খামারিদের প্রাণিসেবা দিয়ে শুরু করে এশিয়া সেরা
বিজ্ঞানীদের তালিকায় একজন
বাংলাদেশের ভেটেরিনারি চিকিৎসাকে বিশ্বমানে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। হাজার হাজার খামারিকে স্বাবলম্বী ও সচেতন করে তুলেছে তাঁর গবেষণা। প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি মিটিয়ে উদ্বৃত্তের পর্যায়ে গেছে বাংলাদেশ, এর পেছনে রয়েছে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান। প্রাণিচিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০২০ সালে পেয়েছেন নরম্যান ই বোরল্যাগ অ্যাওয়ার্ড। পেয়েছেন ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশনের স্বীকৃতিও। তিনি এশিয়ার সেরা বিজ্ঞানীদের তালিকায় তিন বাংলাদেশির একজন। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন ইফতেখার মাহমুদ
এত সব উদ্যোগ আর সাফল্যের পেছনের গল্পটা কিন্তু এত সহজ ছিল না। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করে অন্য আট-দশজন শিক্ষার্থীর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন সালমা। সুযোগও পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তাঁর মায়ের স্বপ্ন ছিল, মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। বাবার চাকরি সূত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘোরা আর বাস করার সুযোগ হয়েছিল তাঁদের। বাড়িতে ছাগল, গরু, খরগোশসহ নানা প্রাণী পুষতেন তাঁরা। প্রাণিদের প্রতি প্রবল ভালবাসা থাকলেও জ্যোতির্বিজ্ঞান বা মহাকাশ নিয়ে পড়াশুনার স্বপ্ন ছিল তাঁর ভিতরে। তবে মা রুবিয়া সুলতানার ইচ্ছায় ভর্তি হন ভর্তি হন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১২ সালে অনার্স শেষ করার পর মাস্টার্সে ভর্তি হতে সময় লাগছিল। সময়টা কাজে লাগানোর উপায় খুঁজছিলেন সালমা। তখনই প্রথম আলোয় একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। বিজ্ঞাপনটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের। প্রাণী সুরক্ষাবিষয়ক একটি প্রকল্পে প্রাণিচিকিৎসক চেয়ে বিজ্ঞাপনটি দেওয়া হয়েছিল। সেই বিজ্ঞাপন দেখে সেখানে আবেদন করেন সালমা। হয়ে যায় সেই চাকরি।
প্রকল্পের কাজে চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন খামারে প্রাণিচিকিৎসার কাজে সালমাকে যেতে হয়। কাছ থেকে দেখে বুঝতে পারেন, দেশের গ্রামীণ জনপদের অন্যতম প্রধান সম্পদ এই গরু-ছাগল ব্যবস্থাপনা এবং প্রাণীগুলোর চিকিৎসা নিয়ে কী পরিমাণে ভোগান্তি পোহাতে হয়। কৃষকেরা সামান্য সব রোগের জন্য গরু-ছাগলকে অ্যান্টিবায়েটিক খাওয়াচ্ছেন আর তা মাংসের মাধ্যমে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে। এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য কৃষকদের সময়মতো সহজ সমাধানের পথ দেখানোর কাজ করতেন তিনি। কিন্তু ২০১৩ সালে মাস্টার্স ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়। অগত্যা চাকরি ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনায় ফিরতে হলো তাঁকে।
কিন্তু প্রাণীর চিকিৎসার যে বাস্তব চিত্র সালমার মনে গেঁথে গেছে, তা থেকে বের হতে পারেননি। মাস্টার্স শেষে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কাছে প্রাণিচিকিৎসাসেবার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আবেদন করেন। অনুমতি পেয়ে নিজের জমানো টাকা ও পরিবারের সহায়তা নিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু করেন। পদে পদে বাধা আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এখনো তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রেখেছেন তো বটেই, কার্যক্রম বিস্তৃত করছেন প্রতিনিয়ত। সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও এখন তাঁরা কাজ করছেন। এসব কাজে প্রাণীকে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি একের পর এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেতে থাকে তাঁর প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি এশিয়ান সায়েন্টিস্ট-এর সেরা ১০০ জন বিজ্ঞানীর তালিকায় নাম এসেছে সালমার। এ নিয়ে তাঁর অনুভূতি ছিল, ‘একজন গবেষকের জন্য এটা অনেক গর্ব ও সম্মানের বিষয়। নিঃসন্দেহে নিজের কাজের স্বীকৃতি পেয়ে অনেক আনন্দিত। এই স্বীকৃতি অনেক বড় একটি অনুপ্রেরণা, যা আমার কাজে উৎসাহ প্রদান করবে এবং কাজের গতিকে ত্বরান্বিত করবে।’
সালমা জানান, বেকার যুবকদের দক্ষ প্রাণিসম্পদ স্বাস্থ্যসেবাকর্মী হিসেবে তৈরি করতে কাজ করছেন তিনি। উদ্যোগটা বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন ‘মডেল লাইভস্টক ইনস্টিটিউট ঢাকা’-এর। এক বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। প্রশিক্ষণের ক্যাটাগরিগুলো হলো সার্টিফিকেট ইন অ্যানিমেল হেলথ অ্যান্ড প্রোডাকশন ও সার্টিফিকেট ইন পোলট্রি ফার্মিং। নতুন নতুন উদ্যোক্তা ও আধুনিক খামারি তৈরি করতেও খামারিদের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করেন তিনি। প্রাণিপালন, ডেইরি খামার ব্যবস্থাপনা, গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজনন, হ্যাচারি ম্যানেজমেন্টসহ প্রয়োজন অনুযায়ী গরু মোটাতাজাকরণ, দই, পনির, ঘি তৈরি প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ও টেকসই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করার কাজ চলছে।
