোটানো হয়।

এই প্রক্রিয়ার ফলে অধিকাংশ লিগনিন ও হেমিসেলুলোজ দ্রবণে দ্রবীভূত হয়, কিন্তু স্টার্চ-জাতীয় সেলুলোজ প্রায় অক্ষতই রয়ে যায়। দ্রবণ থেকে কাঠ পৃথক করে নিলে আরও ছিদ্রযুক্ত ফাঁপা আকৃতির দেখা যায়। এই ফাঁপা কাঠ নিয়ে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় চাপ প্রয়োগ করে এর তাপীয় সংকোচন করা হয়। ফলে এর অধিকাংশ ছিদ্র তখন দূর হয়ে যায় এবং এর ঘনত্ব শূন্য দশমিক ৪৩ গ্রাম বা ঘন সেন্টিমিটার থেকে বেড়ে ১ দশমিক ৩ গ্রাম বা ঘন সেন্টিমিটার হয়। এই নতুন স্থিতিশীল পদার্থের ঘনত্ব এতই বেশি যে এটি পানিতে ভাসে না এবং এর শক্তি ও দৃঢ়তা স্বাভাবিক কাঠের প্রায় ১১ গুণ বেশি।

গবেষণা দলের আরেক সদস্য হু লিয়াংবিং স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে দেখেন এই নতুন প্রক্রিয়ার ফলে সেলুলোজের টিউবগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইন্টারলক হয়ে যায়। সেলুলোজ ন্যানোফাইবারগুলো একমুখী হয়ে সারিবদ্ধভাবে অবস্থান করে এবং হাইড্রোজেন বন্ডিংয়ের ফলে এদের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়।

এই নতুন পদার্থের দৃঢ়তা পরিমাপের জন্য এই গবেষণা দল ব্যালিস্টিক এয়ারগান ব্যবহার করে একটি পরীক্ষা করে, সাধারণত মিলিটারি গাড়িগুলোর গতি পরিমাপের জন্য এই পরীক্ষা করা হয়। এই নতুন পদার্থের পাঁচটি লেয়ার একত্র করে প্রায় ৩ মিলিমিটারের মতো পুরু হয়। এই লেয়ার সেকেন্ডে ৩০ মিটার বেগে গতিশীল ৪৬ গ্রাম ওজনের স্টিল প্রক্ষেপককে থামাতে পারে। একটি বুলেট সেকেন্ডে প্রায় কয়েক হাজার মিটার বেগে গতিশীল। তার তুলনায় এই স্টিল প্রক্ষেপকের গতি অনেক কম, কিন্তু কোনো গাড়ি কোথাও সংঘর্ষের আগে প্রায় এমন গতিবেগই অর্জন করে থাকে। নতুন এই কাঠের ওজন সমান পরিমাণ স্বাভাবিক ধাতব পদার্থের চেয়ে কম, কিন্তু এর দৃঢ়তা সেই তুলনায় অনেক। এই বৈশিষ্ট্য জানার পর একে গাড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করা যায় কি না, তা নিয়েই এখন হিসাব চলছে।

যদি কাঠ দিয়ে গাড়ি তৈরি করা হয়, সে ক্ষেত্রে এর ওজন হবে স্বাভাবিক প্রচলিত গাড়ির চেয়ে অনেক কম, কিন্তু দৃঢ়তা কোনো অংশেই কম হবে না। এমনকি অনেক দ্রুতগতিতে চলমান অবস্থায় কোথাও সংঘর্ষ হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হবে, ব্যালিস্টিক এয়ারগান পরীক্ষা আমাদের তা-ই বলে!

লি এবং হু লিয়াংবিংয়ের দলের এই কাজ নিয়ে অবশ্য অনেক গবেষক প্রশ্ন তুলেছেনও। সাত ঘণ্টা কস্টিক দ্রবণে নিয়ে কাঠকে ফোটানো বেশ সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। ওরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক ফ্রেড ক্যামকে লিগনিনকে কাঠ থেকে আলাদা করার পরিবর্তে উচ্চ তাপমাত্রায় বাষ্প প্রয়োগ করে অথবা বিভিন্ন ধরনের রেসিন ব্যবহার করে এবং চাপ প্রয়োগ করে কাঠের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করেন। তাঁর এই কাঠের ২৪টি লেয়ার একত্র করে তিনি ৯ মিলিমিটার সাইজের পিস্তলের বুলেট থামাতে সমর্থ হন। এতে খরচও বেশ কম হয়।

লির দল অবশ্য লিগনিন দূর করেই কাঠকে আরও শক্তিশালী করার জন্য অন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এই জানুয়ারি মাসেই লির দল এই সিদ্ধান্তে এসেছে, সম্পূর্ণ লিগনিন দূর করে ফেলা কাঠের জন্য মোটেই লাভজনক নয়। কারণ অধিক লিগনিন বের করে ফেললে কম ঘনত্বের ভঙ্গুর কাঠ তৈরি হয়, তাদের ন্যানোফাইবারগুলোর মধ্যে ইন্টারলকিং হওয়ার আগেই ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাঠে উপস্থিত সেলুলোজ ন্যানোফাইবারের নিজেদের মধ্যকার হাইড্রোজেন বন্ধন কেমন হয়, তার ওপর নির্ভর করে কাঠের শক্তি বৃদ্ধি হয়, এ জন্য কাঠের মধ্যে প্রয়োজনীয় অনুপাতে লিগনিন থাকা দরকার। কারণ লিগনিন, সেলুলোজ ফাইবারগুলো বাইন্ড করতে সহায়তা করে।

পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ৪৫ শতাংশ লিগনিন সরিয়ে ফেলে এরপর তাপীয় সংকোচনের মাধ্যমে যে কাঠ তৈরি করা হয়, তার শক্তি ও দৃঢ়তা সবচেয়ে বেশি। কাঠকে এই যে নতুনরূপে পাওয়া গেল, একে কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা তো চলবেই। কাঠের এই ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যবহার আরও বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। কাঠের তৈরি বাড়ি তো অনেক দেখা হলো, এবারে হয়তো সহজলভ্য কাঠ থেকে স্বল্প খরচে নতুন গাড়ি শিগগিরই আমরা দেখতে পারব।

সূত্র: নেচার

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার মে ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়