প্রসাধনের রসায়ন

কসমেটিকস শব্দটির আড়ালে লুকিয়ে আছে শিল্পকলা ও বিজ্ঞান। কসমেটিকস শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘কসমস’ থেকে! মানুষের চেহারার সৌন্দর্যের জন্য প্রস্তুত করা কসমেটিকস কিছু রাসায়নিক পদার্থের সংমিশ্রণ, যাকে শৈল্পিক দিক থেকে কসমসেরই উত্তরাধিকার বলা চলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কসমেটিকসে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থের শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক ভিত্তির দিকে কড়া নজরদারি চোখে পড়ার মতোই বেড়ে চলেছে। ইতিহাসে বিজ্ঞানের উপস্থিতি অদৃশ্য, পর্দার আড়ালে। প্রাচীন সুমেরীয় নর-নারীরা রূপসজ্জার জন্য প্রথম জেমস্টোন গুঁড়ো করে লিপস্টিক হিসেবে ব্যবহার করত। সেই রেশ ধরেই আজ বিজ্ঞানীরা সাহস করছেন, এসব কসমেটিকসের ভেতর লুকিয়ে থাকা অজস্র রাসায়নিক পদার্থের ঠিক-বেঠিক নির্ণয় করতে!

ম্যাটিফাইং মেকআপ

(কম চকচকে ও কম তৈলাক্ত মেকআপ)

এ ক্ষেত্রে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয়, যেগুলো তেল ও পানি শুষে নিতে পারে। ক্লে বা কাদামাটিসদৃশ কাঠামোতে অক্সিজেন অথবা হাইড্রোক্সিল গ্রুপ থাকে। এগুলো আকৃতিতে চৌকোনাকৃতি কিংবা অষ্টকাকৃতির হয়। প্রতিটি কাঠামোর কেন্দ্রে থাকে একটি সিলিকন বা অ্যালুমিনিয়াম পরমাণু। পরে এ পৃথক কাঠামোগুলো পরপর সন্নিবেশিত হয়ে একটি দীর্ঘ স্তর তৈরি করে। এ স্তরের ফাঁকে ফাঁকেই তেল বা পানি আটকে যায়! পাউডার, ফাউন্ডেশন, লোশন, বাম, জেল, স্প্রে ইত্যাদি কসমেটিকসের মধ্যে এ ম্যাটিফাইং উপাদান সচরাচর উপস্থিত থাকে।

তৈলাক্ত ত্বক

চামড়ার কুঞ্চনরোধী ক্রিম

প্রোটিন আমাদের শরীরের বিল্ডিং ব্লক। ত্বকের জন্য কোলাজেন আর ইলাস্টিন প্রোটিনের ভূমিকা অসামান্য। তারা জালের মতো বিছিয়ে থেকে কাঠামো ও স্থিতিস্থাপকতা দেয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রোটিন তৈরির পরিমাণ কমতে থাকে। তাই ত্বক টানটান থাকে না। একটু ঝুলে পড়ে কিংবা ভাঁজ দেখা দেয়। এমন ত্বকের জন্য এম ক্রিম ব্যবহার করা হয়, যেগুলোতে কোলাজেন ও ইলাস্টিন মেশানো থাকে। এতে কিন্তু ত্বক সরাসরি টানটান ও সজীব হয় না; বরং প্রোটিনের টুকরোগুলো ভেতরে ঢুকে ত্বককে কিছুটা নমনীয় করতে পারে। কিন্তু শুকিয়ে যাওয়ার পর এই প্রসাধন আরও টানটান হয়, তখন মনে হয়, আমাদের ত্বক বুঝি আগের তুলনায় বেশ সতেজ ও নমনীয়!

দাঁত শুভ্রকরণ টুথপেস্ট

দাঁতের এনামেলের ওপর ব্যাকটেরিয়া হলদেটে রঞ্জক পদার্থের আস্তরণ তৈরি করে। এ হলদে ভাব দূর করতে টুথপেস্ট চমত্কার কাজ করে। এর ভেতর একধরনের দানা থাকে। এনামেলের সঙ্গে সেই দানাগুলোর ঘর্ষণের ফলে হলদে আস্তরণের ক্ষয় হয়। টুথপেস্টের কার্বামাইড পারঅক্সাইড হলুদ আস্তরণের অণুর বিশেষ অংশ ক্রোমোফোরকে ভেঙে দেয়। ফলে দাঁত হয়ে ওঠে সাদা।

পানিরোধী মাশকারা

পেট্রোক্যামিকেলের অসম্পূর্ণ দহনে যে কার্বন পাওয়া যায়, সেই কার্বনই চোখের পাপড়িতে আমরা ব্যবহার করি মাশকারা হিসেবে! আয়রন অক্সাইডও ব্যবহৃত হয় লালচে ও বাদামি শেডের জন্য। ব্যবহারের সুবিধার্থে এদের তেল, পানি ও মোমের সঙ্গে মিশিয়ে একটি মিশ্রণ পেস্ট তৈরি করা হয়। মৌমাছির মোম, শেলাক (ল্যাক বাগ নিঃসৃত তৈরি একধরনের রেসিন), ল্যানোলিন, প্যারাফিন ইত্যাদি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে জলরোধী মাশকারা পানির তুলনায় বেশি মোম ও তেল ধারণ করে। সেটা চোখের পাপড়িতে বেশি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয় ও আর্দ্রতায় বাধা দেয়। মাশকারায় গ্লিসারিন স্টিয়ারেটের মতো লুব্রিকেন্ট থাকে। এটা মাশকারাকে পিচ্ছিল চকচকে করে। জলরোধী মাশকারার সঙ্গে পানির শত্রুতা। তাই, এটা তোলার জন্য তৈলাক্ত মেকআপ রিমুভার দরকার।

এক্সফোলিয়েটর

আমাদের ত্বকীয় কোষগুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত নতুন কোষের জন্ম হচ্ছে, মৃত্যু ঘটছে পুরোনোদের। মৃত কোষগুলো সরিয়ে ত্বক উজ্জ্বল ও নমনীয় করে এক্সফোলিয়েটর। আমাদের ব্যবহৃত তোয়ালেই ত্বকের উপরের কিছু মৃত কোষ দূর করতে পারে! কিন্তু ত্বকের গভীরের মৃত কোষ দূর করতে অনেক ধরনের ট্রিটমেন্ট রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চিনি, বাদামের খোসা, প্লাস্টিকের চূর্ণ ব্যবহার করা হয় পরিষ্কারক উপাদান হিসেবে। ত্বকের ওপর রাসায়নিক পদার্থের স্তর দিয়ে মৃত কোষ দূর করা আরেক ধরনের ট্রিটমেন্ট। এ ট্রিটমেন্টে স্যালিসাইক্লিক অথবা ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়।

ত্বকে চমৎকার আলোর আভা

চকমকে শ্যাডো

চোখের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে চকমকে শ্যাডো ব্যবহার করা হয়। এতে থাকে মাইকা অথবা বিসমাথ অক্সিক্লোরাইড। মাইকা টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইডের সঙ্গে মেশালে আলোর উপস্থিতিতে একধরনের চমত্কার ঝলক তৈরি করে। অন্যদিকে বিসমাথ ক্লোরাইড মুক্তোর মতো মোলায়েম চকমকে আভা তৈরি করে চোখের পাতায়।

মেকআপ প্রাইমার

প্রাইমার দিনভর মেকআপকে সতেজ ও সজীব রাখে। এ ক্ষেত্রে প্রাইমারে থাকা সিলিকন আর্দ্রতা ও তেল শুষে নিতে সাহায্য করে। আর মোম ও পলিমার কসমেটিকসকে ত্বকের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আটকে রাখতে রাখে। গোলাকার সিলিকন অণু টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ত্বকে চমত্কার আলোর আভা তৈরি করে।

সূত্র: হাউ ইটস ওয়ার্কস