পিরামিডের মমিও কি সর্দিতে ভুগেছিল?

মিসরের পিরামিডের ভেতর প্রাণ ছিল, অর্থাৎ ফারাও সম্রাটরা যখন জীবিত ছিলেন, তখন তাঁরাও সর্দির হাত থেকে রেহাই পাননি। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ সালে মিসরে রচিত হয়েছিল এক প্রাচীন চিকিৎসাগ্রন্থ, নাম এবারস প্যাপিরাস। ভেষজ ও লোকজ চিকিৎসার বর্ণনায় ঠাসা বইটি। জার্মান ঔপন্যাসিক ও প্রাচীন মিসর গবেষক জেওর্গ এবারস এ চিকিৎসা দলিল কিনে নেন। তাঁর নামানুসারেই এ প্রাচীন চিকিৎসা দলিলের নামকরণ হয় এবারস প্যাপিরাস। এবারস প্যাপিরাস–এ উল্লেখ আছে, সর্দির উপসর্গ ও চিকিৎসার কথা। সেটা নাকি চালু ছিল মিসরে প্রথম মমি বানানোর প্রায় এক হাজার বছর আগে থেকেই। ফলে প্রশ্ন জাগে, পিরামিডের মমির সেই ফারাও সম্রাটরাও কি সর্দিতে ভুগেছিলেন তাহলে? সে সম্ভাবনাই এখন জোরদার হচ্ছে।

সর্দিকে কতভাবেই ডাকা হয়। সর্দি–জ্বর, সর্দি–কাশি, ঠান্ডা–জ্বর—এ রকম নামেই পরিচিত এই রোগ। ঠান্ডা লাগাও বলা হয় একে। কারণ, ঠান্ডা আবহাওয়ার প্রভাবে শরীরে যে উপসর্গ দেখা দেয়, তার সঙ্গে সর্দির মিল আছে বলেই এর এমন নাম। ইংরেজিতে সর্দিকে ডাকা হয় কমন কোল্ড ডিজিস নামে। সর্দি হলে নাকের ভেতরের মিউকাস মেমব্রেন নামক ঝিল্লিতে প্রদাহ হয়। নাক থেকে পানি ঝরে, নাক বন্ধ হয়ে আসে, শুরু হয় হাঁচি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, এ সমস্যাকে বলা হয় রাইনাইটিস। সর্দির উপসর্গগুলো হলো হাঁচি, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক থেকে পানি পড়া, শুকনো বা শ্লেষ্মাযুক্ত কাশি, গলাব্যথা, হালকা জ্বর, হালকা মাথাব্যথা, শরীরব্যথা ইত্যাদি।

সর্দির প্রমাণ মেলে ১৬০০ শতাব্দীরও আগে। কিন্তু এ রোগের কারণ ১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত কারোরই জানা ছিল না। কেন ঘটে এ সর্দি? কারণ রয়েছে বেশ কয়েকটি। নাক, গলা এমন ঊর্ধ্ব শ্বাসতন্ত্রে ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে হয় সর্দি বা কমন কোল্ড। সর্দির জন্য মূলত দায়ী রাইনো ভাইরাস। তবে করোনা ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসেও হতে পারে সর্দি।

ইরিট্যান্ট বা জ্বালাতনকারী উপাদানের কারণেও হয় সর্দি। অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী উপাদান অর্থাৎ অ্যালার্জেনের প্রভাবেও সর্দি হতে পারে। এটা অ্যালার্জিজনিত সর্দি নামে পরিচিত। সর্দির মধ্যে অ্যালার্জিজনিত সর্দির প্রকোপই সবচেয়ে বেশি।

নানান পদের অ্যালার্জেন রয়েছে আমাদের চারপাশেই। এর মধ্যে বায়ুবাহিত অ্যালার্জেনগুলো সর্দিতে বেশি অবদান রাখে। বায়ুবাহিত অ্যালার্জেনের মধ্যে রয়েছে ধুলাবালু, ফুলের পরাগরেণু, প্রাণীর লোম, পাখির পালক ইত্যাদি। অ্যালার্জিজনিত সর্দি বেশ বাজে। নাক চুলকানো, হাঁচি, কাশি, মাথাব্যথা, গা ম্যাজম্যাজ করা, ক্লান্তি লাগা—এসব বিরক্তিকর সমস্যা দেখা দেয় অ্যালার্জিজনিত সর্দিতে। এখানেই শেষ নয়, অ্যালার্জেনগুলোর প্রভাবে চোখ হয়ে যেতে পারে লাল, চোখ থেকে পানি পড়তে পারে, চুলকাতে পারে চোখ, এমনকি চোখের চারপাশ ফুলে যেতে পারে।

অ্যালার্জেনের কারণে কী এমন ঘটে, যা আমাদের নাক ও চোখের পানি একীভূত করে ফেলতে বাধ্য করে? শরীরে রয়েছে ‘মাস্ট সেল’ নামে দানাদার কোষ, যা আসলে একধরনের শ্বেতরক্তকণিকা, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘গ্রানিউলোসাইট’। ‘মাস্ট সেল’–এ নানান উপাদানের মধ্যে ‘হিস্টামিন’ রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। শরীরে নানান শারীরবৃত্তীয় কাজ করে এই ‘হিস্টামিন’, এ কাজগুলোর মধ্যে চুলকানি সৃষ্টি করাও একটি। নাকে যখন কোনো অ্যালার্জেন বা অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী উপাদান প্রবেশ করে, তখন নাকের ভেতরের মাস্ট সেলের দানাগুলো ভেঙে যায়, মাস্ট সেল থেকে বেরিয়ে আসে ‘হিস্টামিন’ এবং অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান। নাকের ভেতর শুরু হয় প্রদাহ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘রাইনাইটিস’, দেখা দেয় সর্দি।

অ্যালার্জির সঙ্গে সম্পর্কহীন যে সর্দি, তাকে বলা হয় ‘নন-অ্যালার্জিক সর্দি’ বা ‘নন-অ্যালার্জিক রাইনাইটিস’। ‘ভেসোমটর রাইনাইটিস’ নামেও ডাকা হয় তাকে। কেন হয় নন-অ্যালার্জিক সর্দি? এটি হতে পারে নানা কারণে, যেমন হরমোনের প্রভাবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশাগত কারণে, হতে পারে কিছু কিছু ওষুধের প্রভাবে, এমনকি অজানা কারণেও হতে পারে নন-অ্যালার্জিক সর্দি।

যাঁরা অ্যালার্জিজনিত সর্দিতে ভুগছেন, একই সময়ে তাঁরা নন-অ্যালার্জিক সর্দিতেও ভুগতে পারেন। এ–জাতীয় সর্দিকে বলা হয় ‘মিক্সড রাইনাইটিস’ বা মিশ্র সর্দি।

দীর্ঘদিন ধরে নাকে ডিকনজেস্টেন্ট বা শ্লেষ্মা জমাটরোধী ওষুধ, যেমন অক্সিমেটাজোলিন, জাইলোমেটাজোলিন, নাফাজোলিন, ফেনাইলএফিড্রিন ইতাদির স্প্রে ব্যবহারে নাকের ভেতরে রক্তনালি সংকুচিত হয়ে সর্দির কারণ ঘটাতে পারে। সর্দি যদিও প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়, কারও কারও ক্ষেত্রে সর্দি হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি। এর জন্য বিভিন্ন কারণ রয়েছে। নাকের ভেতরের শ্লেষ্মা ঝিল্লি বা মিউকাস মেমব্রেন দীর্ঘকাল ধরে শুষ্ক হয়ে গেলে, নাকের শ্লেষ্মা ঝিল্লি ও গ্রন্থিতে অ্যাট্রফি নামক সমস্যা দেখা দিলে, নাকের ভেতর পলিপ বা মাংসের বৃদ্ধি ঘটলেও হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি সর্দি।

সর্দি সংক্রমিত হতে পারে। সংক্রমিত সর্দির জন্য দায়ী কোনো কোনো ভাইরাস, যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, এডেনো ভাইরাস, রুবেলা ভাইরাস। কোনো কোনো ব্যাকটেরিয়া সর্দির জন্য দায়ী। যেমন স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, ব্যাসিলাস অ্যান্থ্রাসিস, ডিপথেরিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি।

সর্দি হলে নাক থেকে শ্লেষ্মা কেন ঝরে? সর্দি হলে নাকের ভেতরে আবরণী কোষ বা অ্যাপিথেলিয়াল কোষের রূপান্তর বা ট্রান্সফরমেশন দেখা দেয়। এ রূপান্তর প্রক্রিয়ায় নাকের ভেতরের শ্লেষ্মা ঝিল্লি বা মিউকাস মেমব্রেনের সিলিয়েটেড কলামনার অ্যাপিথেলিয়াল কোষ রূপান্তরিত হয়ে গবলিট কোষ নামক ‘সিম্পল কলামনার অ্যাপিথেলিয়াল কোষে পরিণত হয়। ইংরেজি গবলিট শব্দের অর্থ হাতলবিহীন পানপাত্র। এ কোষগুলোকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে গবলিট বা পানপাত্রের মতো দেখা যায় বলে এর এমন নামকরণ। সর্দি হলে নাক থেকে শ্লেষ্মা ঝরার জন্য দায়ী এই গবলিট কোষ। সর্দিতে নাকের ভেতরের গবলিট কোষ থেকে অতিমাত্রায় মিউসিন নামক পিচ্ছিল তরল নিঃসরিত হয়। এটাই আসলে নাক থেকে শ্লেষ্মা ঝরার কারণ। অবশ্য হাঁপানি ও ক্যানসার রোগের ক্ষেত্রেও অনুরূপ শ্লেষ্মা নিঃসরণ করে গবলিট কোষগুলো।

সর্দির জন্য দায়ী কারণটি নির্ণয়ের ওপর নির্ভর করবে এর চিকিৎসার ধরন। অ্যালার্জিজনিত সর্দির জন্য নাসারন্ধ্রপথে কর্টিকোস্টেরয়েড নামের ওষুধ প্রয়োগ করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। গুরুতর ক্ষেত্রে অ্যান্টিহিস্টামিন–জাতীয় ওষুধও নাকে প্রয়োগের কথা বলা হয়। সংক্রমিত সর্দির জন্য দায়ী ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে নেওয়া যায় ভ্যাকসিন।

সর্দি নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা চলেছিল যুগ যুগ ধরে। এখনো চলছে। যুক্তরাজ্যের মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল সর্দি নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে অনেক বছর। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৪৬ সালে কমন কোল্ড ইউনিট গড়ে তোলে। এখানেই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন সর্দির জন্য দায়ী রাইনো ভাইরাস নামের জীবাণু। কমন কোল্ড ইউনিটের বিজ্ঞানীরা আরও আবিষ্কার করেন, রাইনো ভাইরাস সংক্রমণে এ ভাইরাসের ইনকুবেশন ফেসের সময় রোগীকে ইন্টারফেরন ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে। এটা রোগীকে সর্দির হাত থেকে বাঁচাতে কিছুটা সহায়তা করতে পারে। রাইনো ভাইরাসজনিত সর্দি প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় জিংক গ্লুকোনেট লজেন্স নিয়েও গবেষণা করেছিল এ প্রতিষ্ঠান। যদিও জিংক গ্লুকোনেট লজেন্স সর্দির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। তবে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, সর্দিতে জিংক গ্লুকোনেটের পরিবর্তে বরং জিংক অ্যাসিটেট লজেন্সের কার্যকারিতাই বেশি। সর্দির চিকিৎসায় নাসারন্ধ্র পথে জিংক প্রয়োগের পদ্ধতিও আছে। তবে দুঃসংবাদ হলো, নাসারন্ধ্র পথে জিংক প্রয়োগ করতে গিয়ে ঘ্রাণশক্তি হারানোর ঘটনা ঘটেছে কারও কারও ক্ষেত্রে।

সর্দির চিকিৎসায় ভাইরাসবিরোধী ওষুধ বা অ্যান্টিভাইরাল নিয়ে গবেষণা কিন্তু থেমে নেই। নিকট অতীতে ড্রাকো (double-stranded RNA activated caspase oligomerizer, DRACO) নামে পরীক্ষামূলক অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নিয়ে গবেষণা শেষ করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা রাইনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে এর প্রাথমিক কার্যকারিতার প্রমাণ পেয়েছেন। সর্দি সারাতে মানুষের ওপর এ ওষুধের সফল প্রয়োগের খবর পাওয়ার জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি।

লেখক: ডেন্টাল স্পেশালিস্ট, তায়েফ ডেন্টাল হাসপাতাল, সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত