পর্যায় সারণির শেষ কোথায়?

১৮৩৪ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার তবোলস্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন পর্যায় সারণীর জনক দিমিত্রি মেন্ডেলিভ । তিনি যেমন প্রাকৃতিক মৌলগুলোকে ধর্ম ও ভরের ভিত্তিতে একটি সারণীতে বিভিন্ন ঘরে জায়গা দিয়েছিলেন, তেমনি সারণীতে কিছু ফাঁকা ঘর রেখে ভভিষ্যদ্বাণী করেছিলেন অনেকগুলো অনাবিষ্কৃত মৌলের। সেগুলো একে একে আবিষ্কার হয়েছিল তাঁর দেখানো পথে হেঁটেই। রসায়ন বিজ্ঞানকে একটা মৌলিক কাঠামোতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল তাঁর এই সারণী। ১৯০৭ সালে আজকের দিনে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে মৃত্যুবরণ করেন মেন্ডেলিভ। প্রয়াণ দিবসে বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রইল। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদনা দলের সদস্য ইবরাহিম মুদ্দাসসের।

রাসায়নিক বিক্রিয়ার কথা মানুষ জানে হাজার হাজার বছর ধরে। এক পদার্থ বিক্রিয়া করে দিব্যি আরেক পদার্থ হয়ে যাচ্ছে। বাইরে লোহা ফেলে রাখলে জং পড়ে যাচ্ছে। আগুনে পুড়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে ছাই-কয়লা। কোনো এক গাছের কষ লেগে ঝলসে যাচ্ছে ত্বক। এসব দেখতে দেখতেই মানুষের মনে প্রশ্ন এসেছে, পদার্থ আসলে কেমন? প্রতিটা পদার্থই কি আলাদা, নাকি এক পদার্থ থেকে তৈরি হতে পারে আরেক পদার্থ? মূলে এমন কী আছে, যার পরিবর্তনে লোহাকে বদলে দিয়ে বানায় মরিচা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আড়াই হাজার বছর আগেই এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন তখনকার বিজ্ঞানী-দার্শনিকেরা।

অন্য সব জ্ঞানের মতো এখানেও বড় অংশজুড়ে আছেন অ্যারিস্টটল। তিনি একটা প্রশ্ন তুলেছিলেন, একটা স্বর্ণখণ্ডকে কতবার অর্ধেক করলে তার স্বর্ণসত্তা হারিয়ে যাবে? উত্তরটাও হাজির করেছিলেন তিনি। নিশ্চয়ই এমন একটা সীমা আছে, যার থেকে ছোট করতে গেলে স্বর্ণ আর স্বর্ণ থাকবে না। এই সীমার নাম দিয়েছেন ‘ন্যাচারাল মিনিমাম’। প্রতিটা পদার্থের একটা ন্যাচারাল মিনিমাম থাকবে, যার চেয়ে ছোট করতে গেলে একটা পদার্থ আর ওই পদার্থের গুণাবলি নিয়ে থাকবে না। এমন একটা মৌলিক অবস্থায় চলে যাবে, যা সব পদার্থের জন্য একই।

অ্যারিস্টটলের ধারণা হলো, সব পদার্থই আসলে একই জিনিস। এর সঙ্গে ‘ফর্ম’ বা অবস্থা জড়িত। ওই অবস্থার জন্য পদার্থ নানা রূপ নেয়। কখনো পানি, কখনো রুপা, আবার কখনো পাথর বা মাটি। মূল অবস্থাও খুব বেশি নয়, মাত্র চারটা। আগুন, পানি, বাতাস ও মাটি।

অ্যারিস্টটলের আগে দার্শনিক ডেমোক্রিটাস পদার্থের ক্ষুদ্রতম রূপ যে অ্যাটম বা পরমাণু, এমন একটা ধারণা দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, সব পদার্থই আলাদা, প্রতিটি পদার্থের জন্য একটা ক্ষুদ্রতম একক আছে, যা আর ভাঙা যায় না, ছোট করা যায় না। এবং সেটাই পরমাণু। কিন্তু অ্যারিস্টটলের ধারণার কাছে এই ধারণা টিকতে পারেনি। অবশ্য ডেমোক্রিটাসের ধারণা ঠিকও ছিল না। প্রতিটি পদার্থের পরমাণুই আলাদা, অর্থাৎ ভাতের পরমাণু খুব ছোট ভাতের টুকরো, এই ধারণা রাসায়নিক বিক্রিয়াসহ নানা প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যাতেই ঝামেলা তৈরি করে।

অ্যারিস্টটল যে ধারণার বাহক ছিলেন, সেটাও কিন্তু ঠিক তাঁরই মৌলিক চিন্তা নয়। তাঁরও শ দুয়েক বছর আগের অ্যাম্পেডোস্লেস থেকে ধার করেছিলেন এই আইডিয়া। এই ধারণাকে ব্যবহার করে পদার্থের যে মূল কথা, বা মৌলিকতা, তাকে একটা ছকে বাঁধতে চেয়েছেন অ্যারিস্টটল। যেকোনো পদার্থই আসলে ওই চার মৌলিক অবস্থার মিশ্রণ।

অ্যারিস্টটলের এই ধারণা টিকে থাকে অনেক অনেক বছর। যদিও কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করতে এই তত্ত্বে ঝামেলা বাঁধত। এক পদার্থ অন্য পদার্থে রূপান্তর হয় তার চার মৌলিক গুণাগুণে পরিবর্তন এলে। সে হিসাবে একটা প্রক্রিয়া আগের অবস্থায় আর ফিরে যাওয়ার কথা না। কিন্তু আলকেমিস্ট বা ধাতুর কাজ করা মানুষেরা খুব ভালোভাবেই জানতেন এমন অনেক প্রক্রিয়া আছে, যেখানে পদার্থের রূপ পরিবর্তন হলেও পরে সেই রূপে আবার ফিরে যাওয়া যায়।

আধুনিক ইউরোপে আসার আগে অ্যারিস্টটলের ধারণায় অনেক বেশি পরিবর্তন না এলেও নতুন একটা অংশ যুক্ত হয়। ধারণাটি প্রবর্তন করেন অষ্টম শতাব্দীর আরব বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান। তাঁর দেওয়া মূলনীতি ছিল দুটি। একটাকে ডাকা হতো মার্কারি বা পারদ নামে, আরেকটা সালফার। এই মার্কারি বা সালফার ঠিক আমাদের চেনা পারদ-সালফার নয়। মার্কারি প্রিন্সিপলটা হলো ‘ঠান্ডা’ ও ‘ভেজা’। অন্যদিকে সালফার হলো ‘গরম’ ও ‘শুকনো’। ইংরেজিতে cool-moist ও hot-dry। এই চারটা ধর্ম চার মৌলিক পদার্থের মাঝামাঝি নতুন একটা অবস্থানের নির্দেশ করে। এই সালফার-মার্কারি থিওরি অনুযায়ী এই চারটা ধর্মই তৈরি করে মূল সাতটা ধাতু—স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, টিন, লোহা, সিসা ‌ও পারদ।

দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে পদার্থের চারটি মূল অবস্থা
বিজ্ঞানচিন্তা

সালফার-মার্কারি থিওরির চার কোয়ালিটি নির্ধারণ করে দেয় কোন ধাতু কেমন হবে। যেমন লোহার গলনাঙ্ক অনেক বেশি, ঘষা খেলে স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়, তাই এতে নিশ্চয় সালফার অংশ অর্থাৎ গরম-শুকনা অংশ বেশি।

অ্যারিস্টটলের চার মৌল এবং জাবির ইবনে হাইয়ানের সালফার-মার্কারি—এ মিলেই তৈরি হয় বহুল প্রচলিত তালিকা। একটা বর্গাকৃতির চার কোণে চারটি মৌলিক পদার্থের এই তালিকাকেই বলা যায় প্রথম পর্যায় সারণি।

এই ধারণায় নতুনত্ব যোগ করেন ষষ্ঠদশ শতকে সুইস চিকিৎসা বিজ্ঞানী প্যারাসেলসাস। তিনি মার্কারি-সালফার থিওরিতে ‘সল্ট’ বা লবণ যোগ করে আরেকটু বিস্তৃত তত্ত্ব বানান। সালফার-মার্কারি-সল্টের এই তত্ত্ব অনুসারে জাবিরের মতো শুধু ধাতুই নয়, অন্য সব পদার্থও তৈরি হয় এসব ধর্ম দিয়েই। তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল ওষুধের ব্যাপারে।

সপ্তদশ শতকে পিয়েরে গ্যাসেন্দি আবার ডেমোক্রিটাসের অবিভাজ্য পরমাণুর ধারণা ফিরিয়ে আনেন। দে কার্তে প্রস্তাব করেন মেকানিক্যাল বা যান্ত্রিক বিশ্বের। মাঝখান দিয়ে রবার্ট বয়েল প্রমাণের চেষ্টা করেন, সল্ট বলে আসলে কিছু নেই। তিনিই প্রথম আলকেমি আর রসায়নের মধ্যে একটা রেখা টেনে দেন। এমনকি তাঁর ধারণাতেই তখন উঠে আসে পরমাণু-অণু-রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো কিছু ধারণার আভাস।

কিন্তু এর মধ্যেই জোসেফ প্রিস্টলি বাতাসের গ্যাসগুলোকে আলাদা করতে সক্ষম হন। ল্যাভয়সিয়ে ১৭৭৭ সালে ৩৩টা মৌলিক পদার্থের তালিকা প্রকাশ করেন। প্রথমবার আলাদা করেন ধাতু ও অধাতুর মধ্যে।

১৮০৩ সালে জন ডাল্টন প্রস্তাব করেন ‘ডাল্টন’স ল’। এরপরই আস্তে আস্তে মৌলিক পদার্থের সত্যিকার ধারণা মানুষ বুঝতে শুরু করে। মৌলিক পদার্থগুলোকে আলাদা করতে শুরু করে। এরপর যত দিন গিয়েছে, মৌলিক পদার্থের সংখ্যা বেড়েছে। তত দিনে যেহেতু মানুষ বুঝে গিয়েছে, মৌলিক পদার্থই সব পদার্থ তৈরির মূল। তাই বিজ্ঞানীরা চিন্তা করেছেন, মৌলিক পদার্থগুলোকে জব্দ করতে পারলেই মহাবিশ্বের সবকিছুকে জব্দ করা সম্ভব। ফলে তাঁরা চেষ্টা করেছেন, মৌলিক পদার্থগুলোকে একসঙ্গে করে একটা তালিকা করে কোনো একটা ছাঁচে ফেলতে। নানাজনের চেষ্টা শেষে বাজিমাত করেন মেন্ডেলিভ, ১৮৬৯ সালে। ৬৩ মৌলের তালিকা দিয়ে। তিনি তাঁর তালিকা সাজিয়েছিলেন পারমাণবিক ভরের ওপর ভিত্তি করে। কারণ, তত দিনে মানুষ জেনে গেছে, প্রতিটা মৌলের একটা নির্দিষ্ট পারমাণবিক ভর আছে।

পারমাণবিক ভর ধরে সাজাতে গিয়ে মেন্ডেলিভ সুন্দর একটা প্যাটার্ন বের করে ফেলেন। কতগুলো সারি-কলামে ভাগ করে ফেলা যায় মৌলগুলোকে, তাতে তার ধর্মও মিলে যায় বেশ। সারিগুলোকে নাম দেন পিরিয়ড, আর কলামগুলোকে গ্রুপ। পিরিয়ড আর গ্রুপ মিলে হয়ে আমাদের পর্যায় সারণি। মেন্ডেলিভ বাজিমাত করেন আসলে অজানা মৌলের ভবিষ্যদ্বাণী করে। তাঁর সারণিতে ফাঁকা রাখা জায়গায় যখন মৌলে খুঁজে পাওয়া যায়, তখন বিশ্বাস জন্মে, কিছু একটা নিশ্চয় আছে এই পর্যায় সারণির পেছনে। তখন মানুষ ভেবেছিল পারমাণবিক ভরই এই কারণ।

গোলটা বাধে ১৮৯৭ সালে। সে বছর জে জে থমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। এত দিন পরমাণুকে ধরা হয়েছিল অবিভাজ্য। অবিভাজ্য পরমাণুতে ইলেকট্রনের উপস্থিতি ঠিক স্বস্তিকর নয়। প্রথম দফায় ইলেকট্রনকে পদার্থের মধ্যে সুষমভাবে ছড়িয়ে দিয়ে পরমাণুর অবিভাজ্যতার ধারণা কিছুটা বাঁচানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাদারফোর্ডের স্বর্ণপাত আর আলফা কণার পরীক্ষা নিশ্চিত করে দেয়, পরমাণু কোনো অবিভাজ্য জিনিস না। পরমাণুরও একটা গঠন আছে। তারপর শুরু হয় নতুন ও অত্যাধুনিক রসায়নের এক যুগ। এর হাত ধরেই পদার্থবিজ্ঞানে আসে নতুন তত্ত্ব। কোয়ান্টাম তত্ত্ব, যা পদার্থবিজ্ঞানের আরও কিছু সমস্যার সমাধানে বেশ কার্যকর ভূমিকা দেখায়। বিজ্ঞনী নিলস বোর, সামারফেল্ডরা আরেকটু এগিয়ে নেন পরমাণুর গঠন। আর পরমাণুর গঠন বুঝতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেন, ইলেকট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে কীভাবে স্তরে স্তরে অবস্থান করে। ওই স্তরগুলো মেলাতে গিয়ে দেখা যায়, পর্যায় সারণিতে এক গ্রুপের মৌলগুলো যে প্রায় একই ধর্ম দেখায়। তার মূলে আছে ওই পরমাণুর চারপাশে থাকা ইলেকট্রন বিন্যাস।

প্রথমে পর্যায় সারণি সাজানো হয়েছিল পারমাণবিক ভর অনুসারে। তখন তো মৌলের গঠন সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না, তাই ধারণা ছিল না আইসোটোপ সম্পর্কেও। আইসোটোপের উপস্থিতির কারণে বেশ কয়েকটি মৌলিক পদার্থের ভর–সংক্রান্ত একটা ঝামেলা ছিল। বেশি পারমাণবিক ভরের একাধিক মৌলকে অবস্থান দিতে হয়েছিল কম ভরের মৌলের আগে। সে সমস্যাও মিটে যায় যখন পারমাণবিক সংখ্যা আবিষ্কার হয়। পারমাণবিক সংখ্যা হলো কোনো একটা পরমাণুতে থাকা প্রোটনের সংখ্যা। আর এই প্রোটনসংখ্যাই একটা পরমাণু কী পদার্থ হবে, তার ভিত্তি।

একটা পরমাণুতে থাকে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন। প্রোটন আর নিউট্রন থাকে পরমাণুর মাঝে, যাকে বলে নিউক্লিয়াস। ইলেকট্রনগুলো থাকে বাইরে, চারপাশে কতগুলো কোয়ান্টাম অরবিটালে। একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কতগুলো প্রোটন আছে তা-ই ঠিক করে দেয় ওইটা কিসের পরমাণু। যেমন ১১টা প্রোটন থাকলে সেটা সোডিয়াম, ১২টা প্রোটন থাকলে ম্যাগনেসিয়াম। তেমনিভাবে ১১৮টা প্রোটন থাকলে অগানেসন।

প্রোটনের সঙ্গে নিউক্লিয়াসে থাকে নিউট্রন। নিউট্রনসংখ্যা সাধারণত প্রোটনের কাছাকাছি হয়। তবে একদম নির্ধারিত নয়। যেমন কার্বনের কথাই ধরা যাক, সাধারণভাবে নিউট্রন থাকে ৬টা। কিন্তু ৮টা নিউট্রন থাকা এমন কোনো বিরল ঘটনা না। নিউট্রন দুটি বেশি থাকলে পরমাণুর ভর একটু বেশি হয়। কিন্তু রাসায়নিক ধর্মে কোনো পার্থক্য হয় না।

এরপর আসে ইলেকট্রন। একটা সাধারণ পরমাণুতে যতগুলো প্রোটন থাকে, ইলেকট্রনও থাকে ঠিক ততটা। ইলেকট্রন যেহেতু নিউক্লিয়াসের বাইরে থাকে, মাঝেমধ্যে একটা–দুইটা ছুটে যেতে পারে বা একটা–দুইটা বাড়তিও হতে পারে। এই অবস্থাই হলো আয়নিত অবস্থা বা চার্জিত অবস্থা। ইলেকট্রন নিয়ে বা দিয়ে একটা পরমাণু খুব সহজেই ফিরে যেতে পারে তার আগের অবস্থায়।

দেখা যাচ্ছে, পারমাণবিক সংখ্যা বা প্রোটনসংখ্যাই একটা পরমাণুর সবচেয়ে মৌলিক ব্যাপার, ধ্রুব ব্যাপার। সে হিসাবে পরমাণুর তালিকা এক-দুই-তিন করে পারমাণবিক সংখ্যা হিসেবে সাজিয়ে নিলেই হয়। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। তালিকা ধরে মুখস্থ করা ছাড়া অন্য কোনো কাজেই আসবে না। এখানেই বাহাদুরি মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণির। তার পর্যায় সারণি ভর অনুসারে সাজালেও সারি কলামে ভাগ করা হয়েছিল মৌলগুলোর ধর্ম ধরে। মৌলগুলোর ধর্মের সামঞ্জস্য রাখতে নিজের বানানো ভর অনুযায়ী সাজানোর সূত্র একাধিক জায়গায় ভেঙেছেন নিজেই। পারমাণবিক সংখ্যাও ধর্মের সামঞ্জস্য বিষয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। শেষমেশ ব্যাখ্যা দেয় আসলে ইলেকট্রন বিন্যাস। যত দিন গিয়েছে, কোয়ান্টাম মেকানিকসের উন্নতি ঘটেছে, বিজ্ঞানীরা ইলেকট্রন বিন্যাস তত ভালো বুঝেছেন। পর্যায় সারণির তালিকার রহস্য ততই উন্মোচিত হয়েছে।

এবার একটু অন্যদিক দেখা যাক। মেন্ডেলিভ আরও পরিমার্জিত যে পর্যায় সারণিটি দিয়েছিলেন ১৮৭১ সালে, সেখানে সবচেয়ে ভারী মৌল ছিল ইউরেনিয়াম। প্রোটনসংখ্যা ৯২। অথচ মাঝের অনেকগুলো প্রোটনসংখ্যার মৌল নেই। তাহলে সেগুলো কোথায়? ওগুলোই পরবর্তী সময়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে।

খুঁজতে গিয়ে প্রকৃতিতে অনেকগুলোই পাওয়া গেছে। কিন্তু পাওয়া যায়নি টেকনিশিয়াম। ৪৩ পারমাণবিক সংখ্যার এই মৌলের অর্ধায়ু খুব কম। তাই শত কোটি বছরের পৃথিবীতে পৃথিবী গঠনের সময় উৎপন্ন হয়ে থাকলেও এত দিনে সবটাই ভেঙে অন্য কোনো পদার্থ হয়ে গেছে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ করে। শেষমেশ ১৯৩৭ সালে ল্যাবে বানানো গিয়েছে এই মৌল।

ল্যাবে টেকনিশিয়াম বানানোর পর বিজ্ঞানীরা অন্য না পাওয়া মৌলগুলো খুঁজেছেন গবেষণাগারে। ইউরেনিয়াম পর্যন্ত বাকি সবগুলোও তাঁরা বানিয়েছেন ল্যাবেই। এখন সাধারণ ঔৎসুক্য থেকেই প্রশ্ন আসে, প্রকৃতিতে অনেকগুলো মৌলই পাওয়া যায়। টেকনিশিয়াম বাদে ৯২ পর্যন্ত বেশ আছে। খুব অল্প পরিমাণে ৯৩ ও ৯৪-ও পাওয়া যায়। তাহলে পরের মৌলগুলো কি ল্যাবে বানানো যাবে? বিজ্ঞানীরা এ প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন। পরের মৌলগুলোও বানানো যায়। তাঁরা বানিয়েছেনও। প্রকৃতিতে কোথাও পাওয়া যায় না এমন ২৪টি মৌল ল্যাবরেটরিতে বানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

পর্যায় সারণি যদি দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে এখন সর্বশেষ মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ১১৮। নাম, অগানেসন। এই ১১৮টা মৌলই মানুষ কোনো না কোনো সময় পর্যবেক্ষণ করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, ল্যাবরেটরিতে ১১৯ বা পরের মৌলগুলো বানানো যাবে?

পর্যায় সারণিতে পর্যায় বা সারি আছে ৭টা। ১১৮ নম্বর মৌল আবিষ্কারের পর ৭টা পর্যায়ই পূর্ণ হয়ে গেছে। এর পরের মৌল, মানে ১১৯ বা পরের কোনো মৌল আবিষ্কার হলে তার অবস্থান হবে অষ্টম পর্যায়ে। মজার ব্যাপার হলো, শুরু থেকেই বর্তমান রূপের পর্যায় সারণির পর্যায় ছিল ৭টা। তাই অষ্টম পর্যায় একটা বড় ঘটনাই হবে পর্যায় সারণির জন্য। যদি ইলেকট্রন বিন্যাস দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে, ১১৯ নম্বর মৌল পাওয়া সহজ হওয়ার কথা নয়। নতুন পর্যায় শুরু করাও কঠিন হবে।

তারপরও সহজ একটি রেসিপি কিন্তু আছে ১১৯ নম্বর মৌল বানানোর। এ জন্য প্রথমে লাগবে বার্কেলিয়াম। বার্কেলিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ৯৭। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়, খুবই তেজস্ক্রিয় মৌল। কয়েক মিলিগ্রাম বার্কেলিয়াম নিয়ে তার ওপর আলোর বেগের এক–দশমাংশ বেগে টাইটেনিয়াম আয়ন ছুড়তে হবে। এভাবে যদি টানা এক বছর টাইটেনিয়াম আয়ন ছোড়া হয়, ১০১৮ টা টাইটেনিয়াম আয়নের আঘাতে একটা ১১৯ পারমাণবিক সংখ্যার পরমাণু উৎপন্ন হতে পারে। এই উৎপাদন বছরের যেকোনো মুহূর্তে হবে, তাই পুরো বছরই নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, কারণ এটা বলা কঠিন যে ১১৯ মৌল কতক্ষণ স্থায়ী হবে। আগের মৌলগুলোর অভিজ্ঞতা বলে মিলি সেকেন্ডের ভগ্নাংশ স্থায়ী হবে, তারপর একটা আলফা আর একটা গামা কণা উৎপন্ন করবে, যা গিয়ে আঘাত করবে চারপাশে রাখা সিলিকন ডিটেক্টরে, ধরা পড়বে প্রথম ১১৯ নম্বর মৌল। শুধু পৃথিবীর নয়, সম্ভবত মহাবিশ্বেরই প্রথম হবে, যদি না কোনো এলিয়েন আগেই বানিয়ে থাকে।

বোঝাই যাচ্ছে, ১১৯-কে খুঁজে পাওয়া সহজ কোনো কাজ হবে না। জার্মানির বিজ্ঞানীরা ২০১২ সালে কয়েক মাস এই পদ্ধতিতে চেষ্টা করেছেন। রাশিয়া আর জাপানের বিজ্ঞানীরাও চেষ্টা করেছেন ১২০-কে খুঁজতে। এখন পর্যন্ত কেউ পারেননি ১১৯ বা ১২০ উৎপাদন করতে।

মেন্ডেলিভ ১৮৬৯-এ পর্যায় সারণি প্রকাশ করার পর থেকে প্রতি দুই থেকে তিন বছরে গড়ে একটা করে মৌল যোগ হয়েছে পর্যায় সারণিতে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, একটা স্থবিরতা এসেছে নতুন মৌল খুঁজে পেতে। শেষ নতুন মৌল শনাক্ত হয়েছিল ২০১০ সালে, নাম টেনেসাইন, পারমাণবিক সংখ্যা ১১৭। শুধু স্থবিরতাই নয়, ১১৯ বা ১২০ হয়তো পাওয়া যাবে। অনেক ধৈর্যশীল, আধুনিক কোনো গবেষণাগারে। কিন্তু এর পরের মৌল, অর্থাৎ ১২১ বা আরও বেশি পারমাণবিক সংখ্যার মৌল আমাদের বর্তমান জানা প্রযুক্তিতে পাওয়া সম্ভব না বলেই মনে করছেন বেশির ভাগ বিজ্ঞানী। এ জন্য দরকার হবে নতুন ধরনের কোনো প্রযুক্তি।

ফলাফল? বিজ্ঞানীরা তো আর বসে থাকতে পারেন না। অন্য কোনো কাজ করতে হবে। তাই যাঁরা কৃত্রিম মৌল নিয়ে কাজ করতেন, তাঁরা এখন তাঁদের টার্গেট পরিবর্তন করছেন কিছুটা। নতুন মৌল না খুঁজে তাঁরা চেষ্টা করছেন ইতিমধ্যে বানানো মৌলগুলোর ধর্ম সম্পর্কে কিছু জানা যায় কি না।

তাই অনেকগুলো কৃত্রিম মৌল আবিষ্কার করা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই নতুন মৌল খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছে। ১১৮তম মৌল যার নামে, ইউরি অগানেসিয়ান, তিনি এখনো নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাশিয়ার জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ। তিনি জানিয়েছেন, নতুন একটা মৌল খুঁজে পাওয়া কঠিন বলে তাঁরা এখন আরও ভারী একটা পরমাণু বানানোর চেয়ে এর মধ্যে আবিষ্কৃত পরমাণুগুলোর ধর্ম নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আরও ভারী একটা মৌল খুঁজে পাওয়াকে আমি অসম্ভব বলছি না, কিন্তু বর্তমানে আমি এর কোনো উপায় জানি না।’

পর্যায় সারণিতে একটা মৌল কোনো একটা গ্রুপে আছে, মানে সে ওই গ্রুপের অন্য মৌলগুলোর সঙ্গে ধর্মে একটা সামঞ্জস্য রাখে। কিন্তু অতি ভারী পরমাণুগুলো, মোটামুটি ১০০-এর বেশি পারমাণবিক সংখ্যার মৌলগুলো আসলেই এই ধর্মের সাদৃশ্যতা দেখাবে কি না, নিশ্চিত করে এখনো বিজ্ঞানীরা জানেন না। যেমন ১১৮তম মৌলটি (অগানেসন) আছে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের সঙ্গে একই গ্রুপে। নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এরা সহজে অন্য মৌলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না। সাধারণ অবস্থায় এরা গ্যাস। এখন অগানেসনও কি গ্যাসই হবে? এই মৌলও কি অন্য মৌলের সঙ্গে সহজে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যাবে না? গত বছর প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রের হিসাব অনুযায়ী, অগানেসন অন্য নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মতো হওয়ার কথা নয়।

তাই প্রশ্ন উঠেছে, কোনো একটা মৌলের পর থেকে পর্যায় সারণির যে ধর্মের সাদৃশ্যতার বৈশিষ্ট্য, তা কি শেষ হয়ে যাবে? রসায়নবিদদের একদলের মত হলো, একটা সময় গিয়ে ধর্মের সাদৃশ্যতা শেষ হয়েই যাবে। কারণ ইলেকট্রন সংখ্যা যখন অনেক বেড়ে যাচ্ছে, অরবিটালে ইলেকট্রনের শক্তির পার্থক্য অনেক কমে যাবে। তাই অনেক ভারী মৌলের রাসায়নিক ধর্মে সাদৃশ্যতা আগের মতো বজায় থাকবে না।

আপেক্ষিকতা–সংক্রান্ত সমস্যারও উদ্ভব হতে পারে। খুব ভারী মৌলে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব কাজ করবে ইলেকট্রনের গতি অনেক বেশি হওয়ায়। তাই দেখা যাবে ধর্মে আরও বেশি পার্থক্য হচ্ছে।

আরেকটা সমস্যা হলো, একটা মৌলের স্থায়িত্ব। এখন একটা মৌলকে স্বীকৃতি পেতে বানানোর পরে মাত্র ১০-১৪ সেকেন্ড থাকলেই হয়। কিন্তু এত অল্প সময়ে ওই মৌলের ধর্ম সম্পর্কে খুব সামান্যই ধারণা পাওয়া যায়। ১০০-এর বেশি পারমাণবিক সংখ্যার মৌলগুলোর বেশির ভাগই চোখের পলকে বিকিরণ করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের একটা আশা, হয়তো এমন কোনো আইসোটোপ বানানো যাবে, এমন কোনো পদ্ধতি পাওয়া যাবে, যাতে ল্যাবে বানানো মৌলের স্থায়িত্ব একটু বাড়ানো যায়। এ জন্য চলছে আরেকাংশের গবেষণা।

সাধারণভাবে প্রোটন নিউট্রনের অনুপাতের একটা ভূমিকা আছে পরমাণুর স্থায়িত্বে। ফ্লেরোভিয়াম-২৯৮, যার প্রোটন ১১৪ ও নিউট্রন ১৮৪টা, ধারণা করা হয়, এই আইসোটোপ কিছুটা স্থায়ী হবে। আসলেই স্থায়ী হবে কি না, হলে অন্য পরমাণুগুলোর জন্যও এমন স্থায়ী আইসোটোপ বানানো যায় কি না, তা নিয়েই এই দলের বিজ্ঞানীদের গবেষণা।

সব মিলিয়ে রসায়নবিদেরা সবাই একমত যে পর্যায় সারণিতে একসময় ‘শেষ’ আসবে। তারপর নতুন কোনো মৌল পাওয়া যাবে না। এর পেছনে যুক্তি হলো, অনেক বেশি ইলেকট্রন যখন একটা নিউক্লিয়াসের চারপাশে থাকবে, একটা সময় দেখা যাবে, ইলেকট্রনগুলো আর ওই নিউক্লিয়াসের আকর্ষণে বাধা থাকছে না। তখন আসলে ওই মৌলের আর অস্তিত্বই থাকবে না।

এ ব্যাপারে রিচার্ড ফাইনম্যানের হিসাব হলো, ১৩৭ নম্বর মৌল হলো সেই মৌল, যার পরে আর নিরপেক্ষ মৌল সম্ভব না ইলেকট্রনের সংখ্যাধিক্যের কারণে। তাঁর হিসাব, এই মৌলের পরে আর মৌল যোগ হবে না পর্যায় সারণিতে। তাঁর হিসাব ছিল রিলেটিভিস্টিক ডিরাক সমীকরণ ব্যবহার করে। কিন্তু পরে কোয়ান্টাম ইলেকট্রডাইনামিকস ব্যবহার করে দেখা গেছে, এই সংখ্যাটা হবে ১৭৩। এই হিসাব আরও বেশি নিখুঁত। অনেকের ধারণা, ১৩৭ নম্বর পরমাণুই হলো পর্যায় সারণির সর্বোচ্চ সীমা।

তবে সব হিসাব বলে, ১১৯ আর ১২০ নম্বর মৌল পাওয়া সম্ভব। তাই এখন সবার অপেক্ষা পর্যায় সারণির ওই দুই সদস্যকে খুঁজে পেতেই। আমাদের জীবদ্দশাতেই আমরা অনেকগুলো মৌল পর্যায় সারণিতে যুক্ত হতে দেখেছি। হয়তো এই দুটোও দেখতে পারব অচিরেই। কে জানে, আরও অনেকগুলো পরমাণুকে হয়তো আমরা যুক্ত হতে দেখতে পারব!

সূত্র: নেচার, আইইউপিএসি, উইকিপিডিয়া

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিং, যুক্তরাষ্ট্র