এ ছাড়া এমলাফ (এমএলএএফ) বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি বহির্বিভাগ প্রাণী হাসপাতাল কার্যক্রম শুরু করে, যা গৃহপালিত প্রাণী (গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, উট প্রভৃতি), পোষা প্রাণী (কুকুর, বিড়াল, খরগোশ প্রভৃতি) এবং পাখির (ব্রয়লার, লেয়ার, হাঁস, কবুতর, কোয়েল প্রভৃতি) চিকিত্সা, সার্জারি, পোস্টমর্টেম, ভ্যাকসিনেশন, পরামর্শ প্রদান, খামার পরিদর্শন এবং মোবাইল ভেটেরিনারি পরিষেবাগুলো দেয়।
এমলাফ প্রমাণভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য একটি ছোট পরীক্ষাগার স্থাপন করেছে। এখানে মল, মূত্র, রক্ত পরীক্ষা, ক্যালিফোর্নিয়া ম্যাস্টাইটিস টেস্ট (সিএমটি), পানির জীবাণু পরীক্ষা, খাদ্যে ফরমালিনের উপস্থিতি নির্ণয়, দুধের ভেজাল পরীক্ষা এবং গর্ভাবস্থা নির্ণয়–সম্পর্কিত পরীক্ষাগুলো করা হয়। দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিরসনের জন্য দাতব্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছে এমলাফ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধি, বিনা মূল্যে গবাদিপশুকে চিকিৎসা, কৃমিনাশক ও টিকা প্রদান, নারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে ছাগলসহ খামার তৈরির উপকরণ প্রদান, ভ্রাম্যমাণ প্রাণী স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা, বন্যা–পরবর্তী ভেটেরিনারি হেলথ ক্যাম্প পরিচালনা, জুনটিক রোগের (যে রোগগুলো প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে হয়) বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, প্রাণিকল্যাণ তথা পথপ্রাণীগুলোর খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।
নারী হিসেবে এই পেশা ও উদ্যোগ নিয়ে সালমা বলেন, ‘বাংলাদেশে ভেটেরিনারি পেশায় নারীরা অবমূল্যায়িত। কিছু নিয়োগকর্তা ভাবেন, নারীরা এই ক্ষেত্রে কাজ করতে কম সক্ষম। এ দেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা অনেক কম। তাই বাংলাদেশের ভেটেরিনারি খাতে প্রথম নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আমিও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছি। তেমনি অল্প বয়স হওয়ার কারণে, অনেকে আমার কাজের প্রতি মনোযোগ দেয়নি বা মূল্যায়ন করেনি। মূলধন জোগান ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাও বড় সমস্যা ছিল। ফলে কার্যক্রম পরিচালনা করতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ ছাড়া আমি কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, সর্বস্তরের খামারিরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে আগ্রহী নন। তাঁরা গতানুগতিক খামার ব্যবস্থাপনার বাইরে আসতে চান না। আধুনিক প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত নন তাঁরা, ফলে তাঁদের পশুর স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় না। এই মনোভাবের ফলে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অত্যধিক বেড়ে যায়। উপরন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী লোকজন চাইতেন না মাঠপর্যায়ে দক্ষ জনবল তৈরি হোক এবং খামারি শিক্ষিত হোক। তাই তাঁরা আমার কার্যক্রমের বিরোধিতা করতেন।’
নারীদের গবেষণায় আগ্রহ বাড়াতে সালমার মত হচ্ছে, ‘নারীদের উৎসাহিত করতে তাঁদের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত। তাঁদের এমন একটি পরিবেশ দেওয়া উচিত, যেখানে তাঁরা নিরাপদভাবে তাঁদের গবেষণা কার্যক্রম করতে পারবেন। সবার আগে পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে, সেই সঙ্গে সর্বস্তরে লিঙ্গসমতা আনতে হবে ও নারীদের যোগ্যতাকে খাটো করে দেখার মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। খেয়াল করে দেখবেন, এশিয়ার সেরা ১০০ জন বিজ্ঞানীর তালিকায় বাংলাদেশের যে তিনজন বিজ্ঞানী স্থান পেয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই নারী। তাহলে এটা সহজে প্রমাণ করে যে নারীদের উৎসাহের কমতি নেই, শুধু তাঁদের নির্ভয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরিবেশ দিতে হবে।’
‘বিজ্ঞানচিন্তা’র পাঠকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘চিন্তাচেতনায় বিজ্ঞান যাঁদের, সেই তরুণেরাই একসময় গবেষণাকর্মে অংশগ্রহণ করেন। বিজ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগের লক্ষ্যে আমাদের তরুণদের আরও বেশি এগিয়ে আসতে হবে। তাঁদের লক্ষ রাখতে হবে, যাতে তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল শুধু বড় বড় জার্নালে প্রকাশ বা উচ্চতর শিক্ষায় সীমাবদ্ধ না থাকে। এই ফলাফলগুলো যাতে মাঠপর্যায়ে জনগণের কাছে সহজে পৌঁছায় এবং তারা তা গ্রহণ করে সময় ও অর্থ বাঁচিয়ে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করতে পারে।’
লেখক: পরিবেশবিষয়ক সাংবাদিক, প্রথম আলো
*লেখাটি ২০২১ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত