ফুকুশিমার বর্জ্য যাবে সাগরে!

জাপান ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র থেকে প্রায় দশ লাখ টনেরও বর্জ্যপানি সমুদ্রে অবমুক্ত করতে চায়। প্রতিবেশী চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া শুরু থেকেই দৃঢ়ভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আসছে। তবে বিজ্ঞানীদের মতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মোতাবেক এই কাজটি করা সম্ভব হলে পরবর্তী ঝুঁকির পরিমাণ অত্যন্ত কম।

২০১১ সালের ১১ই মার্চ ভয়ানক সুনামি আঘাত হানে জাপান উপকুলে। এর পরপরই আঘাত হানে ভয়াবহ ভূমিকম্প। ফলে বিপর্যস্ত হয় জাপানের পূর্ব উপকূলের এই নিউক্লিয়ার শক্তিকেন্দ্রটি। বিপুল ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে নেওয়া হয় বিকল্প ব্যবস্থা। নিউক্লিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত ও গলিত তেজস্ক্রিয় জ্বালানির ধ্বংসাবশেষ থেকে অতিরিক্ত তাপ সৃষ্টি হয়। সেই তাপকে প্রশমিত সমুদ্রের পানি পাম্প করে চালানো পাওয়ার প্ল্যান্টটিতে। গত এক দশকে প্রায় প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টন পানি পাম্প করা হয়েছে। পাম্প করা পানি ব্যববহারের পর দূষিত হয়ে যায়। সেই দূষিত পানিকে আবার শোধন করে স্টিলের ট্যাঙ্কে সংরক্ষণ করেছে ফুকোশিমা কর্তৃপক্ষ। এক হাজার বিশালাকৃতির ট্যাংক ইতোমধ্যে ভর্তি হয়েছে। যা প্রমাণ সাইজের পাঁচ শটি সুইমিং পুলের সমান। এই পানি এখন সাগরে ফেলতে চায়।

যেকোনো নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রেই এভাবে দূষিত পানি শোধনের ব্যবস্থা থাকে। শোধনের পর, সেসব পানি সমুদ্রে ফেলার চল আছে। তাহলে ফুকুশিমার এই দূষিত পানি শোধন করে সাগরে ফেলতে দোষ কোথায়? বেলজিয়ান নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানী জর্ডি ভিভিস ই ব্যাটল সামুদ্রিক পরিবেশের তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা করেন। সুনামির পর থেকেই তিনি ফুকুশিমায় গবেষণা করে আসছেন। তিনি বলেন, 'ফুকুশিমার এভাবে পরিশোধিত পানির পরিমাণ অনেক বেশি। এই পানি আবার সরাসরি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের গলিত বর্জ্যের সংস্পর্শে এসেছে। ফলে এ পানিতে রেডিওনিউক্লিওটাইডের ঘনমাত্রাও অনেক বেশি। এমন ঘটনা আগে কখনো দেখা যায়নি।'

বর্জ্যপানি সমুদ্রে অবমুক্ত করার এই পরিকল্পনা গত ১৩ই এপ্রিল অনুমোদন করে জাপান। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা বলেন, 'শোধন করা পানি সাগরে ছেড়ে দেওয়টাই আসল সমাধান।'

দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছিল। কিন্তু নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে বারবার পিছিয়ে যাচ্ছিল। তবে সবকিছুরই তো সীমা আছে। শোধন করা পানির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এত পানি আটকে রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। জাপান সরকার এই পানি সর্বোচ্চ নিরাপত্তার সাথে অবমুক্ত করতে সবরকম ব্যবস্থা নেবে বলে জানান জাপানী প্রধানমন্ত্রী। তবে সেটা আটকে গেছে যেমন প্রতিবেশী চীন আর কোরিয়ার বিরোধিতার কারণে। স্থানীয় মৎসজীবিরা কিছুতেই পানি সমুদ্রে ফেলতে দিতে রাজি নন। কারণ তেজস্ক্রিয়তার কারণে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকি আছেন তারাই। এছাড়া কিছু পরিবেশবাদী সংস্থাও বিরোধিতা করছে।

প্রাকৃতিকভাবেই পরিবেশে তেজস্ক্রিয়তার উপস্থিতি দেখা যায়। এখন পর্যন্ত পানি অবমুক্তকরণে জাপানের যে পরিকল্পনা, তাতে শোধন করা পানিতে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা যে প্রাকৃতিক পরিবেশের তেজস্ক্রিয়তার চেয়ে বেশি হবে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানাচ্ছেন প্রকল্পের পরিচালকেরা। এদিকে ফুকুশিমা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি বলছে, শোধন করার ফলে সিজিয়াম ও স্ট্রনশিয়ামসহ অধিকাংশ রেডিওনিউক্লিওটাইড পানি থেকে দূর হয়ে যায়। এই পানিতে কিছু মাত্রায় ট্রিটিয়াম অবশ্য রয়ে গেছে। তবে যেকোনো রেডিওনিউক্লিওটাইডের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নির্গত করার হার কম।

কিন্তু ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে বেইজিংয়ের চায়না ইনস্টিটিউট অব অ্যাটমিক এনার্জির গবেষক ল্যু সেনলিনের কাছ থেকে। তিনি এই পরিকল্পনাকে 'অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন' বলে মনে করছেন। তবে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসসি বলেন, শোধন করা পানিতে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা খুব কম। আবার এই ঝুঁকির পরিমাণ কম রাখতে পানি কয়েক বছর ধরে অবমুক্ত করা হবে।

নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব লাইফ সায়েন্সেস ইন অসলোর সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল রেডিওঅ্যাক্টিভিটির পরিচালক ও পারমাণবিক রসায়নবিদ ডেবোরা আউটন যোগ করেন, 'পরিবেশে ও মানুষের মতো জীবন্ত প্রাণীর দেহে প্রাকৃতিকভাবে ট্রিটিয়াম থাকে। জাপান যেভাবে পানি অবমুক্তকরণের পরিকল্পনা করেছে, তাতে এই কাজটি দুই থেকে তিন বছর ধরে চলবে। এর ফলে সুপেয় পানিতে যেমন তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নিরাপদ, এই পানিতে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা প্রায় সমান।'

জাপানি গবেষকদের দাবি পুরো প্রক্রিয়ার নকশা এমনভাবে করা হয়েছে, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও এ ঘটনা সামুদ্রিক পরিবেশে প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার চেয়েও ১০০ গুণ কম ক্ষতিকর হবে। আইএইএ নিবিড়ভাবে এই প্রকল্পের সমস্ত পরিকল্পনা, প্রয়োগ ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত আছে। আইএইএর ডিরেক্টর-জেনারেল রাফায়েল বলেন, 'আমরা পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের সময় সেখানে থাকব।'

ইউনিভার্সিটি অব টোকিওর সমুদ্রবিশেষজ্ঞ এবং মেরিন রসায়নবিদ শিগেয়োসি অতোসাকা সুনামির পর থেকে রেডিওনিউক্লিওটাইডের বিস্তারের প্যাটার্ন নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। তিনি বলেন, 'বৈজ্ঞানিক উপাত্ত যেন সকলে সঠিকভাবে বুঝতে পারেন, সেটা মাথায় রেখে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এই কাজটি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, 'খুব সামান্য রেডিওনিউক্লিওটাইড খুঁজে পেলেও কেউ যদি সেটা ঠিকমত বুঝতে না পারে, তাহলে পরে তাতে নানা সমস্যার দেখা দেবে।’

আউটন বলেন, 'যদি জনগণের আস্থা ধরে না রেখে এই পানি অবমুক্ত করা হয়, তবে জাপানের মৎসশিল্পে এটা বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। সতর্কভাবে অবমুক্তকরণ-পরবর্তী কাজগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, মানুষকে বোঝাতে হবে যে এই সামান্য তেজস্ক্রিয়তাবিশিষ্ট সামুদ্রিক খাবার মানব স্বাস্থ্যে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব রাখবে না।'

লেখক: শিক্ষার্থী, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: ন্যাচার ব্রিফিং, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, গার্ডিয়ান